মক্কা বিজয়ের পর ক্বাবা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে রসুলাল্লাহ দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। ঘোষণাটি নিুরূপ-
হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে হেদায়াত (পথ নির্দেশ) করছি যে, সেবকদের সাথে ভালো ব্যবহার করো। তাদেরকে কষ্ট দিও না। তোমরা কি অবগত নও যে, তাদের কাছেও এমন এক হৃদয় রয়েছে যা কষ্ট পেলে ব্যথিত হয় এবং আরামে খুশী হয়? তোমাদের কী হলো যে, তোমরা তাদের হৃদয়ের সন্তুষ্টি বিধান করো না? আমি লক্ষ্য করছি, তোমরা তাদেরকে হীন মনে করো এবং তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করো না। এটা কী? এটা কি জাহেলিয়াতের অহঙ্কার নয়? নিঃসন্দেহে এটা যুলুম ও অবিচার।
আমি জানি, জাহেলিয়াতের যুগে তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না। পশুর চেয়েও তাদেরকে অধম মনে করা হতো। সর্বত্র আমীর ও গোত্র-সর্দাররা সম্মান ও কর্তৃত্বের মালিক সেজে বসেছিল। আল্লাহর বান্দারা এ কথা ভুলে গিয়েছিল যে, মানুষ হিসাবে সবাই সমান এবং তোমাদের খেদমত-কারীরাও ইনসাফের অধিকারী। সেটা ছিল এমন এক যুগ, যখন আমীর ওমরাহ এবং শাসকবর্গ তাদেরকে মানবীয় স্তরের ঊর্ধ্বে মনে করত। নিজেদেরকে নিষ্পাপ ঘোষণা করত। তাদের দৃষ্টিতে খাদেমদের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল শুধুমাত্র মনিবদের খেদমত করা এবং তাদের যুলুম সহ্য করা। মনিবদের সাথে কাজের লোকদের বসা নিষিদ্ধ ছিল। তাদের সামনে খাদেমদের কথা বলা পাপ ছিল। মনিবদের কোনো কাজের সামান্যতম বিরুদ্ধাচারণ হত্যাযোগ্য অপরাধ ছিল। ইসলাম এ ধরনের রসম-রেওয়াজের অবসান ঘটিয়েছে এবং জাহেলি অহঙ্কারকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে অবহিত করছি যে, তোমাদের রবের ফরমান হচ্ছে:
‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।’ (সুরা হুজরাত ১৩)
তোমরা জানো যে, সকল মানুষই আদমের সন্তান এবং আদম মাটির তৈরি। তাহলে অহঙ্কারের হেতু কী? মনে রাখবে, ইসলামের দৃষ্টিতে মানবতার ঊর্ধ্বে কোনো মর্যাদা নেই এবং মনিব-কাজের লোক, উচ্চ-নীচু, ধনী-গরিব সবাই সমান। ইসলামের দৃষ্টিতে যে জিনিস বৈশিষ্ট্যের দাবি করতে পারে তা হচ্ছে তাকওয়া (আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্পর্কে সতর্কতা) ও আমলে সালেহ (দীন প্রতিষ্ঠার কাজ)। এটাই যখন বাস্তব তখন কেন তোমরা তোমাদের কাজের লোকদেরকে নীচ মনে করো? আমি লক্ষ্য করেছি যে, মনিবের সাথে কোনো গোলাম কথা বলতে চাইলে রাগে মনিবের চেহারা হিংস্র প্রাণীর মতো রক্তলোলুপ হয়ে যায় এবং সে কোনোভাবেই তার ক্রোধ দমন করতে পারে না। এটা জাহেলিয়াত ছাড়া আর কী হতে পারে? এমন হতে পারে, কাজের লোক তার মনিবের চেয়ে উত্তম এবং তার আমলও আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য।
হে মানুষ! যখন হুকুমত ছিল জাহেলিয়াতের এবং নফসের পূজা তার চূড়ান্ত প্রভাব বিস্তার করেছিল মানুষের উপর, তখন যে কি মর্মান্তিক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা মানবতার দৃষ্টি কখনও ভুলতে পারে না। আমি সে যুগও দেখেছি, যখন দাসদের সাথে বর্বর আচরণ ও জুলুম করা হতো। মহাপবিত্র আল্লাহ তাদের উপর রহম করেছেন, তাদের অধিকার প্রকাশ করে দিয়েছেন এবং তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করার হেদায়াত করেছেন। আমি আমার রবের ফরমান মোতাবেক বলছি যে, তোমরা তাদেরকে নিজেদের ভাই মনে করো। তাদের কাছ থেকে এতটুকু কাজ আদায় করো যতটুকু তারা সহজে করতে পারে। তোমরা যা খাও তাদেরকে তা খেতে দাও। তোমরা যা পরো তাই তাদেরকে পরতে দাও। তাদের সাথে এরূপ ব্যবহার করো যেরূপ তোমরা আপনজনের সাথে করে থাকো, তাদের জন্য তা পছন্দ করো যা তোমরা নিজেদের জন্য করো। তাদেরকে নীচ ও তুচ্ছ মনে করো না। তোমরা যখন সফরে যাও আর তারাও তোমাদের সঙ্গে থাকে, তখন তাদের আরামের প্রতিও খেয়াল রেখ। তোমাদের সাথে সওয়ারী থাকলে কিছুক্ষণ তোমরা আরোহণ করো এবং কিছুক্ষণ তাদেরকেও আরোহণের অনুমতি দিও। মানুষ হিসেবে তারা কোনো অংশেই তোমাদের চেয়ে ছোট নয়। যেরূপ হৃদয় তোমাদের রয়েছে; সেরূপ তাদেরও রয়েছে। তোমরা কি লক্ষ্য করো নি যে, আমি যায়েদকে আযাদ করে আমার ফুফাতো বোনের সাথে তার বিয়ে দিয়েছি এবং বেলালকে মু’আযযিন নিযুক্ত করেছি এজন্য যে তারা আমার ভাই। তোমরা দেখেছ যে আনাস আমার কাছে থাকে, তাকে আমি ছোট মনে করি না। কোনো কাজ না করলেও আমি তাকে বলি না যে কেন তুমি তা করো নি। ঘটনাক্রমে তার দ্বারা কোনো ক্ষতি হয়ে গেলেও আমি তাকে কোনো ভর্ৎসনা করি না। আমি তোমাদেরকে নসিহত করছি যে, তোমাদের কোনো খাদেম যখন খাবার নিয়ে আসে তখন তাকেও তোমাদের সাথে বসানো উচিত। তারা যদি একসঙ্গে বসতে পছন্দ না করে, তাহলে তাদেরকে কিছু খাবার দিয়ে দেয়া উচিত। তোমাদের কোনো সেবক অপরাধ করে থাকলে সত্তরবার তাকে মাফ করবেÑএ জন্য যে, তুমি যাঁর গোলাম, তিনি তোমার অপরাধ হাজার বার মাফ করে দেন। মনে রেখ, কোনো লোক তার গোলামের প্রতি অন্যায় অপবাদ আরোপ করলে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন। আমি পুনরায় তোমাদেরকে বলছি, তোমাদের সেবক তোমাদের ভাই। তারা বাধ্য হয়ে তোমাদের অধীন হয়েছে। তাই যার ভাই তার নিজের অধীন, তার উচিত- সে নিজে যা খায় তা-ই তাকে খেতে দেয়া, নিজে যা পরে তা-ই তাকে পরতে দেয়া এবং সাধ্যের বাইরে তার কাছ থেকে কোনো কাজ আদায় না করা। সালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতাল্লাহ।