রাকিব আল হাসান
ঈদুল ফেতর, মুসলিমদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি। রমজান মাসের পরিসমাপ্তি এবং ঈদের বার্তা জানাতে যখন পশ্চিম আকাশে শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ উঁকি দেয় তখন থেকেই যেন চারিদিকে উৎসবের সুর ধ্বনিত হয়। তবে কেনাকাটার ধুম বাধে রমজানের প্রথম থেকেই। সেদিক থেকে বলা যায় রমজানের প্রথমেই বিত্তবান লোকদের ঈদ শুরু হয়ে যায়। তবে দরিদ্র ব্যক্তিদের ঈদের স্থায়িত্ব এক দিন বা তারও কম। যাই হোক, ঈদ উদযাপন করার ক্ষেত্রে আমাদের আগে জানা দরকার রসুলাল্লাহ (সা.) কখন ও কীভাবে ঈদ উদযাপন করেছেন।
রসুলাল্লাহ (সা.) এর ঈদ উদযাপন:
বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ গ্রন্থে ইবনে জারীর (রা.) এর বর্ণনা মতে, দ্বিতীয় হেজরিতে রসুলাল্লাহ (সা.) প্রথম ঈদ পালন করেছেন। মক্কার ১৩ বছর তিনি কোনো ঈদ পালন করেননি। কারণ ঈদ হলো মুসলমানদের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপনের পাশাপাশি সমগ্র জাতি একসাথে আনন্দ, উৎসব করার দিন। আর হেদায়াহ ও সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত না থাকলে, সমাজে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত না থাকলে মুসলিম জাতির আনন্দ করা নিরর্থক হবে।
রসুলাল্লাহ (সা.) নব্যুয়তের ত্রয়োদশ বছরে আল্লাহর হুকুম অনুসারে মক্কা থেকে হেজরত করে মদীনাতে চলে যান। মদীনার মানুষ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে ও নেতা হিসাবে মেনে নেয়। তখন রসুলাল্লাহ (সা.) সেখানে মদীনা সনদের মাধ্যমে মদীনার অধিবাসীদের পরিচালনা করতে থাকেন। রসুলাল্লাহ (সা.) সেখানে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাম্য, সুবিচার, শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেন। ইসলামী সমাজের ছোট্ট মডেল হয়ে উঠল মদীনা। একটা নতুন সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হলো। এর পূর্বে মক্কাতে মুসলিমদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। সেখানে রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর আসহাবদের উপর যুলুম, নির্যাতন, অপমান, লাঞ্ছনা এমনকি হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্র ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কাজেই মদীনাতে এসে রসুলাল্লাহ (সা.) এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা ছিল ইসলামের জন্য বিরাট বিজয়, মুসলমানদের জন্য মহা-সাফল্য, উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য এক মহা আনন্দের বিষয়।
এই বিজয়ের পর রসুলাল্লাহ (সা.) দেখলেন, সেখানকার লোকজন দু’টি দিনকে উদযাপন করে খেলাধূলা ও বিভিন্ন জাহেলী প্রথার মধ্য দিয়ে। রসুলাল্লাহ (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, এ দুদিনের কী তাৎপর্য আছে? তারা বললো, আমরা জাহেলি যুগে এ দু’দিনে খেলাধুলা করতাম। তখন তিনি বললেন, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দু’দিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ দু’টো দিন দিয়েছেন। তা হলো ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর (সুনানে আবু দাউদ: ১১৩৪)।
জাহেলি যুগের অধিকাংশ প্রথার মধ্যে ছিল অশ্লীলতা যেমন গায়িকাদের অশ্লীল নৃত্য ও গান, ব্যভিচার, অশ্লীল কাব্যচর্চা, অন্ধত্ব, মদ্যপান, অনর্থক কর্মকাণ্ড, অপচয়, জুয়া খেলা ইত্যাদি। রসুলাল্লাহ (সা.) মো’মেন-মুসলিমদের জন্য এমন দু’টো দিন ঠিক করলেন যে দিনগুলোতে পুরো জাতি হাসি-আনন্দ, সাজ-সজ্জা, খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি করবে। পাশাপাশি আল্লাহর গুণগান ও শুকরিয়া জ্ঞাপন, তাঁর জিকির, ক্ষমা প্রার্থনা, নারী-পুরুষ সকলে ঈদগাহে গিয়ে জাতির এমামের দিকনির্দেশনামূলক খুতবা শুনবে। সারাদিন তারা প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর নেবে, ইয়াতিম ও দরিদ্রদের সাহায্য করবে, জনকল্যাণমূলক কাজে দান করবে, অতিথি আপ্যায়ন করবে, কারো সাথে মনোমালিন্য, ন্যূনতম অনৈক্য সৃষ্টি হয়ে থাকলে তা মিটমাট করে নেবে ইত্যাদি। অর্থাৎ উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য ঈদ শুধুমাত্র উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না বরং এর আসল উদ্দেশ্য হয়ে উঠল উম্মার মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠা।
ঈদ উদযাপনে নারী ও পুরুষ উভয়কে রসুলাল্লাহ (সা.) সামিল করেছেন। রসুলাল্লাহ (সা.) ঈদের দিনে বের হয়ে দু’রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। (সহীহ বুখারি- ৯৮৯)। শুধু ছেলেরা নয়, ঈদের জামাতে মেয়েদের শামিল করানোর ব্যাপারেও রসুলাল্লাহ (সা.) জোর তাগিদ দিয়েছেন। উম্মে আতিয়া (রা.) বলেন, “আমাদেরকে রসুলাল্লাহ (সা.) আদেশ করেছেন আমরা যেন মহিলাদেরকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজের জন্যে বের করে দেই; পরিণত বয়স্কা, ঋতুবতী ও গৃহবাসিনীসহ সকলকেই। ঋতুবতী নারীরা ঈদগাহে উপস্থিত হয়ে সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে তবে কল্যাণ ও মুসলিমদের দোয়া প্রত্য¶ করতে অংশ নেবে। তিনি আরো বলেন, আমরা জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রসুল! আমাদের মাঝে কারো কারো ওড়না নেই। রসুলাল্লাহ (সা.) বললেন, “সে তার অন্য বোন থেকে ওড়না নিয়ে পরিধান করবে।” (সহীহ মুসলিম- ২০৯৩)। রসুলাল্লাহ (সা.) ঈদের দিনে সকলের খোঁজ-খবর নিতেন। তিনি ঈদগাহে যে পথে যেতেন সেই পথে না ফিরে অন্য পথে ফিরতেন। (সহীহ বুখারী- ৯৮৬)। যেন তিনি বেশি লোকের খোঁজখবর নিতে পারেন।
ঈদের আনন্দে সঙ্গীতেরও অনুমতি দিয়েছেন রসুলাল্লাহ (সা.)। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, “রসুলাল্লাহ (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দু’টি ছোট মেয়ে গান গাচ্ছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁর কথা শুনে বললেন, মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।” (সহীহ বুখারি- ৯৫২)।
হাদিসে এসেছে, রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে, দেখা-সা¶াৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে মনোমালিন্য দূর করার জন্য প্রথম সালাম দেয়।” (সহীহ মুসলিম- ৬৬৯৭)। এ জন্য রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর আসহাবদের যুগে ঈদ আসলে তারা চেষ্টা করতেন সকল মনোমালিন্য দূর করে দিতে। এ জন্য তারা একসাথে আনন্দ উপভোগ করতেন, একে অপরকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন।
আমাদের ঈদ উদযাপনের বাস্তবতা:
একটা জাতি কখন আনন্দিত হতে পারে? যখন তারা জাতিগতভাবে বিশেষ কিছু অর্জন করে, কোনো ল¶্য সম্পূর্ণ অথবা আংশিকভাবে পূরণ করে তখন ঐ জাতির প্রত্যেকেই অত্যন্ত আনন্দিত হয়। তখন তারা উৎসব করে এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। কিন্তু কোনো জাতি যদি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পরাজিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত, নিষ্পেষিত হতে থাকে, সেই জাতির অন্তত জাতিগতভাবে লাঞ্ছনার জীবনের অবসান না হওয়া পর্যন্ত আনন্দ উৎসব করা যুক্তিযুক্ত হবে কি? যাদের বিন্দুমাত্র কোনো প্রাপ্তি নেই, জাতিগতভাবে অপমান আর লাঞ্ছনা যাদের নিত্যসঙ্গী তাদের আনন্দ উৎসব করার ইচ্ছা জাগে কী করে? অবশ্য যাদের অপমানবোধই নেই তাদের কথা ভিন্ন।
রসুলাল্লাহ মক্কার ১৩ বছরে ঈদ উদযাপন করেন নাই। তিনি সর্বপ্রথম ঈদ উদযাপন করেন দ্বিতীয় হেজরী অর্থাৎ সমাজে আল্লাহর হুকুমত, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পর। কারণ তখন মদীনায় ইসলামের বিজয়কেতন উড়ছে, ইসলামের যে ল¶্য, যে উদ্দেশ্য সমস্ত পৃথিবীব্যাপী আল্লাহর সত্যদীন তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করে শান্তি আনয়ন তা বাস্তবায়িত হওয়া শুরু হয়েছিল এবং রসুলাল্লাহর ওফাতের পর ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।
এরপর জাতি তার আকিদা, উদ্দেশ্য ভুলে গেল, তারা ভুলে গেল তাদের কেন সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু ততোদিনে তারা অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থ-সম্পদে সকল দিক দিয়ে সর্বোচ্চ আসনে আসীন। শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে তারা পরবর্তী প্রায় সাত/আটশ’ বছর পর্যন্ত ছিল তবে বিভিন্ন দিক দিয়ে তাদের পরাজয়, অধঃপতন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখন পর্যন্তও তাদের জন্য ঈদ উদযাপন যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু যখন থেকে তারা ইউরোপীয় শক্তির দাসে পরিণত হলো, জাতিগতভাবে পরাজয়, অপমান, লাঞ্ছনা যখন পিছু নিল তখন থেকে আর ঈদ উদযাপন যুক্তিযুক্ত রইল না।
বর্তমানেও পৃথিবীর কোথাও আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই, অধিকাংশ জায়গাতে মুসলিম নামক এই জাতি অন্য জাতির হাতে মার খাচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, পরাজিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। তাদের একটার পর একটা ভূখণ্ড ধ্বংস ও দখল করে নিচ্ছে অন্য জাতি, দুর্ভিক্ষে পতিত হয়ে মারা যাচ্ছে, সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান আজও উদ্বাস্তু। তার উপর আবার তারা নিজেরা নিজেরাও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে, শিয়া-সুন্নি, ফেরকা-মাজহাব, দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে মারামারি করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জাতির মধ্যে কোনো ঐক্যচিন্তা নেই। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে তো জাতি একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
কাজেই আমাদের উচিত হবে রসুলাল্লাহ (সা.) এর ঈদ উদযাপন ও এর লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া। ঈদ যেন আমাদের মধ্যে মাজহাব ফেরকা, দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতিগত ঐক্যচেতনা সৃষ্টি করে, আমীন॥