‘ধর্মবিশ্বাস’ – পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন অথচ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রভাবশালী ধারণা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কত আদর্শ, কত চেতনা, কত বিশ্বাস, কত বিপ্লব, কত তত্ত্বের অবতারণা-প্রতিষ্ঠা; অথচ কালের গর্ভে অধিকাংশই বিলীন, ইতিহাস বা বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ অথবা প্রয়োজন নেই বলে মানুষ ভুলে গেছে। শুধু টিকে আছে ধর্মবিশ্বাস ও তার প্রাত্যহিক চর্চা। হ্যাঁ, স্থান-কাল-পাত্রভেদে এই বিশ্বাসের বৈচিত্র্য রয়েছে — কিন্তু যে ধারণা, যে বিশ্বাস, তার মূল নির্যাস একই। মহান আল্লাহ মানুষের কল্যাণের জন্য ধর্ম প্রেরণ করলেও কালের আঘাতে ধর্ম অধর্মে পরিণত হয়েছে, আর সেটাকে কুক্ষিগত করে কায়েমি স্বার্থ হাসিল করেছে স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী। সুদূর অতীত থেকে ধর্মকে আশ্রয় করে পৃথিবীতে সীমাহীন রক্তপাত ঘটানো হয়েছে, আজও ঘটানো হচ্ছে। ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির হাতিয়ার, সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার, অস্ত্রব্যবসার পুঁজি। ঘোর সেক্যুলার দলগুলোও ধর্মকে কাজে লাগাচ্ছে তাদের ধান্ধাবাজির রাজনীতিতে। এখানে নীতি আদর্শের কোনো বালাই নেই। বিচার্য একটাই, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোন ধর্মের সেন্টিমেন্ট লালন করে, কার বিরুদ্ধে কাকে লাগিয়ে দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে ভারতের অযোধ্যার রামমন্দির আর ফিলিস্তিনের থার্ড টেম্পল নিয়ে চলমান দুটোর প্রেক্ষাপট, ধরণ ও রাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় একই। ভারতে ধর্মের গুটি চালছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি, আর ইসরায়েলে জায়নবাদী গোষ্ঠী। দুটো ঘটনার যোগসূত্র এক জায়গায়- দু ¶েত্রেই বলির শিকার মুসলিম জনগোষ্ঠী।
বাবরি মসজিদ থেকে রামমন্দির
ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় অবস্থিত বাবরি মসজিদ বর্তমানে যেখানে হিন্দুদের রামমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পুরোটা সময় ধর্মীয় আবেগ ও বিশ্বাস রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্রিটিশদের ধর্মীয় বিভাজনমূলক শাসননীতির যুগ (উরারফব ধহফ জঁষব) থেকেই ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার গুরুত্বপূর্ণ এই সাইটটিকে নিয়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যকার সংঘর্ষ এড়াতে ১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন দেয়াল দিয়ে প্রার্থনার জায়গা আলাদা করে দেয়। কিন্তু ১৯৪৯ সালে মসজিদের অভ্যন্তরে রাম মূর্তি স্থাপন ও হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পরিদর্শন করা শুরু করলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সরকার বাধ্য হয়ে মসজিদটির গেটে তালা লাগিয়ে দেয়। এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল।
১৯৮৪ সালের ভারতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যেখানে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) মাত্র দুটি আসনে জয় লাভ করে। এই সময়টি নির্বাচন ছাড়াও দুটো বিষয়ের জন্য ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো ১৯৭৮ সাল থেকে চলে আসা ‘শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলা’ ও নির্বাচনের কয়েকবছর আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ভারতীয় জনতা পার্টিকে (বিজেপি) সাথে নিয়ে বাবরি মসজিদে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারাভিযান।
শাহ বানো বিবাহ-বিচ্ছেদ মামলার পটভূমিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস শুরুর দিকে মুসলিমদের শরীয়া আইনের বিরুদ্ধে আইন পাস করলেও পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে খারিজ করে ভারতীয় সংসদে ‘বিবাহ বিচ্ছেদ অধিকার সুরক্ষা আইন, ১৯৮৬’ পাস করার মাধ্যমে মুসলিম জনগোষ্ঠীর রোষাণল থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কারণে বিজেপিসহ অধিকাংশের মত ছিল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই আইনপাশের মাধ্যমে মুসলিম তোষণ করেছেন। এতে রাজনীতির মাঠে কংগ্রেস গোঁড়া হিন্দুদের সমর্থন হারাতে শুরু করে। ঐ সময়েই বাবরি মসজিদের তালা খোলা এবং ঐ স্থানে হিন্দুদের প্রার্থনা করার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন এক জেলা জজ। হিন্দুত্ববাদীদের মন যোগাতে আদালতের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতিবিদ ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, যিনি কিনা কিছুদিন আগেই মুসলিমদের সমর্থনে আইন পাস করেছিলেন। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে রাজনৈতিক সাম্যাবস্থার প্রচেষ্টা সবসময় সফল হয় না। বিজেপি ততোদিনে বৃহৎ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মনে জায়গা করে নিয়েছে। ফলে উভয়কূল রক্ষা করতে গিয়ে কংগ্রেস ১৯৮৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত হয়। আর যে বিজেপি গত নির্বাচনে ২ টি আসন লাভ করে, তারা এবার লোকসভায় ৮৮ আসনে জয়লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই এই জয়লাভ বিজেপিকে বাবরি মসজিদে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আরো উৎসাহ দেয়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক ইশতেহারে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করে এবং ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও দেড় লাখ করসেবককে নিয়ে বাবরি মসজিদে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা উপেক্ষা করে মসজিদটি ভেঙে ফেলে। আর এ কারণে ভারতজুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পরে। শুধু ভারতেই এই দাঙ্গায় সহস্র মানুষ মারা যায়, যার অধিকাংশই ছিল মুসলিম। আর প্রায় ৯,০০০ কোটি ভারতীয় রুপির (৩৬০ কোটি মার্কিন ডলার) সমমূল্যের রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট হয়। কিন্তু এসবকিছুর ঊর্ধ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়ে।
সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে বিজেপির এই উত্থান রাজনীতিবিদ ও পর্যালোচকদের দ্বারা স্বীকৃত। মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরির এই অন্যায় কাজে শুধু বিজেপিই নয়, কংগ্রেসও অংশগ্রহণ করেছে। পার্থক্য শুধু এই নোংরা প্রতিযোগিতায় ও কৌশলে বিজেপি এগিয়ে। বাবরি মসজিদ নিয়ে যে নিভু নিভু দ্বন্দ্ব চলে আসছিল হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে, সেটাকে আগ্নেয়গিরির রূপ দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এ আগুনে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ হাসিল হয়েছে ঠিকই কিন্তু পুড়েছে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যকার সম্প্রীতি, বিশ্বাস, তাদের বাড়িঘর, স্বজনেরা। এর মাধ্যমে ধর্মীয় উন্মাদনার যে বীজ বপন করা হলো, তা কখনো ছড়িয়ে পড়েছে জঙ্গি হামলার মাধ্যমে, কখনো বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারূপে; যা একটি একক, অখণ্ড ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ।
আল-আকসা, থার্ড টেম্পল ও নেতানিয়াহু সরকার
জেরুজালেম নগরটি মুসলিমদের নিকট মক্কা ও মদিনার পরে তৃতীয় পবিত্রতম শহর। কারণ মেরাজের রাতে মহানবীকে (সা.) এখানে আনা হয় এবং মুসলিমদের প্রথম কিবলা আল-আকসা মসজিদ এখানেই অবস্থিত। তাছাড়া পূর্ববর্তী নবী-রসুলগণের সাথে এ নগরীর যোগসূত্র রয়েছে। জেরুজালেম শুধু মুসলিম নয়, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। এই পবিত্রভূমিতে দাউদ (আ.) (কিং ডেভিড), সুলায়মান (আ.) (কিং সলোমন) শাসন করেছেন; ধর্মীয় উপাসনালয় তৈরি করেছেন। এ ভূমিতেই ধর্মপ্রচার করেছেন মুসা (আ.) (মোজেস) ও ঈসা (আ.) (যিশু খ্রিষ্ট)। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এই পবিত্রভূমি হতে পারতো আব্রাহামিক ধর্মগুলোর সম্প্রীতি ও ঐক্য স্থাপনের অন্যতম যোগসূত্র। কিন্তু অতীত ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি বলছে উল্টো কথা। ধর্মপ্রাণ মানুষের যেরুজালেম অনুভূতিকে কখনো শাসকগোষ্ঠী, কখনো ধর্মীয় যাজকশ্রেণিটি নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
ইহুদি জাতির উপর চলা নির্মম হলোকাস্ট (ইহুদি গণহত্যা) বন্ধ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। যেহেতু ইসরায়েল রাষ্ট্রটি জায়নবাদের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, এখানকার সংসদীয় শাসনব্যবস্থার রাজনীতিতে কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একটি অংশ (অর্থোডক্স এন্টি জায়োনিস্ট) যদিও ফিলিস্তিন দখল ও তাদের উপর হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে না, কিন্তু ইসরায়েলের অধিকাংশ ইহুদিই এই অন্যায়কে সমর্থন করে। কারণ তাদেরকে ধর্ম দিয়ে সেটা বোঝানো হয়েছে, বুঝিয়েছে এখানকার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় যাজক শ্রেণিটি। ইহুদি ধর্মবিশ্বাসকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়ে অতীতের নানা ইস্যু টেনে এনে এই অন্যায়ের বৈধতা দানের চেষ্টা করছে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। একই ধর্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে ইসরায়েল পার্লামেন্ট নেসেটের উপর ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের বিস্তর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা থাকলেও এখানে কট্টর ইহুদিবাদের বাইরে গিয়ে ক্ষমতা নিশ্চিতকরণ অসম্ভব। যে রাজনৈতিক নেতা যতো বেশি ইহুদি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিবে, সে ততো বেশি শাসক হিসেবে গ্রহণযোগ্য ও পরিচিত হবে। আর এই স্বার্থের বাইরে একটু এদিক-সেদিক হলেই ঐ শাসক পরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হয়।
ইসরায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘অসলো চুক্তি ও শান্তি প্রস্তাব’ সম্পন্ন হয় তৎকালীন ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ও পিএলও-এর ইয়াসির আরাফাতের মধ্যে। কিন্তু এই চুক্তি ইসরায়েলের কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদীরা মেনে নিতে পারেনি। তেলআবিবে শান্তি সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়ার সময় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনকে গুলি করে হত্যা করে কট্টর ইহুদি ধর্মাবলম্বী ও শান্তি প্রস্তাবের বিরোধী ইগাল আমির। এখানে স্পষ্টত যে, ইসরায়েলে রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে গেলে এখানকার ইহুদি জাতীয়তাবাদ ও স্বার্থকে সংরক্ষণ করে তবেই দিতে হবে। ঠিক এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন লিকুদ পার্টির নেতা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ১৯৯৬ সালে তিনি অসলো শান্তি চুক্তির বিরোধিতার মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন। আর তিনি এ পর্যন্ত ইসরায়েলের ইতিহাসে দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী। ইহুদি রাষ্ট্রের রাজনীতির ইতিহাস নখদর্পণে থাকার কারণে তিনি ধর্মকে রাজনীতির ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যেটা কংগ্রেসের রাজীব গান্ধী সেভাবে করতে পারেননি, যদিও চেষ্টা করেছিলেন আন্তরিকভাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর তোষণনীতিকে বেছে নেয়ার কারণে কয়েক যুগ ধরে ফিলিস্তিন মুসলিমদের উপর চালিয়েছেন নৃশংস হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। অন্যায়ভাবে তার নির্দেশে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের সহিংসতা, দখল ও ফিলিস্তিনি হত্যা বেড়েছে। এতকিছুর পরেও তার জনপ্রিয়তায় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় ৭ অক্টোবর ২০২৩-এ ইসরায়েল ভূখণ্ডে হামাসের আক্রমণ। ইসরায়েলীদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতা ও হামাসের কাছে জিম্মি থাকা ১৩০ জন মুক্তির সুরাহা না করায় নেতানিয়াহুকে দায়ী করছেন অনেকেই। এজন্য বর্তমান সরকারের পদত্যাগ এবং আগাম নির্বাচনের দাবিতে নেসেটের সামনে রাজপথে নেমেছে বিক্ষোভকারীরা।
বহু প্রাণহানি হবে জেনেও ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের পেছনে নতুন কারণ উঠে এসেছে মিডল ইস্ট আই বিখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড হার্স্টের ৪ নভেম্বর ২০২৩ সালের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, হামাসের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে খবর ছিল, আগামী বছরের এপ্রিলে ইহুদিদের পেসাখ উৎসবে আমেরিকা থেকে আনা লাল গাভী (রেড হেইফার) বলি দেওয়া হবে, যার পোড়ানো ছাই দিয়ে পবিত্র পানি প্রস্তুত করে ইহুদি যাজকদের পবিত্র করা হবে। আর এটি করা হয়ে গেলে আল আকসায় ইহুদিদের থার্ড টেম্পল (কিং সলোমনি মন্দির) নির্মাণের পথে ধর্মীয় কোনো বাধা থাকবে না। আর হামাস এটা মেনে নিবে না।
তালমূদে বিশ্বাসী ইহুদিদের প্রাত্যহিক জীবনে এর দিকনির্দেশনা গুরুত্বপূর্ণ। তালমূদ মূলত তাওরাতের প্রত্যাদেশগুলোর আলোকে ইহুদিদের ধর্মবেত্তাদের রচিত ন্যায়শাস্ত্র। তালমূদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইহুদিদের নিকট প্রতিশ্রুত মাসীহর আগমন সন্নিকটে। মাসীহর আগমনের ৩টি শর্ত রয়েছে: ১. ইহুদিদের ইসরায়েলে একত্র হওয়া; ২. ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা; ৩. কিং সোলাইমানি মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা। শর্তসমূহের প্রথম দুটি ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে (যদিও অর্থোডক্স ইহুদিদের অনেকেই এব্যাপারে একমত নয়)। বাকি রয়েছে শুধু থার্ড টেম্পল বা কিং সোলাইমানি মন্দির প্রতিষ্ঠা। ইহুদিরা মনে করেন, এই মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সকল সুযোগ ও ক্ষমতা রয়েছে তবে এসবই যথেষ্ট নয়। কারণ, তারা বিশ্বাস করে, ইহুদিরা এখনো অপবিত্র রয়েছে। একমাত্র নির্ধারিত লাল গাভী (রেড হেইফার) এর মাধ্যমেই তারা পবিত্র হতে পারবে। এই বিশ্বাস ইহুদিদের মধ্যে থাকলেও কট্টর জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত থাকায় ইসরায়েলের রাজনীতিতে তার প্রভাব সুস্পষ্ট। ইহুদিরা যেহেতু অনেক দিন থেকেই আশা করে আসছে এই থার্ড টেম্পল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে, নেতানিয়াহু সরকার ও রাজনীতিবিদরা সেটার বাস্তবায়নে গুরুত্ব দিবে যৌক্তিক কারণেই। তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে নেতানিয়াহুর এক ভাষণে। তাঁর বক্তব্যে কিং সলোমনি মন্দিরের কথা বারবার উঠে এসেছিল। তাছাড়া জেরুজালেমে আল-আকসার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্ধারিত চুক্তির শর্ত উপেক্ষা করে কট্টর ইহুদিরা আল-আকসায় ঘন ঘন অনুপ্রবেশ করছে। উপরন্তু আল-আকসা প্রাঙ্গণে মুসল্লিদের বিভিন্নভাবে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েলি পুলিশ বাহিনী।
প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যেহেতু ইহুদি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন, অধিকাংশ ইহুদিদের সমর্থনে প্রয়োজনে যদি গাজাকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দিতে হয়, মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির তৈরি করতে হয়, তবুও সম্ভবত পিছপা হবেন না। ধর্মবিশ্বাসকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় ইহুদি কট্টর জাতীয়তাবাদ তাকে হয় আরো হিংস্র করে তুলবে অথবা ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত। যদি ধরে নিই তিনি প্রথম পথটিই বেছে নিলেন, আল-আকসায় মুসলিমদের আবেগ ধূলিস্মাৎ করে ইহুদিদের মন্দির তৈরিতে সহায়তা করলেন, তবে আগামী বিশ্ব রাজনীতি ও পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে, কত প্রাণ ঝরে যাবে, এই যুদ্ধ কি গাজা-ইসরায়েলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা তা অনুমান করা যাচ্ছে না।
ভারতের বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠার সাথে ইসলামের নবী-রাসূল ও সাহাবাদের ইতিহাস না জড়িত থাকা সত্ত্বেও, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার আগুন এখনো নেভেনি। সেখানে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ, যার সাথে মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে ঈমানী আবেগ ও ধর্মীয় চেতনার পুরোটা জড়িয়ে রয়েছে। ধর্মবিশ্বাসকে রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারে ব্যবহার না করে যদি শান্তি-সম্প্রীতি ও সহবস্থানে ব্যবহার করা যেত, তবে হয়তো আজকের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল চিত্র পাল্টে যেত।
[লেখক: প্রকৌশলী, কম্পিউটার বিজ্ঞান, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১০০৫০২৫]