আদিবা ইসলাম
অনেকে রিজিক হাসিলের প্রচেষ্টাকে দ্বীনের বাইরে দুনিয়াদারী বলে মনে করেন। এর কারণ কোর’আন হাদিসে দুনিয়া বলতে যেটা বোঝানো হয় সেই ‘দুনিয়া’ সম্পর্কে আকীদা বিকৃত হয়ে যাওয়া। তারা মনে করেন নামাজ, রোজা, জিকির আজগার ইত্যাদি ধর্মকর্ম হচ্ছে দ্বীনের কাজ, আর ব্যবসা বাণিজ্য কৃষি খামার ইত্যাদি দুনিয়ার কাজ। এই বিকৃত আকীদার জন্য জীবিকা হাসিলে কেউ খুব ব্যতিব্যস্ত হলে সেটাকে ভালো নজরে দেখা হয় না, বরং মনে করা হয় তিনি দ্বীনের চাইতে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বেশি। অথচ ইসলামে বৈধ উপায়ে জীবিকা হাসিল করার জন্য কতই না তাগাদা দেয়া হয়েছে। জীবিকা হাসিল করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা করতে বলা হয়েছে। রিজিক তালাশের চেষ্টা করা যদি ‘দুনিয়া’ হত তাহলে আল্লাহর রসুল তাঁর আসহাবদেরকে দুনিয়ার জন্য সময় ও শ্রম ব্যয় করতে উৎসাহ যোগাতেন কি?
এছাড়া অনেকে এও ভেবে থাকেন যে, মো’মেনদেরকে জীবিকার পেছনে বেশি সময় ও শ্রম ব্যয় করা উচিত নয়, তাদের উচিত অল্পে তুষ্ট থাকা। তাহলে বোধহয় আল্লাহ বেশি সন্তুষ্ট থাকবেন। এজন্য সামর্থ থাকা সত্ত্বেও রিজিক হাসিলের চেষ্টা না করে কার্যত অন্যের বোঝা হয়ে থাকেন। এই ধারণাই বা কতটুকু সঠিক?
মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজ-কর্তব্যের সাথে জড়িত। সুষ্ঠভাবে জীবনের সকল দায়িত্বকে পালন করার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দায়িত্ব পালনের নাম দুনিয়াদারী নয়। দুনিয়াদারী হচ্ছে কেবল সেই বিষয়, যেটা মানুষকে আল্লাহর হুকুম মানতে বাধা প্রদান করে। ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। আর এই ভারসাম্য হচ্ছে দ্বীন-দুনিয়ার ভারসাম্য, দেহ-আত্মার ভারসাম্য, ইহকাল-পরকালের ভারসাম্য। এ কারণে আল্লাহ কোর’আনে মো’মেন-মুসলিমদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ জাতি বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহর রসুল তাঁর সংগ্রামী জীবনে বারবার উম্মাহকে ভারসাম্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কোথাও তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেননি, বরং তাঁকে বলতে শুনি- আমানতদার সৎ ব্যবসায়ীর আখেরাত হবে নবী, রসুল ও সিদ্দিকগণের সাথে।
এ বিষয়ে মদীনার এক সমাবেশে প্রদত্ত রসুলাল্লাহর একটি ঐতিহাসিক ভাষণ নিচে তুলে ধরা হলো-
‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি, জীবিকা হাসিল করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায়ে চেষ্টা কর এবং তোমাদের প্রচেষ্টার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কর। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, কোনো মো’মেনের সত্ত্বাকে দুনিয়ায় বেকার এবং অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। বরং তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কর্ম ও কর্তব্যের সঙ্গে সংযুক্ত। কর্ম ও প্রচেষ্টার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। অল্পে সন্তুষ্টি এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার অর্থ এ নয় যে, হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা এবং নিজের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। নিশ্চয়ই আল্লাহর উপর ভরসা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য। কিন্তু রেযেক হাসিল করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা নিতান্তই জরুরি বিষয়।
আমি বনু সা’আদ গোত্রের এক স্ত্রীলোককে ‘চাক্কী’ পিষতে দেখেছি এবং সাথে সাথে এ দু’আ করতে শুনেছি, ’আল্লাহুম্মা আরযুকনা।’ ‘হে আল্লাহ আমাদেরকে রেযেক দাও।’ আমি এ তাওয়াক্কুল ও প্রচেষ্টা দেখে নিতান্তই খুশি হয়েছি।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমাদের রব ইরশাদ করেন: “হে বনি আদম, আমি তোমাদেরকে দুনিয়াতে ক্ষমতা প্রদান করেছি। এতে তোমাদের জন্য জীবিকাও দিয়েছি। কিন্তু তোমরা খুব অল্পই শোকর আদায়কারী।” (সুরা আরাফ ১০) এতে এ ইশারা রয়েছে যে, সম্ভাব্য উপায়ে রেজেক হাসিল করার জন্য প্রচেষ্টার সাথে সাথে তার পরিপূর্ণতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা বান্দার উচিত।
আমি তোমাদেরকে অবহিত করছি যে, দুনিয়ায় যত নবী-রসুল এসেছেন তাদের সবাই রেজেক হাসিলের জন্য চেষ্টা- সাধনা করতেন এবং নিজেদের বোঝা অন্যের উপর চাপিয়ে দিতেন না। অতএব তোমরাও রুজি হাসিলের জন্য কোশেশ (চেষ্টা) কর। মেহনত-মজদুরী করা এবং লাকড়ির বোঝা নিজের মাথায় উঠানো অন্যের কাছে সওয়াল করার চেয়ে উত্তম। যার জীবিকা উপার্জনের সামর্থ্য রয়েছে অন্যের কাছে চাওয়া তার জন্য খুবই অসম্মানজনক। সে দুনিয়াতেও লাঞ্ছিত এবং শেষ বিচারের দিনও তাকে এমন অবস্থায় হাজির করা হবে যে তার চেহারায় গোশত থাকবেনা। আমি পরিষ্কারভাবে তোমাদের বলছি, যার কাছে একদিনের খাদ্যও মওজুদ রয়েছে তার জন্য সওয়াল করা অবশ্যই হারাম। আমি জানি, কোনো কোনো সংসারত্যাগী ভিক্ষাবৃত্তিকে জায়েয বলে, কিন্তু ইসলাম হাত-পা গুটিয়ে বসা এবং ভিক্ষাবৃত্তি এখতিয়ার করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম আমাদের হুকুম করেছে যে, দুনিয়ায় ছড়িয়ে যাও এবং আল্লাহর করুণা তালাশ কর। যে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে বাঁচবে, নিজের পরিবার-পরিজনের পর-ওয়ারিশ করা ও প্রতিবেশীর সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য হালাল উপায়ে জীবিকা হাসিল করবে সে কেয়ামতের দিন পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জল চেহারা নিয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হবে। দুনিয়াতেও তার জন্য সম্মান ও প্রতিপত্তি রয়েছে।
হে মুসলিমগণ! এ কথা স্মরণ রাখ, তোমরা যদি রেজেকের সন্ধানে মশগুল থাকো এবং রোজগার হাসিলের জন্য চেষ্টা করতে থাকো তাহলে দুনিয়াতে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম হবে এবং আখেরাতেও তোমরা মহান প্রতিদান লাভ করবে। কে বলে ইসলাম রেজেক হাসিলের চেষ্টা কে উত্তম মনে করে না এবং পার্থিব উন্নতির সাথে কোনো সর্ম্পক রাখে না? এ এক অপবাদ। যার হাতে আমার জীবন রয়েছে তাঁর শপথ, সংসার ত্যাগ করাকে ইসলাম কখনও জায়েয বলে না এবং হাত পা গুটিয়ে বসার তালিম দেয় না বরং মানুষকে মেহনত করার জন্য উদ্বুব্ধ করে। ইসলামের শিক্ষা হলো – দুনিয়ার জিন্দেগীর জন্য সংগ্রাম কর এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ো না।
হে মানুষ! অবৈধ উপায়ে একে অন্যের মাল হাসিল কর না। নিজেদের প্রাণ ধ্বংসের মধ্যে ফেলো না। বরং নিজেদের জীবিকা হাসিলের জন্য খুব বেশি চেষ্টা কর এবং আল্লাহর গযবকে ভয় কর। আমি মনে করি রেজেক হাসিলের উপায় উপকরণের মধ্যে তেজারত (ব্যবসা-বাণিজ্য) সবচেয়ে উত্তম। তাই যার সামর্থ্য রয়েছে সে যেন তা এখতিয়ার করে। কেয়ামতের দিন সৎ আমানতদার তাজির (ব্যবসায়ী)-কে নবী-সিদ্দিক এবং শহীদদের সাথে উঠানো হবে। তাই প্রত্যেক ব্যবসায়ীকে সত্যবাদী এবং আমানতদার হওয়া উচিত। মানুষের আহারযোগ্য সর্বোত্তম হালাল রুজি হলো তার পরিশ্রমলব্ধ রোজগার এবং সেই তেজারত, যাতে মিথ্যা এবং ধোঁকাবাজি শামিল নেই। যত দূর সম্ভব তেজারত কর এ জন্য যে, তাতে বরকত রয়েছে।
আল্লাহ তার উপর রহম করেন, যে বেচা-কেনা এবং টাকা-পয়সা আদায়ের ব্যাপারে নম্রতা অবলম্বন করে। তেজারতের জন্য তোমরা যে ঋণ গ্রহণ কর যথাসম্ভব ওয়াদা মোতাবেক তা ফিরিয়ে দাও। তাতে পারস্পরিক বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। মনে রেখো আমানত রেজেক দান করে এবং খেয়ানত দারিদ্র্য সৃষ্টি করে। আমি তোমাদেরকে হুঁশিয়ার করছি, যার আমানত নেই-তার ঈমান নেই। যার প্রতিশ্রুতি মজবুত নয়-তার দীন নেই। যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোনো মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোনো ব্যাক্তি অধিক সালাত আদায় ও অধিক সিয়াম পালন করা দেখে ভুল কর না, বরং লক্ষ কর সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না, এবং তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা। এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা। যদি সে আমানতদার ও সত্যবাদী হয় এবং হালাল উপায়ে রেজেক হাসিল করে তাহলে নিশ্চয়ই সে কামেল মো’মেন। (ভাষণটি ‘মহানবী মোহাম্মদ (সা.) এর ভাষণ’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)