ইসলামে ঈদুল ফেতর, ঈদুল আযহা, শবে কদর ইত্যাদি বড় বড় কয়েকটি পর্ব এবং উৎসবের পরেই আরেকটি বড় আনুুষ্ঠানিকতা পালন করতে দেখা যায়, আর তা হলো শব-এ-বরাত। তবে এই পর্বটি প্রধানত ইরান তথা শিয়া অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেই ব্যাপক আকারে পালিত হতে দেখা যায়। পাশাপাশি ভারতীয় উপমহাদেশ তথা ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান অঞ্চলেও এর ব্যাপক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। ইরানীদের ধর্মীয় জীবনে শব-এ-বরাত রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। এই রাতে পুরো ইরান জুড়ে ব্যাপক আলোকসজ্জা করা হয়। দেশটিকে সুন্দর পরিপাটি করে নয়নাভিরাম শোভায় সাজানো হয়। রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি, শরবত, নাশতা ইত্যাদি বিলানো হয়। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলিম জনসংখ্যা সুন্নী মযহাবের অনুসারী, তথাপি তারা কিছু কিছু ব্যাপারে পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার সুন্নীদের চেয়ে আলাদা কিছু ধর্মীয় রীতি রেওয়াজ পালন করে থাকে। এর কারণ এই যে, এই অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করেছে মূলত আরব থেকে পারস্য হয়ে। আর তাই পারস্যবাসীদের ইসলামপূর্ব অগ্নি উপাসনা যুগের অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় পরিভাষা এবং চিন্তা চেতনাসহ এই উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অগ্নি উপাসনা যুগে পারস্যবাসীরা যাকে উপাস্য হিসাাবে মানতো তাকে তারা ডাকতো‘খোদা’ নামে। পারস্য হয়ে এ উপমহাদেশে ইসলাম প্রবেশের সময় মহান আল্লাহর আরেকটি নাম হয়ে গেল ‘খোদা’। অথচ কোর’আন কিংবা মহানবীর পবিত্র মুখনিঃসৃত বাণীগুলির কোথাও মহান আল্লাহর নাম ‘খোদা’ ব্যবহৃত হয়নি। পারস্যবাসীরা তাদের ‘খোদার’ সামনে নত হয়ে যে এবাদত করত তার নাম ‘নামায’। আর ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ন দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন পাঁচবার যে এবাদত করা হয়, আল্লাহ তার কোর’আনে বিরাশি বারের অধিক সালাহ্ নামে যা উল্লেখ করেছেন তার নাম হয়ে গেলো ‘নামায’। পরিতাপের বিষয় হলো এই উপমহাদেশীয় অধিকাংশ মানুষের সামনে ‘সালাহ’ শব্দটি উচ্চারণ করলে তারা তার কোন মানেই বুঝতে পারে না। পাশাপাশি ইসলামের পরিভাষা সওম শব্দটি হয়ে গেছে ‘রোযা’, যা তারা তাদের ‘খোদার’ সন্তুষ্টির লক্ষ্যে উপবাস থেকে পালন করত। এমনি করে পারস্য ধাঁচের ইসলাম এই উপমহাদেশে প্রবেশের ফলে আরো বহু চিন্তা চেতনারও পরিবর্তন ঘটেছে, এর মধ্যে বিকৃত সুফীবাদ অন্যতম। যেহেতু পারস্যবাসীরা মহা ধুমধামের সাথে শব-এ-বরাত পালন করে, সেহেতু এরাও তাই করে থাকে। অথচ এই এলাকার বাইরে অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এর কোন গুরুত্বই নেই। ইসলামে যদি সত্যিকার অর্থে এর কোন অবস্থান থেকে থাকত তবে বিকৃতভাবে হলেও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ ও সৌদি আরবে এই নামে কিছু না কিছু পালিত হতো। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায় এর কোন পরিচিতিই সেখানে নেই।
শিয়া মতবাদের অনুসারীরা বিশেষ করে এই দিনটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করার ব্যাপারে একটি কারণ উল্লেখ করে থাকে, আর তা হলো “তারা মনে করেন এই দিনে এমাম মাহদী (আ.) এর জন্ম দিন। তাদের অধিকাংশ আলেমের মতানুসারে এই দিনে ২৫৫ হিজরির রাতে এমাম মাহদী (আ.) জন্মগ্রহণ করেছেন। বর্তমানে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান করছেন এবং যথাসময়ে তিনি আবির্ভূত হবেন”। আরবের মুসলিমরা এই দিনটি না পালন করার ব্যাপারে শিয়াদের অভিমত হলো এমাম মাহদীর (আ.) জন্মের মাধ্যমে আব্বাসীয়দের (সুন্নী) পরাজয় ঘটবে বিধায় তারা তাঁকে প্রতিহত করতে চেয়েছিলো এবং শত্রুতাবশত তারা এই দিনটিকে অবজ্ঞা করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ২৫৫ হিজরিতে এমাম মাহদীর জন্ম হয়নি। হতে পারে আল্লাহর রসুল ১৫ শাবান ঐ মহামানবের জন্মদিন বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের কাছে শিয়াদের বিশ্বাস ছাড়া কোন স্পষ্ট দলিল নেই।
যদিও ইসলামে শব-এ-বরাত সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য কোন তথ্য পাওয়া যায়না, তবুও শব-এ-বরাত পালনে এটি একটি বিশেষ কারণ হতে পারে। এ সম্বন্ধে আল্লাহর রসুলের বাণী পাওয়া যায় যেখানে আল্লাহর রসুল বলছেন, “তোমরা এ রাতে জাগ্রত থাকো, এবং দিনের বেলায় সওম পালন কর”।
শব-এ-বরাতকে মনে করা হয় সৌভাগ্য রজনী হিসাবে। সত্যিকারের ভাগ্যরজনী হলে এই সৌভাগ্য শুধু মুসলিমদের সৌভাগ্য নয়, এ সৌভাগ্য সমস্ত মানবজাতির। কেননা আল্লাহর সর্বশেষ রসুলের ভবিষ্যতবাণীগুলির মধ্যে অন্যতম একটি ভবিষ্যতবাণী হলো তার ওফাতের পরে একজন মহামানবের আগমন ঘটবে যার আগমনের মাধ্যমে দূর নক্ষত্রে হারিয়ে যাওয়া ইসলাম পুনর্জীবন পাবে। যার নেতৃত্বে আবার শান্তির সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিচার, ন্যায়নীতি, শান্তি ও নিরাপত্তা। যাকে আল্লাহর রসুল আখ্যায়িত করেছেন নিজের ভাই হিসাবে। যার মাধ্যমে তাঁর মিশন পূর্ণতা পাবে, তার রসুলের উপর আল্লাহ প্রদত্ত উপাধি রহমাতাল্লিল আলামিন সার্থকতা পাবে এবং আল্লাহর চূড়ান্ত অভিপ্রায় ইবলিসের দেয়া চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হয়ে সমগ্র মানবজাতির মধ্যকার অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, মারামারি, কাটাকাটি অর্থাৎ ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা সম্পূর্ণভাবে দূরীভূত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, সমস্ত ভৌগোলিক সীমারেখা ভুলে, সমস্ত প্রকার ভেদাভেদ ভুলে সমগ্র মানবজাতি একটি মাত্র জাতিতে পরিণত হবে। সুতরাং যে রাতে তার জন্ম সে রাত অবশ্যই এক মর্যাদাবান রাত। এ রাত উৎসবের রাত, আধ্যাত্মিকতায় সমৃদ্ধ হওয়ার রাত।