রিয়াদুল হাসান
খ্রিষ্টীয় মতবাদের নামে মধ্যযুগীয় নিষ্পেষণ, রাজতন্ত্র আর চার্চের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধের (Power struggle and civil war) হাত থেকে বাঁচার জন্য পশ্চিমারা ধর্মকেই সামষ্টিক জীবনের সবগুলো অঙ্গন থেকে পরিত্যাগ করে ধর্মহীন একটা সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। সেই সভ্যতাকে তারা দুনিয়াময় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। তবে ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে তাদের এই প্রতিষ্ঠা দু’দিক থেকে ব্যর্থ হয়েছে। একটি জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই বড় কথা নয়, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজীবনে শান্তি প্রদান করা। ধর্মনিরপেক্ষ ধারণা ইউরোপে আমেরকিায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অনেকাংশেই কিন্তু শান্তি দিতে পারে নি। বরং তারাই বাকি দুনিয়ার জন্য অশান্তি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাতের মূল কারণ হিসাবে প্রতীয়মাণ হচ্ছে। নিজেদের দেশেও তারা ভোগবিলাস ও আরাম আয়েশ সত্ত্বেও নিরাপত্তাহীনতা ও অশান্তির মধ্যে বাস করে। দ্বিতীয়ত, যাদের ধর্মে জাতীয় জীবনের বিধি বিধান আছে তাদের দ্বারা এই ব্যবস্থা গৃহীতই হয় নি। যেমন মুসলিম, সনাতন, ইহুদিরা হৃদয় থেকে ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারছে না এবং ধর্মকে যতই বিতাড়িত করা হোক, তা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাদের জাতীয় জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। এবং সেই প্রভাবটা প্রায় সব ক্ষেত্রেই হয় নেতিবাচক।
তাহলে এখন কী করণীয়?
এখন করণীয় হলো যেভাবে ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করা হয়েছিল ঠিক সেভাবে আবার তা রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। এ কথাটি শুনেই যেন কেউ ধরে না নেয় যে আমরা মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্র (Theocratic State) এর কথা বলছি। মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্র জবরদস্তিমূলক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী হওয়ায় অশান্তিপূর্ণ, তাই সেটা কখনোই ধর্মের শাসন নয়, সেটা ধর্মের নামে ফ্যাসিবাদমাত্র। সেটা আধুনিক বিশ্বে টেকসইও হবে না। এখন যেটা করতে হবে তা হলো, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর এই ধর্মবিশ্বাসকে রাষ্ট্রের কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করতে হবে। ধর্মবিশ্বাসী জনগণের ঈমানকে আর ব্যক্তি পর্যায়ে বৃত্তবন্দী রাখা যাবে না। রাখলে তা ধর্মব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণেই থেকে যাবে আর ধর্মব্যবসায়ীরা দুই দিন পর পর বিভিন্ন ইস্যু ধরে ফতোয়াবাজি করে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সহিংসতা ও উগ্রতার দিকে নিয়ে যাবে; ঈমানকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর উপাদান হিসাবে ধর্মকে ব্যবহার করবে। তাতে সমান্তরালভাবে মুক্তচিন্তার দাবিদার মানুষের ধর্মবিদ্বেষই বৃদ্ধি পাবে ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডও বৃদ্ধি পাবে। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে গোষ্ঠী ও রাজনীতিক স্বার্থ হাসিল করবে। তাই “ধর্ম যার যার – রাষ্ট্র সবার, উৎসব সবার” ইত্যাদি মনোহর কথা বলে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির পথ রুদ্ধ করা যাবে না। এমন কি এই কথা বলে ধর্মকে এত সামান্য বিষয় মনে করে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। সারা পৃথিবীতে যুগপৎ ধর্মবিদ্বেষ ও ধর্ম উন্মাদনার একটি জোয়ার বইছে। জঙ্গিগোষ্ঠী গুপ্তহত্যা করছে একের পর এক ধর্মবিদ্বেষী লেখক, ব্লগার, প্রকাশককে। সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডও হচ্ছে, শিয়া-সুন্নী বিভেদও প্রকট হচ্ছে রক্তপাতের মাধ্যমে। ঘৃণাভিত্তিক গণজাগরণ মঞ্চের চেতনাবাজি আর ধর্মীয় আবেগভিত্তিক হেফাজতের গলাবাজি ও রক্তময় ঘটনাটি বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মত বড় ঘটনা, যা হয়তো অনেকেই এখনো অনুধাবন করতে পারছেন না। সুতরাং ধর্মের নিয়ন্ত্রণ আর ধর্মজীবী শ্রেণিটির হাতে রাখা যাবে না, রাখলে তা পুনঃ পুনঃ একই রকম দুঃখজনক পরিস্থিতির জন্ম দেবে। মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে জাতি ও রাষ্ট্রের স্বার্থে জাতির কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।
ধর্ম আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এ কথাটি বোঝা কঠিন, কেননা ধর্মের কাজ বলতে এখন কেবল দাড়ি, টুপি, জোব্বা, নামাজ, রোজা ইত্যাদিই ধরা হয় আর এগুলোকে রাষ্ট্রের কল্যাণে কী করে ব্যবহার করা যেতে পারে? সেটা হচ্ছে জাতির সামনে ধর্মকে সঠিক রূপে উপস্থাপন করতে হবে। আজ ‘রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম’ মানেই হচ্ছে দোররা মারা, চুরি করলে হাত কেটে দেওয়া, নারী নেতৃত্ব হারাম করে দেওয়া, গান গাওয়া, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ, সিনেমা, মূর্তিপূজা ইত্যাদি বন্ধ করে দেওয়া। ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার জন্য এই কু-ধারণা প্রচার করা হয়েছে। এর পেছনে কট্টরপন্থী কিছু মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও অতি-বিশ্লেষণকারী ওলামা শ্রেণি দায়ী। এই প্রপাগান্ডার স্বচ্ছ জবাব মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রকৃত ধর্ম জানতে পারলে মানুষ বুঝবে যে দোররা মারা ইত্যাদি ইসলামের উদ্দেশ্য নয়, ইসলামের উদ্দেশ্য মানবসমাজে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা সৃষ্টি করা। মানুষকে প্রকৃত ধর্মের শিক্ষা দ্বারা উদ্বুদ্ধ করা গেলে মানুষ তখন জাতির ক্ষতি হয়, জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয় এমন কোনো কাজ তো করবেই না, বরং প্রতিটি মানুষ জাতির কল্যাণে একেকজন অতন্দ্র প্রহরীতে পরিণত হবে। তাদের সামনে জাতির ঐক্য নষ্ট হয় এমন কোনো কথাও কেউ বলতে সাহস করবে না। এই শিক্ষাও ধর্মেই আছে, কিন্তু সেটাকে চাপা দিয়ে অনেক গুরুত্বহীন বিষয়কে, বহু আপেক্ষিকতার উপর নির্ভরশীল বিষয়কে জল ঘোলা করার জন্য প্রথম লাইনে টেনে আনা হয়েছে। জল ঘোলা করার উদ্দেশ্য কোথাও ধর্মব্যবসা, কোথাও অস্ত্রব্যবসা।
মনে রাখতে হবে যে, একটি সিস্টেম যতই নিখুঁত হোক তা কোনো তা যদি একদল ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর, বদলোকের হাতে পড়ে তাহলে ঐ সিস্টেম মানুষকে শান্তি দেবে না, কারণ তারা ক্ষমতাকে স্বার্থের জন্য ব্যবহার করবে। মানুষ বৈষয়িক দিক থেকে নির্লোভ হবে তখনই যখন সে এই কাজের বিনিময়ে আল্লাহর কাছ বিপুল পুরস্কার লাভ করবে বলে বিশ্বাস করবে। কোনোরূপ বিনিময় ছাড়া কেউ কোনো কাজ করবে এটা মানুষের স্বভাবজাত নয়, আত্মিক প্রেরণা থেকে দু-একজন করতে পারে কিন্তু তা জাতীয়করণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষকে তার প্রকৃত এবাদত ও মানবজীবনের সার্থকতা বোঝানো হলে এখন যেমন তারা ব্যক্তিস্বার্থে জাতির ক্ষতি করে তখন তারা বিপরীত করবে, তারা নিজের সর্বস্ব কোরবানি দিয়ে জাতির সমৃদ্ধির জন্য প্রয়াস করবে। তাদেরকে নেতার আনুগত্যের গুরুত্ব বোঝানো হলে এখন যেমন তারা যে কোনো বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনর্থক বিরোধিতা করে সহিংস ঘটনা ঘটায় তখন তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যে কোনো নির্দেশ জাতির কল্যাণার্থে মাথা পেতে গ্রহণ করবে। এখন যেমন তারা সত্য মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝেও স্বার্থের জন্য মিথ্যা ও অন্যায়ের পক্ষে যায়, তখন তা করবে না। যে কোনো ত্যাগের বিনিময়েও সত্যের পক্ষ নেবে। কেননা তারা নিশ্চিতভাবে জানবে যে এই কাজের বিনিময় তারা স্রষ্টা থেকে লাভ করবে। এখন তারা যেমন ক্ষুদ্র লাভের জন্য খাদ্যে বিষ মেশায়, ঔষধে ভেজাল দেয়, খুন, হত্যা, ষড়যন্ত্র, গুম ইত্যাদি চালায় তখন তারা সেটা আর করবে না। অর্থাৎ সৎ মানুষ তৈরি হবে, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পেলে সমাজও অপরাধমুক্ত হবে। তখন মানুষ তারা চাকুরিসুলভ মানসিকতা পরিহার করে নিজেরেদকে মানবতার কল্যাণে উদ্দীপ্ত করবে এবং সম্মিলিত সচেতন প্রয়াসে জাতিকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। জাতির মধ্যে এই জাগরণ সৃষ্টি করতে হলে তাদের ধর্মবিশ্বাসকেই কাজে লাগাতে হবে। কেননা যে কাজগুলোর কথা বললাম এ সবগুলো কাজের প্রবণতা সৃষ্টির উপাদান ধর্মের মধ্যে রয়েছে। না লাগানো হলে ধর্ম মানুষের কোনো কল্যাণেই লাগবে না, উল্টো ধর্মব্যবসায়ীদের অঙ্গুলি হেলনে অকল্যাণেই লাগবে।
এখন সেগুলি কে মানবজাতিকে প্রদান করবে? সেটা করার জন্যই হেযবুত তওহীদ। এই ধারণাগুলো আল্লাহ হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। কারণ এই সৃষ্টি আল্লাহর, এই পৃথিবীও আল্লাহর। এই পৃথিবী ও মানবজাতি যখন ধ্বংসের পরিস্থিতিতে চলে যায়, সমস্যা এমন ঘনীভূত হয় যে মানুষ কোনোক্রমেই আর সেখান থেকে বেরোতে পারে না, তখন আল্লাহ স্বয়ং হস্তক্ষেপ করেন। তিনিই কোনো না কোনো উপায়ে তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করেন, সৃষ্টিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনেন। এই সুরক্ষা তিনি মানুষদের মধ্য দিয়েই করেন। হেযবুত তওহীদকে আল্লাহ ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা প্রকৃত রূপ দান করেছেন। আমরা জাতির কল্যাণে, মানবতার কল্যাণে আসন্ন এই মহা বিপর্যয় সংকট থেকে রক্ষার জন্য সকল নবী রসুলের আনীত ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরতে চাই। শুধু চাই-ই না, আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি তুলে ধরার। অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্য যে, এই কাজে আমাদের কোনো বৈষয়িক স্বার্থ, কোন ভিন্ন অভিপ্রায় নাই। আমরা জানি যে, এটা আল্লাহর প্রকৃত ইসলামের কাজ, তাই আমরা আল্লাহ কাছে এর প্রতিদান অবশ্যই পাবো।
কাজেই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও সর্বস্তরের মানুষকে আমাদের সম্পর্কে জানার ও বোঝার জন্য আহ্বান করছি। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, অন্যের দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে আমাদের সম্পর্কে সঠিক ও সত্য জানুন। তারপর গ্রহণ করার মতো হলে গ্রহণ করুন, না হলে প্রত্যাখ্যান করুন। কিন্তু অস্পষ্ট বা ভুল ধারণা যেন না থাকে। গণমাধ্যমের প্রতিও এই কথা। তাদের শক্তিশালী প্রচারযন্ত্রের দ্বারা এই সত্যগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরে জাতির জীবনরক্ষায় ভূমিকা রাখুন।
শেষ কথা হচ্ছে, মানবজাতির মধ্যে যত প্রকার অশান্তি বিরাজ করে তার মূল কারণ একটি নিখুঁত জীবনব্যবস্থার অভাব। বর্তমানে জীবনব্যবস্থার নির্মাতা যেহেতু পশ্চিমা সভ্যতা দাজ্জাল, তাই তারাই সকল অশান্তির মূল কারণ। তারা মানবজাতির মূল শত্র“। শত্র“ চিহ্নিত করা সমসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতা এতটাই প্রতারক যে তাদেরকে মানুষ শত্র“ নয়, মিত্রও নয় একেবারে উপাস্য বানিয়ে রেখেছে। তারা গরু মেরে জুতা দান করলে আমরা সে জুতায় চুমু খাই আর ভাবি আরেক পাটি জুতা কবে জুটবে। আমাদেরকে এই হীনম্মন্যতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। শত্র“-মিত্র চিনতে হবে। পশ্চিমারা গত ২০০ বছরে শত শত ভয়াবহ যুদ্ধ চাপিয়ে পৃথিবীর পরিবেশ, জলবায়ুকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছে। কত কোটি মানুষ হত্যা করেছে তার ইয়ত্তা নেই। তারা ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি চাপিয়ে দিয়ে আজো আমাদেরকে ঐক্যহীন করে একে অপরের বিরুদ্ধে শত্র“ভাবাপন্ন করে রেখেছে। কোনো ইস্যুতেই আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না। তারা আধুনিক, তাই তাদেরকে অনুসরণ না করে উপায় নেই – এ কথার ভিত্তিতে আমরা তাদের অনুসরণ করে যাচ্ছি। কিন্তু যাচ্ছি কোথায় সেটাও তো দেখতে হবে। আমি কি তাদের অনুসরণ করতে করতে নিজের দেশটাকেই ধ্বংস করে ফেলব, আমি কি তার পেছন পেছন গিয়ে সাগরে ডুবে মরব, উদ্বাস্তু হবো?
সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে নিতে হবে।