মানুষ সবকিছু নিজের জ্ঞান দিয়েই বিচার করে থাকে। সৃষ্টিজগৎ যত অসীমই হোক, মানুষ সেটাকে ততটুকুই বুঝতে পারে যতটুকু তার বোধশক্তির ও দৃষ্টির ড়্গমতা থাকে। মাননীয় এমামুযযামানের জ্ঞানের পরিধি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে সেটাকে বুঝতে গিয়ে আমি বারবার নিজের অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করে লজ্জিত হয়েছি। অনেককেই দেখতাম মাননীয় এমামুযযামানকে বিভিন্ন বুদ্ধি দিচ্ছে, আমিও কত দিয়েছি। কিন্তু এখন মনে মনে হাসি নিজের বোকামির কথা স্মরণ করে। এমামুযযামানের মিটিং-এ অনেকেই দেখতাম দাঁড়িয়ে দীর্ঘসময় নিয়ে কথা বলত। তিনি ধৈর্য ধরে মাথা নিচু করে, চোখ বন্ধ করে শুনতেন আর শুনতেন। কাউকে থামাতেন না বড় একটা। অনেকেই বিরক্ত হতো, ইশারা করত কথা সংক্ষেপ করার জন্য। এমামুযযামান পুরোটা শুনতেন আর তার কথার জবাবও দিতেন।
কারো কথার ভিতরে কোনো ভুল তথ্য থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেটা ধরে ফেলতেন এবং সেটা সম্পর্কে আবার জিজ্ঞাসা করতেন। কেউ কোনোদিন ভুলভাল তথ্য দিয়ে এমামুযযামানের সামনে থেকে যেতে পারত না, তিনি সেটা নিজে সংশোধন করে দিতেন অথব বলতেন ভালো করে জেনে আমাকে বলো। কোনো গুরুতর সংবাদ কানে আসলে তিনি প্রথম সংবাদের উৎস জানতে চাইতেন। তারপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য খোঁজ-খবর নিতেন। এভাবে তিনি গুজবের প্রভাব থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে পারতেন।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট তখনও অতটা জনপ্রিয় হয় নি। ফেসবুকও জনপ্রিয়তা পায়নি তেমন। এমন একটা সময়ে একটা নিউজ পোর্টালে লেখা হলো যে একটি উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুসারে এটা ঢাকার আশপাশে, খুব সম্ভবত সাভার এলাকায় পড়তে পারে। সেখানে উল্কাপতনের দিনক্ষণ পর্যন্ত বলে দেওয়া হয়েছে। সূত্রে বলা হয়েছে নাসার কথা। এমামুযযামান আমাদেরকে বললেন খবর নেওয়ার জন্য। আমরা নাসার ওয়েবসাইটে দেখলাম এমন কিছু লেখা আছে কিনা। অন্যান্য জায়গায়ও খবর নিলাম। কোথাও কিছু পেলাম না। এমামুযযামান বললেন, নাসায় (NASA-The National Aeronautics and Space Administration) চিঠি লিখে জানতে চাও। আমি একটা চিঠিও লিখে মেইল করে পাঠালাম। কিন্তু সেখান থেকে এমন কোনো খবর তারা বলতে পারল না। শুধু একটা রেজিস্ট্রেশন করে রাখার জন্য বলল যেন তাদের সব প্রকাশিত তথ্যের আপডেট আমার মেইলে তারা পাঠাতে পারে। কয়েক বছর নাসা থেকেই সেইসব মেইল আমাকে পাঠানো হয়েছে। প্রথম প্রথম পড়তাম। পরে আর পড়া সম্ভব হতো না। এভাবে একটি তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এতটা গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করার অভ্যাস মাননীয় এমামুযযামানের ছিল, যা অন্য কাউকে আমি করতে দেখিনি।
তিনি লেখালিখির বিষয়ে ছিলেন খুবই যত্নশীল, বলা যায় পারফেকশনিস্ট। ২০০৮ সনে সরকারের উদ্দেশে তিনি একটি সমঝোতা স্মারক প্রস্তাব করেন। এর বিষয়বস্তু ছিল, মিডিয়ার অপপ্রচার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা হেযবুত তওহীদের সদস্যদের উপর অন্যায় আচরণ করেন, রিমান্ডের নামে নির্যাতন করেন। কোনো আইন ভঙ্গ না করা সত্ত্বেও, নিষিদ্ধ না হওয়া সত্ত্বেও এজাহারে নিষিদ্ধ, জঙ্গি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলেন। এর ফলে হেযবুত তওহীদের নির্দোষ সদস্যদেরকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে এই সমঝোতা স্মারকটি লিখেন। প্রায় আঠারোবার প্রুফ সংশোধন ও পরিমার্জনের পর তিনি এই চিঠিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরম্ন করে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের নিকট প্রেরণ করেন।
চিঠিগুলো যেন যথাযথ কার্যালয়ে পৌঁছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি আমাদেরকে বললেন, কেবল রেজিস্ট্রি করলেই হবে না, এ/ডি কার্ড (Acknowledgement Due Card বা প্রাপ্তিস্বীকার পত্র) চিঠির খামের সঙ্গে আঠা দিয়ে সেঁটে দিতে হবে। প্রাপকের প্রাপ্তিস্বীকার স্বাক্ষরসহ সেই কার্ড আবার প্রেরকের ঠিকানায় চলে আসবে। চিঠি পাঠানোর কিছুদিন পর সেই কার্ডগুলো কয়েকটা আসলো। কিন্তু সব আসলো না। যেগুলো আসলো সেগুলো তিনি আমাদের আম্মাজানকে (এমামুযযামানের সহধর্মিণী) দিলেন যত্ন করে আলমারিতে সংরক্ষণ করার জন্য। আর যেগুলো আসলো না সেগুলোর জন্য আমাদেরকে আবার পাঠালেন জিপিও-তে, অর্থাৎ ডাক বিভাগের প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে গিয়ে আমরা খুঁজে খুঁজে সেই এডি কার্ডগুলো নিয়ে আসলাম। দুই মাস পর এমামুযযামান আবার রিমাইন্ডার চিঠি প্রেরণ করলেন একই দফতরে। এবারও সঙ্গে এডি কার্ড। সরকার থেকে কোনো প্রকার সাড়া পাওয়া গেল না।
এরই মধ্যে ২০০৯ এর শেষে সরকার পরিবর্তন হলো। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলেন। এমামুযযামান নবনির্বাচিত সরকারের উদ্দেশে আবারও সেই সমঝোতা স্মারকে উপনীত হওয়ার প্রস্তাবনা পেশ করলেন। কোনো জবাব আসলো না। অতঃপর তিনি আরেকটা চিঠি লিখলেন জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশে। তাদের কাছেও পূর্বের সমঝোতা স্মারকের অনুলিপি পাঠালেন। চিঠি পাঠানোর প্রতিটি ডকুমেন্ট তিনি সংরক্ষণ করে রাখতে বললেন। বললেন, “উত্তর না দিক। রেখে দাও, পরে কাজে লাগবে।”
নিরিবিলি পরিবেশ ছাড়া তিনি যেনতেনভাবে যখন তখন লিখতেন না। নির্দিষ্ট সময় ও মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বসতেন। লেখার সময় কাউকে রম্নমে আসতে দিতেন না। একটা লাইন লেখার আগে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে ভাবতেন। ২০০৩ এর পর চোখের সমস্যা হওয়ায় তিনি নিজে পড়তে ও লিখতে পারতেন না। তিনি বলতেন, আমরা লিখতাম। এই কাজটা আমার করার সৌভাগ্য বেশি হয়েছে আলহামদুলিল্লাহ।
একদিন কয়েক পৃষ্ঠা লেখার পর চোখ বন্ধ করে ভাবতে ভাবতে এমামুযযামানের ঝিমুনি এসে যায়। সাধারণত আমি ল্যাপটপে লিখতাম। এমামুযযামানকে না জাগিয়ে আমি কোনো একটা কাজে উপরে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখলাম এমামুযযামান জেগে উঠেছেন। আমাকে দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, “ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাতে ঘুম হয় না তো। আচ্ছা, শুরু করো। কোন পর্যন্ত লিখেছিলাম যেন?”
কিন্তু কোথায় লেখা? এরই মধ্যে সাইফু ভাইয়া (এমামুযযামানের ছোট ছেলে সাইফ আল মুসান্না খান পন্নী) এসে আমার ফাইলটা থেকে সব লেখা ডিলিট করে তারপর সেভ দিয়ে ক্লোজ করে দিয়েছে। সাইফু তখন বেশ ছোট আর খুব চঞ্চল। ডিজিটাল ডিভাইসের উপর তার তখনও ভীষণ আকর্ষণ। আমি কী বলব ভেবে না পেয়ে যেটা সত্যি সেটাই বললাম,
– এমামুযযামান, যেটুকু লিখেছিলাম সেটা হারিয়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছি না।
– কীভাবে হারালো?
– বুঝতে পারছি না। খুব সম্ভবত সাইফু ভাইয়া ডিলিট করে দিয়েছে।
– এটা একটা কথা হলো? ও একটা বাচ্চা। ও তো ডিলিট করতেই পারে। তুমি সেটা করতে দিলে কেন? তুমি কেন ফাইল ওপেন রেখে এখান থেকে চলে গেলে? ও কীভাবে ল্যাপটপে বসল?
আমার আসলে জবাব দেওয়ার কোনো ভাষা ছিল না। আমি জানি যে তিনি সারারাত জেগে কাটান। সকালে বিবিসির নিউজ শুনে, পত্রিকা পড়া শুনে তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করেন। সেদিন আর তিনি কাজ করলেন না। বললেন, “বাদ দাও। আজ আর হবে না।”
এমামুযযামানের সঙ্গে কাজ করতে হলে নিজেদের দায়িত্ববোধের চূড়ান্ত পরিচয় দিতে হতো। সামান্য অসতর্কতা বা দায়িত্বে গাফেলতিও তাঁর নজর এড়াতো না। তাঁকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব ছিল। কাজের ক্ষেত্রে তিনি সব সময় সামরিক শৃঙ্খলা দাবি করতেন, আর আমরা সে হিসাবে ছিলাম চূড়ান্ত অথর্ব, চূড়ান্ত গাফেল, চূড়াšত্ম অযোগ্য- এক কথায় টিপিক্যাল বাঙালি চরিত্র। সামরিক চরিত্রের ছিটেফোটাও নেই। অথচ তিনি কথায় কথায় নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অলস লোক বলে উলেস্নখ করতেন। একবার একজন আমির একটু আগে আগে মিটিং থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য এমামুযযামানের কাছে গেলেন। এমামুযযামান মোসাহফা করে হেসে বললেন বললেন, “ঘোড়ার মুখ থাকে ময়দানের দিকে, বাঙালির মুখ থাকে বাড়ির দিকে। যাও।”
তাঁর ধমকের ধরন, রাগান্বিত হওয়ার ধরন, অসন্তুষ্টি প্রকাশের ধরনটা ছিল এরকম। উচ্চস্বরে বকাবকি নয়, দুই এক শব্দে তিনি নিজের হতাশাটা বুঝিয়ে দিতেন আর সেটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। তাঁর কঠিন মুখের চেয়ে বড় শাস্তি আমাদের কাছে আর কিছুই ছিল না। তাঁর পাহাড়সমান ব্যক্তিত্বের সামনে আমি পাপীতাপীর মতো ধুলায় মিশে যেতাম।
ঐ আসনতলের মাটির পরে লুটিয়ে রব
তোমার চরণধুলায় ধুলায় ধূসর হব।
তাঁর তিরস্কারকে আশীর্বাদ ও শিক্ষা হিসাবে গ্রহণ করে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য প্রত্যয়ী হতাম। প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করতাম, আমি তাঁর স্নেহ পাওয়ার যোগ্য না, আমি তাঁর অনুসারী হওয়ার মতো কেউ না। তিনি যে আমাকে চিনেন, আমার মতো কীটাণুকীট, বোধবুদ্ধিহীন, অজ্ঞমূর্খের নাম জানেন, এই তো আমার জন্য যথেষ্ট। হৃদয়ের গভীরতম ¯ত্মরে আজও সেই অনুভূতিটাই লালন করি এবং বিশ্বাস করি।