মসীহ উর রহমান
পবিত্র কোরআনে ‘যুলুম’ শব্দটি আল্লাহ অনেকবার ব্যবহার করেছেন। এর প্রকৃত অর্থ হারিয়ে গেছে। বর্তমানে এর অর্থ করা হয় অত্যাচার, মারধর ইত্যাদি দ্বারা। কোরআনের সব ইংরেজি অনুবাদেও এই শব্দকে (Tyranny, Oppression) অনুবাদ করা হয়েছে। আসলে ‘যুলুম’ শব্দের অর্থ এর থেকে অনেক ব্যাপক। আল্লাহ যে অর্থে এই শব্দ ব্যবহার করেছেন তা সংক্ষেপে এই- যা হওয়া বা করা উচিৎ নয়, তা হওয়া বা করা এবং যা হওয়া বা করা উচিৎ তা না হওয়া বা না করা। এক কথায় অন্যায়। প্রশ্ন হতে পারে, ন্যায়- অন্যায়ের মাপকাঠি কী? উত্তর হচ্ছে স্রষ্টা যে মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছেন সেই মাপকাঠি মোতাবেক যেটা ন্যায় এবং যেটা অন্যায়। আল্লাহ যে জীবন-ব্যবস্থা, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি মানুষকে দিয়েছেন সেই মাপকাঠি দিয়ে না মেপে মানুষের কাজকে যদি মানুষের গড়া মাপকাঠি দিয়ে মাপা হয় তবে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে অন্যায়-যুলুম। জীবনের যে অঙ্গনেই তা করা হবে সেই অঙ্গনেই অন্যায় হবে, যুলুম হবে। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন- যা অবতীর্ণ করা হয়েছে (কোর’আন) সেই মোতাবেক যারা শাসন- বিচার করে না তারা যালেম (সুরা মায়েদা,আয়াত-৪৫)। অর্থাৎ বিচার ও শাসনে ন্যায়- অন্যায়ের মাপকাঠি হিসাবে আল্লাহর দেয়া মাপকাঠি কোর’আনকে যারা নেয় না, নিজেরা ইচ্ছামত মাপকাঠি তৈরি করে নেয় তারা যালেম অর্থাৎ অন্যায়কারী কারণ তাদের কাজের ফলে অন্যায় সংঘটিত হবে, অবিচার সংঘটিত হবে। উদাহরণ স্বরূপ ধরুন-দুটি দেশ; একটি দেশের শাসনকর্তা স্রষ্টার দেয়া ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করেন, স্রষ্টার দেয়া দণ্ডবিধি অনুসারে শাস্তি ও পুরস্কার দেন, শাস্তির ব্যাপারে কাউকে ক্ষমা করেন না, কঠিন শাস্তিকে লঘুও করেন না। আপাতঃদৃষ্টিতে তিনি নির্দয়, যালেম। অন্য দেশটির শাসক স্রষ্টার দেয়া ব্যবস্থাকে অতি কঠোর মনে করে নিজের তৈরি ব্যবস্থায় বিচার করেন, অপরাধীদের লঘুদণ্ড দেন বা মাফই করে দেন। আপাতঃদৃষ্টিতে তিনি একজন সহৃদয় শাসনকর্তা। কিন্তু কোরআনের সংজ্ঞা অনুযায়ী আল্লাহ্র দৃষ্টিতে প্রথম জন ন্যায়বান ও দ্বিতীয় জন যালেম। কারণ, প্রথম জনের দ্বারা স্রষ্টার নির্ধারিত বিচার ও শাাস্তি প্রয়োগের ফলে সমাজ থেকে অপরাধ প্রায় নির্মূল হয়ে যাবে, মানুষ নিরাপত্তা ও শান্তিতে বাস করতে পারবে। দ্বিতীয় জনের সহৃদয়তায়, লঘু শাস্তির ফলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে দেশে অপরাধ বাড়বে এবং বহু লোক অপরাধের শিকার বা মজলুম হবে; অর্থাৎ ঐ সহৃদয় শাসকের কাজের ফলে সমাজের উপর যুলুম, অন্যায় হবে। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, ‘যারা আমার নাজেলকৃত আয়াত দ্বারা বিচার করে না, তারা যালেম (সুরা মায়েদা ৪৫)।’
নিজ বাবা-মা ও আত্মীয়বর্গের প্রতি মানুষের কর্তব্য পালন করা অপরিহার্য্য এবং কর্তব্যে অবহেলা করা অনুচিত ও অমানবিক। যারা তা করে আমরা তাদেরকে যালেম বলে আখ্যায়িত করি। কিন্তু যখন দেখা যায় সেই ঘনিষ্ঠজনেরা আল্লাহ ও রসুলের বিরুদ্ধাচারী তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করাই ন্যায় এবং আন্তরিক সম্পর্ক রক্ষা করাই যুলুম। এ ব্যাপারে আল্লাহ্র ঘোষণা, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের পিতা ও ভ্রাতা যদি ঈমানের মোকাবেলায় কুফরিকে শ্রেয় জ্ঞান করে তবে উহাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করিও না। তোমাদের মধ্যে যাহারা উহাদেরকে অন্তরঙ্গরূপে গ্রহণ করে, তাহারাই যালেম’ (কোর’আন, সুরা তওবা, আয়াত-২৩)। আজকে আল্লাহ্র দেয়া জীবনব্যবস্থা বাদ দিয়ে মানব জাতি এখন সেই ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র দেওয়া জীবনব্যবস্থা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি গ্রহণ করে নিয়েছে, এভাবে তারা নিজেরাও ঐ জাতিগুলির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। এর ফলে মানবজাতি যে অন্যায় বা যুলুমের শিকার হয়েছে তার কদর্য রূপ আমরা বর্তমান দুনিয়ার দিকে তাকালে দেখতে পাই। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারে, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনায়-শোষণে, শাসিতের উপর শাসকের অবিচারে, ন্যায়ের উপর অন্যায়ের বিজয়ে, সরলের উপর ধূর্তের বঞ্চনায় পৃথিবী আজ মানুষের বাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য।