এই পৃথিবী অপরূপ সুন্দর। পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, নদী, নালা, পাহাড় সমস্ত কিছুকে মহান আল্লাহ নিজ পরিকল্পনায় সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন মানুষের জন্য। জন্ম থেকে মানুষ তার চাহিদা অনুযায়ী এই পৃথিবীকে উপভোগ করতে থাকে এবং একপর্যায়ে তাদের ভাবে ভঙ্গিতে মনে হয় যেন এটাই তার জীবন, এটাই তার সবকিছু। কিন্তু তার এই চেতনাকে ভুল প্রমাণ করে একদিন তাকে চলে যেতে হয় এই পৃথিবী ছেড়ে। ‘প্রত্যেক আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে’- এটাই সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম। আর মৃত্যুর পরেই কবর জগতে সকল মানুষকে মুখোমুখি হতে হয় তিনটি প্রশ্নের। একটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক, তা হলো- কবর জগত বলতে কেবল সাড়ে তিন হাত মাটির ঘরটিকে বোঝানো হয় না। মৃত্যুর পর থেকে পুনরুত্থান পর্যন্ত মানুষের যে সময়টি অতিবাহিত হয়, এ সময়কে বলা হয় ‘আলমে বরযখ’, সাধারণভাবে বোঝানোর জন্য এ সময়টিকেই আমরা কবর জগত বলে থাকি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা কবর ছাড়াও প্রশ্নোত্তর হতে পারে। যেমন সনাতন ধর্মের অনুসারীদের শরীর মৃত্যুর পর ভষ্মীভূত করে ফেলা হয়, তাদের কবর দেওয়া হয় না। তাহলে কি তারা এই প্রশ্নোত্তর থেকে রেহাই পাবেন? বিষয়টি আসলে তেমন নয়। ইসলামের বিষয়ে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে তারাও জানেন যে, মৃত্যুর পর প্রতিটি ব্যক্তিকে তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে। এ সম্পর্কিত হাদিসটি উল্লেখ করছি তাহলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে:
বারা বিন আযিব (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমরা রসুলের সাথে একটি জানাজায় অংশ গ্রহণ করেছি। সেখানে রসুলাল্লাহ বলেছিলেন : তার (কবরবাসীর) নিকট দু’জন মালায়েক আসবে, তারা তাকে বসিয়ে বলবে: তোমার রব কে? সে বলবে, ‘আমার রব, আল্লাহ’। তারা বলবে: তোমার দীন কী? সে বলবে: আমার দীন হচ্ছে, ‘ইসলাম’। তারা বলবে: এই যে ইনি! তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তাঁর পরিচয় কী? সে বলবে: ইনি আল্লাহর রসুল (মুসনাদে আহমদ ও আবু দাউদ)। কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়, প্রশ্ন তিনটি হলো যথাক্রমে (১) মান রাব্বুকা (তোমার প্রতিপালক কে)? (২) ওয়া মান দীনুকা (তোমার জীবনব্যবস্থা কী ছিল)? (৩) ওয়া মান নাবীয়্যুকা (তোমার নবী কে)?
আমাদের সমাজের মোসলেম দাবিদারগণ জীবনের শেষ পর্যায়ে বৃদ্ধকালে এসে এই তিনটি প্রশ্ন উত্তরসহ প্রায়ই মুখস্ত করা ছাড়াও বার বার মুখে আবৃত্তি করেন যাতে কবরে সঠিক উত্তর দিয়ে পার পেতে পারেন। কিন্তু তারা এই সহজ সত্যটুকু বুঝতে পারেন না যে, দুনিয়াতে তার আমলগুলিই এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর হিসাবে যথেষ্ট। অর্থাৎ দুনিয়ার জীবনে তারা যাকে প্রতিপালক হিসাবে গ্রহণ করেছে, যে যেই জীবনব্যবস্থার উপর দুনিয়ার জীবন পরিচালিত করছে এবং যে যার আদর্শ মোতাবেক নিজেকে সাজিয়েছে সেগুলিই সেখানে উত্তর হিসাবে সে উচ্চারণ করবে, দুনিয়ার মুখস্তবিদ্যা ওখানে কোন কাজে আসবে না।
এই প্রশ্ন এবং উত্তরগুলোর বিষয়েই সংক্ষিপ্ত আকারে কিছুটা পর্যালোচনা করব।
প্রথম প্রশ্নঃ তোমার রব কে? এখানে ‘রব’ বলতে শুধু প্রতিপালক বোঝায় না। কারণ, মক্কার মোশরেকরাও আল্লাহকে ‘রব’ হিসেবে মানতো। মক্কার মোশরেকদের যদি জিজ্ঞাসা করা হতো, বলতো, তোমাদের কে সৃষ্টি করেছেন, এই আকাশ-জমিন কে সৃষ্টি করেছেন, আশ্রয় দেয়ার মালিক কে, কার হাতে সকল কিছুর কর্তৃত্ব, এই প্রশ্নগুলোর জবাবে তারা বলতো, ‘আল্লাহ’। আল্লাহ বলেন: তাদেরকে প্রশ্ন করো, ‘কে সাত আসমানের রব এবং মহা আরশের রব’? তারা বলবে, ‘আল্লাহ।’ (সুরা মুমিনূনঃ ৮৪-৮৯)। সুতরাং আজ আমরা আল্লাহকে যেভাবে রব বলে ঈমান পোষণ করি সেটুকু ঈমান মক্কার মোশরেক-কাফেরদেরও ছিল। এই ঈমান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য বা যথেষ্ট হলে আর নতুন করে নবী পাঠানোর কি প্রয়োজন ছিল? প্রকৃতপক্ষে ‘রব’ শব্দের অর্থ অনেক বিস্তৃত এবং এর প্রধান অর্থ হচ্ছে প্রভু। অর্থাৎ মানুষটি তার জীবনে কার হুকুমের দাসত্ব করেছে, কাকে নিজের সর্বময় কর্তৃত্বকারী সত্ত্বা বা প্রভু বলে মেনেছে সেটাই জানতে চাওয়া হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রসুল তাঁর দাজ্জাল সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীগুলিতে মানবজাতির প্রতি দাজ্জালের একমাত্র দাবি কি হবে তা জানিয়ে দিয়েছেন, সেটা হলো দাজ্জাল নিজেকে মানবজাতির রব হিসাবে দাবি করবে, মা’বুদ বা স্রষ্টা হিসাবে নয়। বর্তমানে কথিত মোসলেম জনসংখ্যাটিসহ সমগ্র মানবজাতি দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’কে তাদের ‘রব’, প্রভু বলে মেনে নিয়ে জীবনের সর্বাঙ্গনে তার সাজদায় পড়ে আছে। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ অস্বীকার করে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সার্বভৌমের আসনে বসিয়ে রেখেছে। সুতরাং কবরে গিয়ে মালায়েকদের প্রশ্নের উত্তরে ইহুদি খ্রিস্টান সভ্যতাকে নিজেদের রব না বলে কোন উপায় থাকবে না। বর্তমানে মোসলেম দাবিদার জনসংখ্যাটিসহ সমগ্র মানবজাতিই দাজ্জালের অর্থাৎ ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হচ্ছে। তারা পশ্চিমা প্রভু-জাতিগুলিকে নিজেদের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের সোপান ও নিয়ামক বলে বিশ্বাস করে থাকে। প্রভুদের কৃপা পেলে ধন্য হয়ে যায়, সর্বত্র সেই কৃপার দানকে গৌরবের সঙ্গে প্রচার করতে থাকে। এই ভিক্ষাবৃত্তি করেও তারা কোনরূপ লজ্জিত বোধ করে না। নিজেদের দেশের বাজেট করার আগে প্রভুদের দেশে গিয়ে করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনুদান না পেলে অনাহারে, অশিক্ষায় ধুঁকে মরে। বিদেশীদের দান নিয়ে সরকারগুলি একে অপরের সঙ্গে বিদঘুটে লবিং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। পৃথিবীর জীবনে ইহুদি খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র এমন হীন গোলামিতে লিপ্ত থেকেও এ জাতি বিশ্বাস করে যে তারা আল্লাহকেই রব মেনে চলেছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ তারা বলবে: তোমার দীন কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ঐ সকল ব্যক্তিরা ব্যর্থ হয়ে যাবে যারা ইসলামকে নিজের ‘দীন’ তথা ‘জীবনব্যবস্থা’ হিসেবে গ্রহণ করে নি। বর্তমানের এই তথাকথিত মোসলেম জনগোষ্ঠী ইহুদি খ্রিস্টানদের তৈরি বিভিন্ন মতবাদ ও তন্ত্রমন্ত্র যেমন গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনা করছে। মালায়েকদের প্রশ্নের জবাবে এরা যে যেই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে জীবন পরিচালিত করেছেন, সেই অনুযায়ী উত্তর দিবেন। যেমন কেউ বলবেন, আমার দীন গণতন্ত্র, কেউ বলবেন সমাজতন্ত্র, কেউ বলবেন একনায়কতন্ত্র, কেউ বলবেন রাজতন্ত্র ইত্যাদি।
তৃতীয় প্রশ্নঃ তারা বলবে: এই যে ইনি! তোমাদের নিকট পাঠানো হয়েছিল, তাঁর পরিচয় কি? বা তোমার নবী কে? ‘তোমার নবী কে’ বলতে তোমরা তোমাদের জীবনে কার প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করেছ বা তার নেতা কে ছিল তা জানতে চাওয়া হচ্ছে। বাস্তব জীবনে মানুষ যে মতাদর্শে বিশ্বাসী, সেই মতবাদের প্রবক্তা ও নেতৃবৃন্দকে তার জীবনাদর্শ বলে মেনে চলেছে। রসুলাল্লাহ বলেছেন: “তোমাদের মাঝে কেউ ঐ পর্যন্ত মো’মেন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তার প্রবৃত্তি আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসারী না হবে।” সুতরাং যারা তাদের জীবনে রসুলাল্লাহর কর্মপন্থা বা সুন্নাহ অনুসরণ করবে না তারা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। তাই তারা যখন মৃত্যুর পর এই প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তখন ঐ মতবাদগুলির প্রবক্তা ও নেতাদের নামই উল্লেখ করতে বাধ্য হবে। এ প্রশ্নের উত্তরে গণতন্ত্রীরা আব্রাহাম লিংকন বা গণতন্ত্রের অপর কোন পুরোধা ব্যক্তির নাম বলবেন।’ আর সমাজতন্ত্রীরা বলবেন, “আমার নবী কাল মার্কস অথবা ফ্রেডরিখ এ্যাঙ্গেলস’। যারা রাজতন্ত্রকে মেনে নিয়েছে তাদের উত্তর হবে ‘আমার নবী অমুক রাজা।’ যারা একনায়কতন্ত্রকে মেনে নিয়েছে তারা বলবে ‘আমার দীন একনায়কতন্ত্র এবং আমার নবী অমুক একনায়ক’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ দুনিয়াতে যে যাকে আদর্শ হিসাবে মেনে চলেছেন ওপারে তার নামই আপনাকে উচ্চারণ করতে হবে। আপনি তখন আল্লাহর রসুলকে দেখে চিনতে পারবেন না, কারণ আপনার জীবন তাঁর আদর্শে পরিচালিত হয় নি।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর পর মানুষ যে তিনটি প্রশ্নের সম্মুখীন হবে তার একটিরও সঠিক জবাব এই পথভ্রষ্ঠ মোসলেম জনসংখ্যার কাছে নেই। এমনকি যারা দীনুল হক কায়েম করার সংগ্রামে লিপ্ত, তারাও যদি দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লাহর রসুলের প্রদর্শিত পন্থা অনুসরণ না করে জনসভা, অনশন, ঘেরাও, মানববন্ধন, মিছিল, লংমার্চ জাতীয় তাগুত প্রদর্শিত পদ্ধতি অবলম্বন করেন তারাও রসুলের সুন্নাহ অনুসরণ করছেন না, করছেন তাগুতের সুন্নাহ বা পদ্ধতি। তাদের সকলকেই এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হলে আল্লাহর নিজের রচিত, রসুলের রেখে যাওয়া পাঁচ দফার পবিত্র কর্মসূচিটি অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ যামানার এমামকে এমাম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর নেতৃত্বে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে হবে।
সুতরাং আজকে আমাদের উচিৎ এমন একটা জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেমের উপর জীবন পরিচালিত করা যে সিস্টেমের রব ‘আল্লাহ’, যে সিস্টেমের জীবনব্যবস্থা ‘ইসলাম’ এবং যে সিস্টেমের আদর্শ ‘মোহাম্মদ সঃ।’ তবেই আমরা কবরে সঠিক উত্তর দিতে পারবো। নতুবা দুনিয়াতে যেমন অন্যায়, অশান্তি, জুলুম নির্যাতন, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হীনতা, গোলামি করে যাচ্ছি, কবরেও জুটবে কঠিন শাস্তি এবং পুনরুত্থানের পরে আবার স্থায়ী জাহান্নাম।