আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী মোহাম্মদ (দ.) পর্যন্ত যত নবী ও রসুল পৃথিবীর বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের প্রতি প্রেরণ করেছেন তাদের প্রত্যেকের প্রতি একটি অভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা হল সত্য প্রচার, আরবিতে তাবলিগ। ‘তাবলিগ’ শব্দটি এসেছে ‘বালাগ’ থেকে। নবী ও রসুলগণ প্রত্যেকে তাঁদের স্ব স্ব সম্প্রদায়কে বলেছেন, “আমাদের দায়িত্ব তো কেবলমাত্র সুস্পষ্টভাবে সংবাদ পৌঁছে দেয়া” (সুরা ইয়াসীন ১৭)। এখানে আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন “বালাগুল মুবীন” যার অর্থ সুস্পষ্টভাবে পৌঁছানো। সুতরাং আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন কিছুর সংবাদ পৌঁছে দেওয়াই ছিল নবী-রসুলদের একমাত্র কাজ, কে সেটা গ্রহণ করবে আর কে প্রত্যাখ্যান করবে সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয় নয়, সেটা আল্লাহ এখতিয়ারভুক্ত।
প্রচার হবে কেবল তওহীদের:
প্রশ্ন হল, নবী-রসুলগণ মানুষকে কোন কথাটি পৌঁছে দিতেন? আল্লাহর শেষ রসুলকে (দ.) বলছেন, ‘আপনার পূর্বে আমি যে রসুলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ (সার্বভৌমত্বের মালিক বা হুকুমদাতা) নেই (সুরা আম্বিয়া ২৫)। অর্থাৎ সকল নবী ও রসুলগণের আহ্বান ছিল ‘লা- ইলাহা ইলস্নালস্নাহ’র প্রতি অর্থাৎ তওহীদের প্রতি। তওহীদ হচ্ছে এমন এক ঘোষণা যা শুরু হয় ‘লা’ শব্দ দিয়ে যার অর্থ হচ্ছে অস্বীকার। আল্লাহ ছাড়া জগতের সকল বিধানদাতা, হুকুমদাতা, সার্বভৌম অত্মিত্বকে অস্বীকার করাই হচ্ছে তওহীদ, এটাই এই দীনের ভিত্তি। এই কলেমা দুনিয়ার সকল তাগুত কায়েমী শক্তির মূলে কুঠারাঘাতকারী এক বিপস্নবী ঘোষণা। সংক্ষেপে এর মর্মার্থ হচ্ছে আমি জীবনের প্রতিটি বিষয়ে যেখানেই আলস্নাহ ও তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য আছে সেটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইন-কানুন, দন্ড-বিধি যে বিভাগেই হোক না কেন, সেই ব্যাপারে আমি আর কারও কোন বক্তব্য, নির্দেশ মানি না। যে বিষয়ে আলস্নাহ অথবা তাঁর রসুলের কোন বক্তব্য নেই সে বিষয়ে আমরা স্বাধীনভাবে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। বর্তমান দুনিয়ার কোথাও এই তওহীদ নেই, সর্বত্র আলস্নাহকে কেবল উপাস্য বা মা’বুদ হিসাবে মানা হচ্ছে, কিন্তু ইলাহ বা সার্বভৌমত্বের আসনে আলস্নাহ নেই। মানুষ নিজেই এখন নিজের জীবনব্যবস্থা তৈরী করে সেই মোতাবেক জীবন চালাচ্ছে, মানুষ নিজেই এখন ইলাহ অর্থাৎ বিধাতার আসনে আসীন। আজ মানুষের তৈরী জীবন-ব্যবস্থাগুলিকেই (দীন) মানবজীবনের সকল সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান হিসাবে মনে করা হচ্ছে যদিও সেগুলির সবই মানুষকে শান্তি দিতে চরমভাবে ব্যর্থ। বর্তমান দুনিয়ার সীমাহীন মারামারি, কাটাকাটি, রক্তপাত, অনাচারই এই ব্যবস্থাগুলির ব্যর্থতার যথেষ্ট প্রমাণ।
দীন প্রচারের বিনিময় নেওয়া চলবে না:
মানুষকে আলস্নাহর তওহীদের দিকে আহ্বান করার জন্য কোনরূপ বিনিময় গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । আল্লাহ তাঁর রসুলকে নির্দেশ দেন, তুমি তাদের নিকট কোন মজুরি দাবি করো না (সুরা ইউসুফ-১০৪), বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোন পারিশ্রমিক চাই না (সুরা সাদ-৮৬), নবী-রসুলদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন মজুরি চাই না। (সুরা আনআম-৯০)। মানুষকে তওহীদের দিকে আহ্বান করে প্রত্যেক নবীই বলতেন, আমি তোমাদের কাছে কোন মজুরি চাই না, আমার বিনিময় তো আল্লাহ কাছে (সুরা শুয়ারা-১৮০)।
নির্যাতনের কষ্টিপাথরে সত্যের মূল্যায়ন:
আল্লাহ শেষ রসুল নবুয়ত পেয়ে গোপনে কলেমার প্রচার আরম্ভ করেন। তিন বছর পর আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে প্রকাশ্যে প্রচার করতে হুকুম করেন, ‘আপনার নিকটাআত্মীয়দের সতর্ক করে দিন (সুরা শোয়ারা ২১৪)’। তিনি তখন সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে তাঁর গোত্রের লোকদেরকে ডেকে একত্র করলেন এবং বললেন, ‘হে মানবজাতি! বল, লা ইল্লাল্লাহ আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা নেই, তবেই তোমরা সফল হবে’। সঙ্গে সঙ্গে মক্কার কাফের ও মোশরেকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় শ্রেণিটি তাঁর প্রচ- বিরোধিতা আরম্ভ করল। রসুলাল্লাহ ও তাঁর আসহাবগণের উপরে শুরু হল প্রচ- নির্যাতন, কারণ তারাও আলস্নাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের অনেককে বন্দী করে চাবুক দিয়ে পেটানো হয়েছে, অনেককে জ্বলন্ত অঙ্গারের উপরে শুইয়ে রাখা হয়েছে, গলায় দড়ি বেঁধে প্রত্মরময় প্রাত্মরে টেনে হিঁচড়ে শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। কাউকে সারাদিন ধরে মরুভূমির আগুনঝরা রৌদ্রের পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। নির্যাতন করতে করতে এক পর্যায়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে একজন পুরম্নষ ও একজন নারী আসহাবকে। তারা নির্যাতিত হয়েছেন। এই নির্যাতন ছিল তাদের সত্যতার প্রমাণ। এই চিরন্তন কলেমার ডাক দিয়ে অতীতে যত নবী রসুল এসেছেন তাঁরা এবং তাঁদের উম্মাহ এমনই কঠিন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আজও কেউ যদি এই কলেমার দিকে, আল্লাহর প্রকৃত তওহীদের দিকে মানুষকে আহ্বান করে, সেই একই নির্যাতনের শিকার হবে।
ইসলামের আহ্বান কাদের প্রতি:
মক্কার ১৩ বছরের জীবনে রসুলাল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীরা কাফের মোশরেকদেরকে সালাহ, সওম ইত্যাদি কোন আমলের দিকে আহ্বান করেন নি, তারা আহ্বান করেছেন কেবলমাত্র কলেমার দিকে, তওহীদের দিকে। অনেকে মনে করেন মক্কার সেই কাফেরদের আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর একত্বের প্রতি ঈমান ছিল না। এ ধারণাটি সঠিক নয়। সেই মোশরেকরাও আল্লাহর একত্বে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানত না অর্থাৎ তারা আলস্না আনুগত্য করত না। তখনকার আরবরা বিশ্বাস করত যে তারা আল্লাহর নবী ইব্রাহীমের (আ.) উম্মাহ। তারা আল্লাহর সৃষ্টিকর্তা বলে, পালনকারী বলে বিশ্বাস করত, নামাজ পড়ত, কাবা শরীফকে আলস্নাহর ঘর বলে বিশ্বাস করত, ঐ কাবাকে কেন্দ্র করে বাৎসরিক হজ্ব করত, কোরবানী করত, রোযা রাখত, আল্লাহর নামে কসম করত, এমনকি খাত্নাও করত। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে শাদীর কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আমরা যেমন ‘বিসমিল্লাহ’ লেখি তেমনি তারাও আল্লাহ নাম লিখত। আরবের মোশরেকরা যে আমাদের মতই আল্লাহ বিশ্বাসী ছিল এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছেন স্বয়ং আলস্নাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বলছেন- তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (সুরা যুখরুফ- ৯)। অন্যত্র বলেছেন- তুমি যদি তাদের প্রশ্ন করো আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছেন এবং কে সূর্য ও চন্দ্রকে তাদের (কর্তব্য কাজে) নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণ করছেন, তবে তারা নিশ্চয়ই জবাব দেবে- আল্লাহ (সুরা আনকাবুত- ৬১)।
এমন আরও অনেকগুলি আয়াত এবং ইতিহাস থেকে দেখা যায় সেই মোশরেকদের আলস্নাহর অত্বিক ও একত্বের ওপর ঈমান ছিল। তারা মূর্তিপূজা করত ঠিকই কিন্তু ওগুলোকে তারা স্রষ্টা বলে মানত না। তারা বিশ্বাস করত যে ঐ দেব-দেবীকে মানবে, ওগুলোর পূজা করবে তাদের জন্য ঐ দেব-দেবীরা আলস্নাহর কাছেই সুপারিশ করবে (সুরা ইউনুস- ১৮, সুরা যুমার ৩)। এত ঈমান সত্ত্বেও তারা কাফের ছিল কারণ তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। যেহেতু তারা আল্লাহ প্রদত্ত হুকুম মানত না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতই আলস্নাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল। ঠিক আজকেও আল্লাহর প্রতি আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস থাকলেও আল্লাহর হুকুম, আইন, বিধান অমান্য করার ফলে আমাদের সমসাময়িক পৃথিবীও চরম অন্যায় ও অশান্তির পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এই অশান্তির থেকে মুক্তির জন্য মানুষ অনেক গবেষণা করে নতুন নতুন পথ আবিষ্কার করছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৈরী করছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, দিন দিন অশান্তি আরও বাড়ছে। এখন সময় এসেছে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার যে, মানবজাতির এই বর্তমান সঙ্কট ও আসন্ন বিপর্যয় থেকে মুক্তির সমাধান কেবল তিনিই দিতে পারেন যিনি এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, এই মানবজাতিকেও সৃষ্টি করেছেন। কিসে মানবজাতি শান্তিতে থাকবে তা আল্লাহর চেয়ে বেশি আর কে জানবে? সুতরাং এখন আবার অনিবার্য হয়ে পড়েছে প্রকৃত তওহীদের প্রচার করা। আসুন কলেমার বাণীকে কেবল যিকিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আল্লাহর একমাত্র ইলাহ হিসাবে মেনে নিই এবং মানবজাতির মধ্য থেকে সর্বপ্রকার অন্যায় অশান্তি অবিচার লুপ্ত করে পৃথিবীকে একটি শান্তিময় জান্নাতের বাগানে পরিণত করি।