মুস্তাফিজ শিহাব
ধরুন এমন একটি সমাজ যে সমাজের মানুষেরা অকল্পনীয় নিরাপত্তা ও শান্তিতে বসবাস করে। দিনের বেলায় তারা যে যে দিকে খুশি যেতে পারে। তাদের মনে সমাজের অন্য মানুষ দ্বারা কোনো বিপদের আশংকা সৃষ্টি হয় না। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তাদের মনে কখনই আসে না যে আজ তার হাতের দামি ঘড়িটি কেও ছিনতাই করতে পারে। তারা ভাবতেও পারে না যে তাদের টাকা পয়সা ঘরে রেখে গেলে তা চুরি হয়ে যাবে। পরিবার নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরতে যেতে পারে কারন তাদের মনে তার স্ত্রী কন্যার শ্লীলতাহানীর ভয় থাকে না। আর খুন, ধর্ষণ? সেগুলোর কথা তারা চিন্তাতেও আনে না। যদি কোথাও কখনও কোনো অপরাধ সংগঠিত হয় তবে অপরাধী যথাযথ শাস্তি লাভ করে। রাতের বেলা তারা দরজা খুলে ঘুমাতে পারে। স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে চলে যেতে পারে, তাদের সম্পদের কোনো হানী হয় না। বেতনভুক্ত আলাদা কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজন পড়ে না। একা একটি মেয়ে মানুষ তিন-চার দিনের দীর্ঘ সফরে একা একা চলে যেতে পারে। তার মনে মানুষের দ্বারা কোনো ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হওয়ার ভয় থাকে না। ভাবুন তো একবার, এমন একটি সমাজ কী সম্ভব?
আমার এ কথাগুলো শুনে অনেকেই ভাবতে পারেন আমি গল্প বলছি, এগুলো আমর নিছক কল্পনা। অনেকেই হয়তো অবাক হবেন ও আমার প্রশ্নের জবাবে বলবেন, না এমন সমাজ শুধু রূপকথাতেই সম্ভব। কিন্তু আমি বলবো ঠিক এমনই একটি সমাজ গঠন সম্ভব হয়েছিল। এমন একটি সমাজের রূপ আমরা ইতিহাস থেকেই দেখতে পারি। ইতিহাস সাক্ষী এমনই শান্তি ও নিরাপত্তা আল্লাহর রসুল ও খোলাফায়ে রাশেদিনের সময়ে অর্ধ দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগের কথা যদি আমরা বিবেচনায় আনি যখন আরবরা ছিল গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত। তাদের সমাজে কোনো ন্যায় ছিল না। তারা যে যার খুশি মত চলত। যার শক্তি ছিল সে সেই শক্তির অপব্যবহার করে যা খুশি করতে পারত। নারীদের কোনো সম্মান ছিল না। নারীরা ছিল ভোগের বস্তু। এইরকম একটি সময়ে আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলকে সেই ভূমিতে প্রেরণ করলেন। রসুল এসে তাদের ঐ অবস্থা দেখে ব্যাথিত হলেন ও তাদেরকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য গভীর চিন্তায় চিন্তামগ্ন হলেন। তিনি নিভৃতে হেরা গুহায় গিয়ে ভাবতেন কিভাবে এ সমাজকে এ অন্ধকার থেকে দুর করার যায়। নির্দিষ্ট সময় আসলে মহান আল্লাহ তাঁকে নবুয়্যাত দিলেন। এরপর তিনি নামলেন সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে পুনরায় আলোকিত করার মিশনে। আল্লাহর রসুল সর্বপ্রথম সমগ্র জাতিকে একটি কথার উপর আহ্বান করলেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানবো না। প্রথমে আরব সমাজের হর্তাকর্তারা এই কথাকে মেনে নিতে অস্বীকৃত জানাল কারণ এ কথা মেনে নেয়ার ফলে তাদের হুকুম আর সে সমাজে চলবে না। তারা আল্লাহর রসুলের বিরোধিতা শুরু করল। এক পর্যায়ে গিয়ে আল্লাহর রসুল মদিনায় হিজরত করলেন এবং সেখানকার মানুষকে এই একটি কথার উপর ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হলেন। তারা এই কথার উপর গোত্র, ধর্ম, জাত, বর্ণ ইত্যাদি সবকিছু ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হল। তখন সে সমাজে নেমে এল শান্তি। আল্লাহর রসুল থাকাকালীন সময়ে পুরো আরব উপদ্বীপে শান্তি প্রতিষ্টায় সক্ষম হলেন এবং তিনি চলে যাবার পর তাঁর আসহাবরা অর্ধ দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করলেন।
একটি সমাজে সকল মানুষ যখন আল্লাহকে হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয় তখন তারা প্রতিটি কাজে আল্লাহর হুকুমকে প্রাধান্য দেয়। সে জাতি হয় আল্লাহর হুকুমের অঙ্গিকারে অঙ্গিকারবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ। এর ফলে তারা হয় এক অভিন্ন জাতি, তাদের নেতা হয় একজন, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয় একটি। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ মন্দকাজের আদেশ দেন না (সুরা আরাফ ২৮)।” একটি জাতির সকল মানুষ যখন আল্লাহর হুকুমকে মেনে নেয় তখন প্রতিটি কাজ করার পূর্বে তাদের মনে আল্লাহর হুকুমের চিন্তা আসে। সে বিয়ে করতে গেলে চিন্তা করে যে সে যৌতুক নিবে নাকি মোহরানা দিবে। যেহেতু আল্লাহ বলেছেন যে মোহরানা দিতে হবে তখন সে সেটাই করে। আবার সে গরুর গোশত খাবে না শুকরের গোশত খাবে তাও সে সিদ্ধান্ত নেয় সে আল্লাহর হুকুমকে বিবেচনা করে। অতএব সেই সমাজে কোন অন্যায় হতে পারে না, কোনো অত্যাচার হতে পারে না, কোনো দূর্নীতি হতে পারে না। অতএব আমরা যদি আজ পুনরায় দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই একটি কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারি যে আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানব না তবে আমাদের সমাজেও সেরকম শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হবে যেমনটি পূর্বে হয়েছিল।
(মুস্তাফিজ শিহাব- কলামিস্ট, facebook/glasnikmira13)