আল্লাহর রসুল কোনোদিন প্রতিপক্ষের সঙ্গে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় যান নি। তিনি যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছেন, সন্ধি করেছেন। এই সবই তিনি করেছেন কাফেরদের সঙ্গে। কিন্তু সত্য ও মিথ্যাকে, ঈমান ও কুফরকে, দীন ও তাগুতকে তিনি কোনোদিন মিশ্রিত হতে দেন নি। তার নীতি ছিল, মিথ্যার সাথে কোনো আপস হবে না। কিন্তু ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যে কোনো পন্থা গ্রহণ করতে পারে। মানুষের অজ্ঞতাকে ব্যবহার করে, মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে, কখনও গুজব রটনা করে, কখনও মিথ্যানির্ভর হুজুগকে কাজে লাগিয়ে ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করে অর্থাৎ ছলে বলে কৌশলে যেভাবে পারে উদ্দেশ্য হাসিল করার চেষ্টা করে। এতে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বাছবিচার থাকে না।
রসুলাল্লাহর সমস্ত সংগ্রামের প্রতিপক্ষ ছিল কাফেরগণ। আজকে যারা নির্বাচনকে ‘এ যুগের জেহাদ’ বলে জনগণকে বিশ্বাস করাতে চান তাদের কাছে প্রশ্ন হচ্ছে এই ভোটযুদ্ধ তারা কার বিরুদ্ধে করছেন তাদের ধর্মীয় পরিচয় কী? তারা কি মো’মেন না কাফের এটা আগে সুস্পষ্ট করতে হবে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মো’মেনদের সংগ্রাম নিশ্চয়ই হবে কাফেরের বিরুদ্ধে? সমগ্র পৃথিবীর রাজনৈতিক ইসলামী আন্দোলনগুলো এ ক্ষেত্রে বড় কপটতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। তারা প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের ধর্মীয় পরিচয়টি স্পষ্ট করে না। প্রতিপক্ষ ধর্মীয় মানদণ্ডে হয় মো’মেন হবে নয় তো কাফের হবে, তৃতীয় কোনো পথ খোলা নেই। প্রতিপক্ষ যদি মো’মেন-মুসলিম হয় তাহলে লড়াই হতেই পারে না, তাহলে উভয়েই ভ্রাতৃবিরোধী সংঘাতের দরুন ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। আর যদি কাফের হয় তাহলে কাফেরদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ইসলামের যে নীতিগুলো আছে সেগুলো প্রযুক্ত হবে। মনে মনে তারা সেই প্রতিপক্ষ সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলোকে তাগুত আর কুফরি শক্তি বলেই বিশ্বাস করেন, কিন্তু এ কথা তারা প্রকাশ্যে বলেন না, কারণ ও কথা বললে তো রাজনীতিই করা যাবে না। ক্ষমতার ভাগ পেতে তাদেরকে বিভিন্ন সেক্যুলার দলের লেজুড়বৃত্তি করতে হয়। কাফের বলে দিলে সেটা সম্ভব হবে না। এই লেজুড়বৃত্তিকে জায়েজ করার জন্য তারা মক্কার কাফেরদের সঙ্গে রসুলাল্লাহর করা হোদায়বিয়ার সন্ধির উদাহরণ টেনে আনেন। তারা ভুলে যান যে, সেই সন্ধিটি হয়েছিল কাফেরদের সঙ্গে মো’মেনদের। এখানে হোদায়বিয়ার সন্ধিচুক্তির প্রসঙ্গ টানার অর্থই হচ্ছে অপর পক্ষকে কাফের বলে দাবি করা। এই দাবিটি তারা জনসমক্ষে করতে পারেন না। তারা অন্তরে বিভেদ পুষে রেখে এক জামাতে নামাজ পড়েন। এক জামাতে নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েই একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হন। মক্কার কাফেরদের সঙ্গে মো’মেনগণ কি এক জামাতে নামাজ পড়তেন, একসঙ্গে হজ্ব করতেন? আবার ভিতরে ভিতরে প্রতিপক্ষের নেতৃবৃন্দের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কও তৈরি করেন যেন ক্ষমতার পালাবদলে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন না হয়। বিশেষ বেকায়দায় পড়লে প্রতিপক্ষের দলে যোগদান করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এই ধাপ্পাবাজির রাজনীতিকে ‘ইসলাম’ বলে চালিয়ে দেওয়া আল্লাহ ও রসুলের উপর ন্যাক্কারজনক অপবাদ আরোপ ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং আল্লাহ বলেন, তার চেয়ে বড় জালেম কে যে আল্লাহর উপর অপবাদ আরোপ করে? (আল কোর’আন: সুরা ইউনুস ১৭।) তারা আজ যেটাকে ‘পাক্কা হারাম’ বলছেন কাল সেটাকেই রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ‘হালাল’ বানিয়ে ফেলেন। তাদের দলে অনেক জনপ্রিয় খ্যাতিমান মোফাসসিরে কোর’আন, মুহাদ্দিস, মুফতি ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ থাকেন যারা দলের প্রয়োজনমাফিক শরিয়তের নবতর ব্যাখ্যা হাজির করতে খুব পারদর্শী। তাদের ব্যাখ্যা জনগণ কতটুকু গ্রহণ করে জানি না, তবে দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা সেগুলোকেই ‘ইসলাম’ বলে অন্ধভাবে মেনে নেন।
পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো রাজনৈতিক ইসলামকে এতদিন সহ্য করে এসেছে, সৌদি আরবের মতো ধর্মব্যবসায়ী রাষ্ট্র তাদের সালাফি/ওয়াহাবি মতবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য আধ্যাত্মিকতাহীন কেবল ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চিন্তায় ব্যাপৃত একটি বিকৃত ইসলামকে মদদ দিয়ে এসেছে। অনেকে স্বপ্ন দেখেছে যে এই পথে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হতেও পারে। কিন্তু এক শতাব্দী হয়ে গেল প্রায়, কোথাও কোনো সফলতার দৃষ্টান্ত মিলল না, ফলে রাজনৈতিক ইসলাম তত্ত্ব বা থিওরি হিসাবে কেতাবের পাতায় রয়ে গেল। তাদের দরকার ফুরিয়েছে বলেই পশ্চিমারা নতুন করে জঙ্গিবাদের জন্ম দিয়েছে। ১৬০ কোটি মুসলমানকে কান ধরে উঠ বস করাতে এই জঙ্গিবাদ ইস্যুটিই যথেষ্ট। তাই সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহনকারী আরব দেশগুলো এখন জঙ্গিবাদ বিস্তারে অর্থ ঢালছে। ব্যর্থ হয়ে যাওয়া পলিটিক্যাল ইসলামের অনেক কর্মী সেইসব জঙ্গিদলগুলোয় যোগ দিচ্ছে। সরকারের দমনপীড়নে, মামলা- মোকাদ্দমার চাপে পড়ে অনেকে মরিয়া হয়ে জঙ্গিবাদী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা আরো বড় পথভ্রষ্টতা এবং ইসলামের জন্য আরো বড় ক্ষতিকর পন্থা। ইসলামের সামগ্রিক রূপ সম্পর্কে যাদের সঠিক ধারণা রয়েছে তারা সহজেই এই ভ্রান্তপথগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবেন।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে জঙ্গিবাদও একটি পথভ্রষ্টতা, প্রচলিত রাজনৈতিক ইসলামও একটি পথভ্রষ্টতা। ইসলামের বিজয়প্রত্যাশীরা কেউ এই ভুলপথে পা বাড়াচ্ছে, কেউ অন্য ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। তাদের সবার ধর্মবিশ্বাসই লুটপাট হচ্ছে, অপব্যবহৃত হচ্ছে। তারা না পচ্ছেন দুনিয়া, না পাচ্ছেন আখেরাত। তাদের ধর্মবিশ্বাস মানুষের অকল্যাণে ব্যবহৃত হওয়ার দরুন মানবতার কল্যাণার্থে আগত ইসলামের বদনাম হচ্ছে, আল্লাহ রসুলের বদনাম হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, মানবজীবনে চলমান বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, বাদ-মতবাদের ব্যর্থতার পর ইসলামকে বিকল্প জীবনব্যবস্থারূপে গ্রহণ করার যে সম্ভাবনা ছিল সেটাও সুদূরপরাহত হয়ে যাচ্ছে ধর্মের নামে এসকল অপকর্মের ফলে। পৃথিবীর সর্বত্র একপ্রকার ইসলামভীতি (Islamophobia) চালু করে দেওয়া হচ্ছে।
এখন আমাদের কথা হচ্ছে, যারা ইসলামকে বিজয়ীরূপে দেখতে চান এবং বিশ্ববাসীর সামনে ইসলামকে গ্রহণযোগ্য ও সার্বজনীন আদর্শরূপে উপস্থাপন করতে চান তাদের একটাই করণীয়, তাদের সবাইকে এই সত্যটি স্বীকার করে নিতে হবে যে, আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম ১৩ শ’ বছরে বিকৃত হতে হতে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। পুরো জাতি আল্লাহর তওহীদ থেকে, আল্লাহর হুকুম থেকে বিচ্যুত হয়ে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতার দাসে পরিণত হয়েছে। এখন এ অবস্থা থেকে ফেরার জন্য একেক দল একেকটি পথ নির্মাণ করে নিচ্ছে এবং সেই সব পথের দিকে অন্যদেরকেও আহ্বান করছে। কিন্তু যে মহাসড়ক, যে রাজপথটি রসুল নির্মাণ করে গেছেন সেই রাজপথটি ছিল তওহীদের উপর নির্মিত যার নাম সেরাতুল মোস্তাকীম- সহজ সরল পথ। আজ কেউই সেই পথে উঠছেন না। তারা একেক দল একেকটি রজ্জুকে ধারণ করেছেন কিন্তু ধারণ করতে হবে আল্লাহর রজ্জু, আর সেটা হচ্ছে তওহীদ। তাদের সবাইকে এখন আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, দল-মত-তরিকা-ফেরকা-মাজহাব নির্বিশেষে একটি মহাজাতি গড়ে তুলতে হবে। আর সাধারণ মানুষকেও সেই তওহীদের সঠিক অর্থ কী, দাবি কী, অঙ্গীকার কী সেটা তাদের মাতৃভাষায় বোধগম্য করে বোঝাতে হবে। পাশাপাশি রসুলাল্লাহর রেখে যাওয়া সেই পাঁচ দফা কর্মসূচিকে নিজেদের জীবনে ধারণ করে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জীবন ও সম্পদ উৎসর্গ করতে হবে। তাহলে তারা হবেন মো’মেন, আল্লাহর সাহায্যের অঙ্গীকার তখন তাদের জন্য সত্য হবে। আর যারা আল্লাহ সাহায্য প্রাপ্ত হয় তাদেরকে কেউ পরাভূত করতে পারে না। জনগণ যদি আল্লাহর হুকুমের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে তাদের চাওয়ার প্রতিফলন হিসাবে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে তওহীদভিত্তিক একটি সভ্যতা। সেই সভ্যতার আলোয় মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গন আলোকিত ও সুখী হবে। সেই অনাবিল সুখ ও শান্তির নামই ইসলাম- আক্ষরিক অর্থেই শান্তি।