মাহবুব আলম
সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্বই হচ্ছে মানবজাতির প্রকৃত ইতিহাস। আজও এই সত্য মিথ্যার দ্বন্দ্ব চলছে, পার্থক্য এই যে- অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান দুনিয়ার অবস্থার দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সর্বাঙ্গনেই দেখতে পাই- সত্য এবং মিথ্যা এমনভাবে মিশে গেছে যে- আজকে যেন সত্য কী জিনিস- মানুষ তা চিনতেই পারে না। মিথ্যাটাই আজ সত্যরূপে পরিগণিত হচ্ছে। আমাদের সমাজেও বাকি পৃথিবীর মতই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ক্ষেত্রে মিথ্যা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। রাজনৈতিক মিথ্যা কীভাবে? দুর্নীতি, অন্যায়, জুলুম, স্বৈরাচারী আচরণ, ওয়াদাভঙ্গ করা, জনগণের সম্পদ লুটপাট করা, সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যা ইত্যাদি- এই হলো রাজনৈতিক মিথ্যা।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই মিথ্যাগুলো কীভাবে আসলো?
এই মিথ্যাগুলো রাজনীতিতে একদিনে আসে নি। কারণ মানুষের আত্মিক শূন্যতা যখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে- সেখানে অন্যায় না করার প্রবণতা, দুর্নীতি না করার মতো যে আত্মার শক্তির প্রয়োজন তা কোথাও নেই। সেটা থাকা না থাকার কারণ হলো কোথাও আজ স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব নেই। অর্থাৎ স্রষ্টার দেওয়া দিকনির্দেশনাকে সমষ্টিগত জীবনে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। এটার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেটা হলো মানুষ হাজার হাজার বছর হতে, মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই স্রষ্টার দেওয়া বিধান দিয়েই তাদের জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু ইউরোপে যখন খ্রিষ্টবাদ গ্রহণ করে নেওয়া হলো- তখন এক বিরাট সংকট দেখা দিল। কারণ খ্রিষ্টানধর্মে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য কোনো বিধি-বিধান ছিল না। ঈসা (আ.) এসেছিলেন ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য। কিন্তু ঘটনাক্রমে তা যখন ইহুদি ধর্মের অনুসারীদের আবাসস্থলের বাইরে অর্থাৎ ইউরোপের রাজারা গ্রহণ করে নিল- তখন তারা স্বভাবতই একে তাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রয়োগ করতে চাইলেন। কিন্তু তা-তো আর এই ধর্মে ছিল না। তখন তারা বাধ্য হয়ে নিজেরা রাষ্ট্রের জন্য তাদের নিজ হাতে বিধান তৈরি করে নিলেন। ফলে শুরু হলো চার্চের সাথে, গীর্জার সাথে- রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব এমন একটা চরম আকার ধারণ করল যে- তার প্রভাব জনগণের মধ্যে পড়তে লাগল। পরিণতি সংঘাত, যুদ্ধ এবং রক্তপাত। ফলে ধর্মের ব্যাপারে মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল।
এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, সমাজচিন্তাবিদগণ বসে সিদ্ধান্ত নিলেন যে- যেহেতু ধর্ম রাষ্ট্রের দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ- তাই ধর্মকে ব্যক্তি জীবনের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে রেখে দেওয়া হোক। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আইন তৈরি করা হোক। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের কোনো ভূমিকা থাকতে পারবে না। এর ফলে ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরির রাজত্বজকালে মানুষ সিদ্ধান্ত নিল যে এখন থেকে সামষ্টিক জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের অর্থাৎ স্রষ্টার কোনো ভূমিকা থাকবে না। তারা নিজেরা নিজেদের বিধান তৈরি করে নেবে। এই সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে নতুন একটা সভ্যতা গড়ে উঠল। যে সভ্যতা আজ পাশ্চাত্য বস্তুবাদী, আত্মাহীন, যান্ত্রিক সভ্যতা । এই সভ্যতা দেহ-সর্বস্ব, ভোগ-সর্বস্ব, বস্তু-সর্বস্ব, যেখানে আত্মার কোনো স্থান নেই, আধ্যাত্মিকতার কোনো স্থান নেই।
স্রষ্টা একজন আছেন, এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এটা মানুষ অস্বীকার করতে পারে না। তিনি আমাদের একটা জীবনবিধান দিয়েছেন- সেটাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সুতরাং সামষ্টিক জীবনে দিক নির্দেশনা প্রদান করতে খ্রিষ্ট ধর্মের ব্যর্থতার ফলে ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হতে শুরু হলো মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত বিধান দিয়ে। দীর্ঘদিন থেকে এটা চলল। আর এই সভ্যতা ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে লাগল সারা পৃথিবীময়। আমাদের এই উপমহাদেশেও তাদের সেই ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে আসল। শাসক প্রভুদের প্রভাবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে আমরাও আমাদের মৌলিক যে বিধান ছিল- অর্থাৎ আল্লাহর দেওয়া আইন, কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি আমরা সেটা পরিত্যাগ করলাম। তাদের কাছে পরাজিত হলাম। আমাদের ঐক্যহীনতা, পারস্পরিক হানাহানি, মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়া-ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আমরা তাদের দাসে পরিণত হলাম। তখন তারা আমাদের উপর তাদের তৈরি সেই আত্মাহীন ‘সভ্যতা’কে চাপিয়ে দিল।
তাদের তৈরি জীবন ব্যবস্থা দিয়েই আজ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে- যেখানে স্রষ্টার কোনো স্থান নেই। ফলে সমস্ত ন্যায়ের উৎস, সমস্ত জবাবদিহিতার উৎস, সমস্ত সুন্দরের উৎস যিনি- সেই স্রষ্টা- তাঁর শিক্ষা না থাকলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। অন্যায়- অবিচার- দুর্নীতি- জুলুম- সম্পদ লুট করা। কেউ না খেয়ে মরছে রাস্তায়, তাতে কারো আত্মার সামান্য অনুভুতিও নেই। আবার কেউ কোটি কোটি ডলারের পাহাড় জমাচ্ছেন। এই আত্মাহীন জীবনব্যবস্থা প্রয়োগের ফলে সৃষ্টি হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। সুতরাং এই অসত্য আজ সর্বত্র গ্রাস করে আছে।
পাশাপাশি ধর্মীয় অসত্যও আমাদের গ্রাস করেছে। সেই পাশ্চাত্য সভ্যতাই আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছে তাদের অধিকৃত ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে। এটা ঐতিহাসিক সত্য যে- তারা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করে আমাদের এমন একটা ধর্ম শিক্ষা দিয়েছে যার ফলে ধর্মের সত্য দিকটা আর জন্মলাভ করতে পারে নি। ধর্ম যে মানবতার কল্যাণে, ধর্মের যারা বার্তাবাহক, তারা যে সম্পূর্ণ স্বার্থহীনভাবে, মানবতার কল্যাণে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ ও উৎসর্গ করেছেন, মানবজীবনে শান্তি এনেছেন- এই সত্যদিকটা হারিয়ে গেছে। তাহলে ধর্মের অসত্য দিক আসলো প্রধানত তিনটা।
প্রথমত: ধর্মের নামে ব্যবসা, ধর্মের নামে ব্যবসা কখনো কোন কালেই কোন ধর্মের দ্বারাই স্বীকৃত ছিল না। নবী করিম (সা.) ও তাঁর আসহাবগণ, এমনকি কোন নবী রসুলই কখনো ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করেন নি, জীবিকার উৎস করেন নি। এটা ছিল সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে মানবতার কল্যাণে। এবং পারলৌকিক কল্যাণে। এটা যখন ব্যবসায়ের মাধ্যমে পরিণত হবে তখন এর প্রকৃতরূপ, মৌলিকত্ব আর থাকবে না। সেটা মিথ্যায় পরিণত হবে। ধর্মব্যবসায়ীদের মাধ্যমে একটা সিন্ডিকেট তৈরি হবে। তারা সুবিধা আদায়ের জন্য ধর্মকে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে শুরু করবে।
দ্বিতীয়ত হলো ধর্মের নামে সন্ত্রাস। আজকে যে বোমাবাজী, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, হানাহানি চলছে-এগুলো কোনকালেই ধর্ম দ্বারা সিদ্ধ ছিল না। নবী করিম (সা.) নবুয়্যতের শুরু থেকেই মানুষকে শুধু তওহীদের দিকে আহ্বান করে গেছেন, কলেমার ডাক দিয়ে গেছেন। তিনি ন্যায়ের দিকে, সত্যের দিকে আহ্বান করে গেছেন। তিনি বলেছেন মানুষ যদি এই সত্যকে মেনে নেয় তাহলে তারা পাবে শান্তি, ন্যায় বিচার। দুনিয়াতে তারা হবে সফল এবং পরকালে তারা পাবে মুক্তি। যারা প্রত্যাখ্যান করেছে-তাদেরকে তিনি কিছু বলেন নি। বরং তিনি তাদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তারপরও তিনি ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আঘাত করেন নি। সুতরাং ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ এটাও ধর্মের অসত্যের দিক, অন্ধকার দিক।
তৃতীয়ত: ধর্মের নামে রাজনীতি। আজকে যে ধর্মীয় রাজনীতির নামে মিছিল, মিটিং, জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদি করা হচ্ছে এসব কিন্তু ইসলামে নেই। নবী করিম (সা.) ও তাঁর আসহাবরা তা করেন নি। তিনি শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণভাবে মানুষের নিকট সত্য উপস্থাপন করেছেন। যারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাদেরকে নিয়ে আলাদা একটি সুখময় ও সমৃদ্ধ সমাজ কায়েম করেছেন। ইতিহাসে আমরা তা জানতে পারি। কিন্তু পরে এই অন্ধকার বিষয়গুলো পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে ধর্মে প্রবেশ করেছে। এগুলিও আমদানি হয়েছে ঔপনিবেশিক ষড়যন্ত্রমূলক শিক্ষাব্যবস্থার কারণে। তাই ধর্মের প্রকৃত রূপ, সত্যরূপ আজ হারিয়ে গেছে।
সুতরাং আমাদেরকে আজ ধর্মের সেই সত্য দিকটাকে তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি অসত্য কী, মিথ্যা কী- তাও পরিষ্কার করতে হবে। অসত্য হচ্ছে এই যে স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা না থাকার কারণে, সেখানে আত্মিক শূন্যতা সাংঘাতিক আকার ধারণ করেছে। যে জন্য কোন ন্যায় নীতির বালাই নেই। মানবতার কোন বালাই নেই। আইনেরও কোন বালাই নেই। একটু আইনের মারপ্যাঁচের বাইরে যেতে পারলেই তারা ভোগবিলাস এবং অন্যায়ে নিমজ্জিত হয়ে জঘন্য পশুতে পরিণত হয়ে পড়ে। আজ দুর্ভাগ্যবশত আমরা চরম এক মিথ্যার গহ্বরে পতিত হয়ে গেছি। আসুন আমরা মহান স্রষ্টার দেওয়া সুন্দর এবং সত্যকে উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করি।