হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

যে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নেই

মোহাম্মদ আসাদ আলী:
মুমিন, মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদীর সর্বশ্রেষ্ঠ যে দায়িত্ব, অর্থাৎ দীনুল ইসলাম, দীনুল কাইয়্যেমাকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে ইবলিসের চ্যালঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করার সংগ্রাম তা ভুলে গিয়ে উম্মাহর সৃষ্টির প্রায় ৬০/৭০ বছর পর জাতি দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পরিবর্তে রাজা বাদশাহর মতো রাজত্ব করতে শুরু করে। এ ব্যাপারেই রসুলাল্লাহ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তাঁর উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর। এই সংগ্রাম যখন আরম্ভ হয়েছিল তখন উম্মতে মোহাম্মদীর মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখেরও কম। কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, পৃথিবীর দরিদ্রতম জাতিগুলির অন্যতম, যুদ্ধের সাজ সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র নিুতম প্রয়োজনের চেয়েও কম। আর প্রতিপক্ষ তদানীন্তন পৃথিবীর দুই মহাশক্তি, জনসংখ্যায়, সম্পদে, সুশিক্ষিত সৈন্যের সংখ্যায়, অস্ত্র ও সরঞ্জামে এক কথায় কোনদিক দিয়েই তুলনা চলে না। আর ৬০/৭০ বছর পর যখন এ সংগ্রাম বন্ধ করা হলো তখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টো। এই নিঃস্ব জাতি আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত আর উত্তরে উরাল পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের তীর পর্যন্ত বিশাল এলাকার শাসনকর্তা। তখন আর নিঃস্ব নয়, তখন সম্পদে, সামরিক শক্তিতে, জনবলে প্রচণ্ড শক্তিধর পৃথিবীর কোন শক্তির সাহস নেই এই জাতির মোকাবেলা করার। অর্থাৎ প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী যারা নিঃসংশয়ে জানতেন তাদের নেতার (সা.) জীবনের উদ্দেশ্য কী ছিল এবং তাদের নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্যই বা কী তারা ডাইনে- বামে কোনও দিকে না চেয়ে একাগ্র লক্ষ্যে (হানিফ) সেই উদ্দেশ্য অর্জনে পার্থিব সব কিছু কোরবান করে পৃথিবীতে বের হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্র“তি মোতাবেক তাদের সঙ্গে ছিলেন। আর স্বয়ং আল্লাহ যাদের সাথে তারা কেমন করে বিফল হবে, কেমন করে পরাজিত হবে? তাই মানব ইতিহাসে দেখি এক অবিশ্বাস্য অধ্যায়। অজ্ঞাত, উপেক্ষিত ছোট্ট একটি নিঃস্ব জাতি অল্প সময়ের (৬০/৭০ বছর) মধ্যে মহাপরাক্রমশালী দুইটি বিশ্ব শক্তিকে পরাজিত করে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীতে ন্যায় বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করল। অতঃপর দুর্ভাগ্যবশতঃ মুমিন মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদীর সর্বশ্রেষ্ঠ যে দায়িত্ব, অর্থাৎ এই দীনুল ইসলাম, দীনুল কাইয়্যেমাকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে ইবলিসের চ্যালঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করার সংগ্রাম, উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যখন এই জাতি বন্ধ করল, ঠিক তখনকার পরিস্থিতি এই রকম।
ক) পৃথিবীর দুইটি বিশ্ব শক্তিকে উম্মতে মোহাম্মদী সশস্ত্র সংগ্রামে পরাজিত করেছে।
খ) একটি (পারস্য) এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে স্বীকার ও গ্রহণ করে এই জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে ও অন্যটি (পূর্ব রোমান অর্থাৎ বাইজেনটাইন) তার সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ হারিয়ে শক্তিহীন ও দুর্বল হয়ে গেছে। খ্রিষ্টান শক্তি বলতে তখন ইউরোপের ছোট ছোট কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছু নেই।
গ) উম্মতে মোহাম্মদী যদি তখন তাদের উদ্দেশ্য ভুলে না যেতো তবে পৃথিবীময় এই শেষ জীবন- ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠায় আর কোন বড় বাধা ছিল না। থাকলেও তা ঐ দুই বিশ্বশক্তির মতোই পরাজিত হতো। সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠিত হতো, আল্লাহ তার শেষ রসুলকে (সা.) যে দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন’ (কোর’আন-সুরা আল ফাতাহ ২৮, আত তওবা ৩৩, আস্ সাফ ৯) তা পূর্ণ হতো, পৃথিবী থেকে অন্যায়- অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাত বন্ধ হয়ে পূর্ণ শান্তিতে মানব জাতি বাস করতে পারতো, মালায়েকদের আশঙ্কা মিথ্যা হতো, ইবলিসের মাথা নত হয়ে যেতো, বিশ্বনবীকে আল্লাহর দেয়া রহমাতাল্লেল আলামীন উপাধির অর্থ পূর্ণ হতো।
কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ত্যাগ করলেও যেহেতু তারা এই শেষ জীবন- ব্যবস্থা, দীনের উপরই মোটামুটি কায়েম রইলো তাই এর সুফলও তারা লাভ করল। কোর’আনের ও হাদীসের নির্দেশ মোতাবেক শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার ফলে জাতি আইন শৃঙ্খলা রক্ষা ও সম্পদ বিতরণে অপূর্ব সাফল্য লাভ করল, আল্লাহ ও রসুলের (সা.) জ্ঞান আহরণের আদেশ উৎসাহ ভরে পালন করে অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে উপবিষ্ট হলো। যে সময়টার কথা আমি বলছি অর্থাৎ জাতি হিসাবে সংগ্রাম ত্যাগ করে উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে পতিত হওয়া থেকে কয়েকশ’ বছর পর ইউরোপের বিভিন্ন জাতির পদানত ও গোলামে পরিণত হওয়া পর্যন্ত এই যে সময়টা, এই সময়টা পার্থিব হিসাবে অর্থাৎ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ইত্যাদিতে এক কথায় উন্নতি ও প্রগতি বলতে যা বোঝায় তাতে এই জাতি পৃথিবীর সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রইলো। শেষ নবীর (সা.) মাধ্যমে শেষ জীবন- ব্যবস্থা মোটামুটি নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করার অনিবার্য ফল হিসাবে এই জাতি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হলো যে, তদানীন্তন বিশ্ব সভয়ে ও সসম্ভ্রমে এই জাতির সামনে নতজানু হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে এই জাতির সাফল্য, কীর্তি, বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন, গবেষণা, পৃথিবীর অজানা স্থানে অভিযান ইত্যাদি প্রতি বিষয়ে যে সাফল্য লাভ করেছিল তার বিবরণ এখানে দেওয়ার স্থান নেই এবং প্রয়োজনও নেই। এ ব্যাপারে বহু বই কিতাব লেখা হয়ে গেছে। এই সময় টাকেই বলা হয় ইসলামের স্বর্ণযুগ।
কিন্তু এত কিছুতেও কোন লাভ নেই- কারণ আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলে বাকি আর যা কিছু থাকে সবই অর্থহীন। এ সত্য রসুলাল্লাহর (সা.) ঘনিষ্ঠ সহচর এই জাতির প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) জানতেন। তাই খলিফা নির্বাচিত হয়ে তার প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্বোধন করে বলেছিলেন- হে মুসলিম জাতি! তোমরা কখনই সংগ্রাম (জিহাদ) ত্যাগ করোনা। যে জাতি জিহাদ ত্যাগ করে- আল্লাহ সে জাতিকে অপদস্থ, অপমানিত না করে ছাড়েন না। আবু বকর (রা.) এ কথা তার প্রথম বক্তৃতাতেই কেন বলেছিলেন? তিনি বিশ্বনবীর (সা.) ঘনিষ্ঠতম সাহাবাদের একজন হিসাবে এই দীনের প্রকৃত মর্মবাণী, হকিকত তার নেতার কাছ থেকে জেনেছিলেন। বিশ্বনবীর কাছ থেকে জানা ছাড়াও আবু বকর (রা.) আল্লাহর দেয়া সতর্কবাণীও কোর’আনে নিশ্চয়ই পড়েছিলেন যেখানে আল্লাহ এই মুমিন জাতি ও উম্মতে মোহাম্মদীকে লক্ষ্য করে বলছেন- যদি তোমরা (জিহাদের) অভিযানে বের না হও তবে তোমাদের কঠিন শাস্তি (আযাব) দেবো এবং তোমাদের বদলে (তোমাদের পরিত্যাগ করে) অন্য জাতিকে মনোনীত করবো (কোর’আন- সুরা আত তওবা ৩৮)। এই জাতি যে একদিন তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যাবে, সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে দেবে ফলে আল্লাহর গযবে পতিত হবে তাও বোধহয় তিনি তার প্রিয় নেতার (সা.) কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন। তাই খলিফার দায়িত্ব হাতে নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম সেই সম্বন্ধেই জাতিকে সতর্ক করে দিলেন। শুধু আবু বকর (রা.) নয়, তারপর ওমর (রা.), ওসমান (রা.) এবং আলী (রা.) ও যে ঐ মর্মবাণী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন তার প্রমাণ এই যে, তাদের সময়েও এই শেষ জীবন- ব্যবস্থাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদা তো নয়ই এমনকি মহানবীর (সা.) একজন মাত্র সাহাবাও কোনদিন এই সংগ্রামের বিরতির জন্য একটিমাত্র কথা বলেছেন বলে ইতিহাসে প্রমাণ নেই। বরং প্রতিটি সাহাবা তাদের পার্থিব সব কিছু কোরবান করে স্ত্রী পুত্রকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে বছরের পর বছর আরব থেকে বহু দূরে অজানা অচেনা দেশে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আবু বকরের (রা.) মতো তারাও জানতেন যে, এই সংগ্রাম বিশ্বনবীর (সা.) উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব, যা তাঁর উম্মাহ হিসাবে তাদের উপর এসে পড়েছে। তারা জানতেন এ সংগ্রাম ত্যাগ করার অর্থ উম্মতে মোহাম্মদীর গণ্ডি থেকে তাদের বহিষ্কার, আল্লাহর রোষাণলে পতিত হওয়া ও পরিণামে আল্লাহর শত্র“দের হাতে পরাজিত, অপমান, অপছন্দ ও লাঞ্ছনা, যা আবু বকর (রা.) বলেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক জাতি সেই কাজটিই করল। তারা জাতির মধ্যে সৃষ্ট আলেম-পণ্ডিতদের দীনের অতি-বিশ্লেষণের কারণে বিভিন্ন মাজহাব ও ফেরকায় বিভক্ত হয়ে গেল এবং সুফি-দরবেশদের বিকৃত তাসাউফের অনুসরণ করে বহিঃর্মুখী, বিস্ফোরণমুখী চরিত্র হারিয়ে অন্তর্মুখী হয়ে গেল। ফলে তারা হয়ে গেল ইউরোপীয় খ্রিষ্টান জাতিগুলির গোলাম। আজ পর্যন্ত তারা তাদের গোলামই রয়েছে। এই জাতি বর্তমানে না মো’মেন, না মুসলিম, না উম্মতে মোহাম্মদী।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...