আরিফ মো. আলী আহসান
সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকা চলে না। বিশেষ করে চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও উপলব্ধিতে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অভিন্ন হতেই হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র যদি একটি সিড়ির আলাদা আলাদা ধাপ হয়, তাহলে সমাজের পরের ধাপটাই হচ্ছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সাথে তাই ব্যক্তির দূরত্ব থাকতে পারে, কিন্তু সমাজের দূরত্ব মানা যায় না। চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবোধে রাষ্ট্র সমাজ থেকে যত দূরে সরে যাবে একটি জাতির উন্নতি ও প্রগতির সিড়ি ততটাই অকার্যকর হয়ে পড়বে। জাতি গতি হারিয়ে ফেলবে।
রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের বৃহত্তর পরিসর। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে উদ্ভূত সমস্যা, রীতি-নীতি, প্রথা-পরম্পরা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অনুষ্ঠান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে সমাজ। আর তা করতে গিয়ে কোনো প্রশ্নে সিদ্ধান্তের দরকার হলে সমাজ তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে যখন সমাধান দিতে পারে না, তখনই কেবল দরকার পড়ে রাষ্ট্রের। অর্থাৎ রাষ্ট্রের সাথে সমাজের তফাৎ যদি থাকে সেটা ক্ষমতায়; বিশ্বাসে নয়। বিশ্বাসের পার্থক্য রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করে, যার পরিণতি বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি।
দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র সেই বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির মধ্যেই নিপতিত হয়েছে। এর কারণ ধর্মবিশ্বাস। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের সমাজ বিশ্বাসকেন্দ্রিক। ব্যক্তি থেকে আরম্ভ করে পরিবার ও সমাজের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও আচরণের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে ধর্মবিশ্বাস। অন্যদিকে রাষ্ট্রকে করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ, কার্যত ধর্মহীন। ফলে দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রধান প্রধান সেক্টরগুলো এমনভাবে তৈরি হয়েছে যার সাথে সমাজের বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার কোনো সুসম্পর্ক নেই, বরং তা সামাজিক বিশ্বাসের পরিপন্থীও বলা চলে। সমাজ যদি বলে কালো, রাষ্ট্র বলছে সাদা, সমাজ যদি বলে সাদা রাষ্ট্র বলে কালো। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্র যেহেতু সমাজের উপর কর্তৃত্বশীল, সুতরাং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে সমাজকে বাধ্য করছে। যেমন সুদ। ধর্ম সুদকে নিষিদ্ধ করেছে, সুদের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো কর্মকাণ্ড ধর্মে অবৈধ। ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের সমাজ সুদ আদান-প্রদানকে অতি গর্হিত কাজ বলেই জেনে এসেছে। যদি কেউ সুদের লেনদেন করে সমাজ তাকে ঘৃণা করে। মানুষ মনে মনে হলেও সুদখোরকে ধিক্কার দেয়। অথচ সেই সুদ আজ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূলভিত্তি এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে সুদকে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে রাষ্ট্র।
সমাজে ধর্মের শতভাগ প্রভাব বজায় রেখে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণভাবে ধর্মমুক্ত করার এই সাংঘর্ষিক ও অপ্রাকৃতিক সিদ্ধান্তের পরিণতি দাঁড়াচ্ছে এই যে, সমাজে দানা বাধছে ক্ষোভ। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে রাষ্ট্রের সাথে সমাজের। সূত্রপাত হচ্ছে সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার।
রাষ্ট্রের হাতে আছে সামরিক শক্তি, প্রশাসনিক শক্তি। রাষ্ট্রের হাতেই অর্থনীতি। সুতরাং সমাজ যতই রাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়–ক, রাষ্ট্রের আনুগত্য থেকে হাত গুটাতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। এদিকে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম অবিশ্রান্ত প্রচারণা চালাচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। সেখানে ধর্ম অবহেলিত ও অবজ্ঞাত, মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রতীক। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাস এসব প্রচারমাধ্যমের কাছে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। তারা বরং ব্যস্ত থাকে রাষ্ট্রকে ধর্মের যে কোনো সংস্পর্শ থেকে মুক্ত রাখতে।
শিক্ষাব্যবস্থাও তৈরি করা হয়েছে ধর্মকে সচেতনভাবে এড়িয়ে। সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মের বিশেষ জায়গা নেই। এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা কিছু নাস্তিক ও সংশয়বাদী হয়, আর অধিকাংশই ধর্ম সম্পর্কে সীমাহীন অজ্ঞতা ও হীনম্মন্যতা নিয়ে দিনাতিপাত করে। অন্যদিকে মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে যেগুলো সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, সেগুলোতে সচেতনভাবে ধর্মের রাষ্ট্রসম্পর্কিত দিকটিকে ছেটে ফেলে ব্যক্তিগত আচার-আচরণ, এবাদত-উপাসনাকে অতি গুরুত্ব দিয়ে উপরে উঠানোর প্রচেষ্টা চলে। আর যেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সেখানে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, মূল্যবোধ ও চিন্তাধারার বিপরীত চর্চা চলে। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সরকার যতটা আতঙ্কিত, সমাজ কিন্তু ততটাই আন্তরিক। এখানে এসে সমাজ ও রাষ্ট্র পুনরায় মুখোমুখি।
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি মোতাবেক ধর্মমতে অবৈধ জ্ঞান করা হয় এমন কোনো কাজ করলেও রাষ্ট্র কারও কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয়, সুতরাং কোনো ধর্মবিশ্বাসী গোষ্ঠী ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে যদি কোনো কারণে রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায়, রাষ্ট্র তাদের প্রতি শত্র“ভাবাপন্ন হয়ে ওঠে। সেই শত্র“ভাবকে কাজে লাগিয়ে ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে উস্কানি দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার ঘটনাও অহরহ ঘটে। ফলে পরিস্থিতি যে রক্তাক্ত পরিণতির দিকে গড়ায়, তাকে না ধর্মবিশ্বাস দ্বারা বৈধতা দেওয়া যায়, না ধর্মনিরপেক্ষতা দ্বারা।
ধর্মনিরপেক্ষতার তীর্থভূমি ইউরোপে কিন্তু এ ধরনের ঘটনা কল্পনাও করা যায় না, যদিও সেখানকার সমাজ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত। ইউরোপের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের মূল উৎসভূমি যে ধর্ম তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মবিশ্বাসী সমাজের দ্বন্দ্ব এত প্রবল নয় যতটা প্রবল আমাদের মতো প্রাচ্যের দেশগুলোতে। তাই প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- যে ব্যবস্থা ইউরোপের রাষ্ট্র ও সমাজকে স্থিতিশীল রাখতে পারছে, সেই একই ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে কেন? এর কারণ- আমাদের সমাজ এমন একটি ধর্মবিশ্বাসের ধারক যা নিছক উপাসনা বা আচার-অনুষ্ঠাননির্ভর নয়। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সকল অঙ্গনের নীতিমালা সুনির্দিষ্ট রয়েছে। এমনকি শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি সব বিষয়ে এতটা স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এবং তা লঙ্ঘন করার ক্ষেত্রে জোরালো নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যে, ধর্মের সেই সমষ্টিগত ভাগটাকে বাদ দিলে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। অন্যদিকে ইউরোপ যে ধর্মবিশ্বাস থেকে পরিচালিত তাতে সমষ্টিগত জীবনের দিক-নির্দেশনা নেই, আছে ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের নৈতিক বা আত্মিক শিক্ষা। তাই ইউরোপের জন্য রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত বা ধর্মহীন করে ফেলা যতটা সহজ, আমাদের জন্য ততটাই কঠিন।
বাংলাদেশকেই উদাহরণ হিসেবে নেয়া যাক। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল কোর’আন, যেখানে মহান আল্লাহ মুসলিমদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনের নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। একজন মুসলিম যখন ইসলামের ইতিহাস পড়ে, সে জানতে পারে এক সময় ইসলামই ছিল মুসলিমদের সমষ্টিগত জীবনের নিয়ন্ত্রক, প্রাণশক্তি। ইসলামের শাসনে অতীতে এমন শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, সমাজে কোনো অপরাধ ছিল, শোষণ ছিল না, দারিদ্র্যও ছিল না। রাতের অন্ধকারে একা অলংকার পরিহিত যুবতি নারী মাইলের পর মাইল পথ চলতো, তার মনে কোনো ভয় জাগ্রত হতো না। কোথাও চুরি ছিল না, ডাকাতি ছিল না। সে বোঝে বর্তমানে সমাজের এত অন্যায়, অবিচার, অনিরাপত্তা, অশান্তির কারণ হলো জাতীয় জীবন থেকে ধর্মকে বিতাড়িত করা হয়েছে। সে তার জন্য দায়ী মনে করে রাষ্ট্রকে। একইভাবে কেউ যখন কোর’আন খোলে সে তার জাতীয় জীবনের করণীয় দিকগুলোকে চাক্ষুষ দেখতে পায় এবং এও জানতে পারে যে, আল্লাহ চান মানুষ তার দেওয়া বিধি-ব্যবস্থা অনুযায়ী নিজেদের পরিচালিত করুক। অথচ বাস্তবে ঘটছে সম্পূর্ণ উল্টো। এর জন্য একদিকে সে যেমন রাষ্ট্রকে দোষারোপ করে, অন্যদিকে নিজেকেও অপরাধী ভাবতে থাকে, অনুতপ্ত হয়। সেই অপরাধী মনোভাব থেকে সঞ্চারিত হয় ক্ষোভ। ক্ষোভ থেকে সৃষ্টি হয় হিংসা ও হিংস্রতা, যার সমাপ্তি ঘটে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের মাধ্যমে।
এভাবে আমাদের সমাজে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে, বিশ্বাসকে মূল্য দিতে গেলে রাষ্ট্র প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, রাষ্ট্রকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে গেলে বিশ্বাসের বন্ধনে চিড় ধরছে। ধর্মহীন রাষ্ট্র ও ধর্মাবৃত সমাজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার বদলে পথ চলছে ব্যাপক অনাস্থা ও অসহযোগিতা নিয়ে। বলা বাহুল্য, ধর্মনিরপেক্ষ ইউরোপকে কিন্তু এই দ্বান্দ্বিক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় নি।
লেখক: গোপালগঞ্জ জেলা আমীর, হেযবুত তওহীদ।