রাকীব আল হাসান
মো’মেন শব্দটি এসেছে ঈমান অর্থাৎ বিশ্বাস থেকে। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ মো’মেনের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে, “তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনার পর আর কোন সন্দেহ পোষণ করে না এবং জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ (সুরা হুজরাত ১৫)”। আল্লাহর দেয়া প্রকৃত মো’মেনের এই সংজ্ঞাটা ঠিকভাবে বুঝতে গেলে আমাদের বুঝতে হবে আল্লাহর ওপর ঈমান-এর অর্থ শুধু আল্লাহর অস্তিত্বে ও একত্বের ওপর ঈমান নয়, তাঁর উলুহিয়াতের ওপর, সার্বভৌমত্বের ওপর (Sovereignty) ঈমান, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোন আদেশদাতা-হুকুমদাতা নেই এই বিশ্বাস করা- এটাই তওহীদ। আল্লাহর দেয়া মো’মেনের এই সংজ্ঞার দ্বিতীয় ভাগ হলো প্রাণ ও সম্পদ দিয়ে জেহাদ করা। কী জন্য জেহাদ করা? আল্লাহর তওহীদের, সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত দীনটি যদি মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠা, কার্যকর না হয় তবে ওটা অর্থহীন। কাজেই আল্লাহর তওহীদ ভিত্তিক ঐ দীনুল হক, সত্য জীবন-ব্যবস্থাটা মানবজীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, জেহাদ। এই দু’টি একত্রে প্রকৃত মো’মেনের সংজ্ঞা। এই দু’টি যার বা যাদের মধ্যে আছে, আল্লাহর দেয়া সংজ্ঞা মোতাবেক সে বা তারা প্রকৃত মো’মেন। এই সংজ্ঞায় আল্লাহ বলেন নি যে, যে সালাহ পড়বে সে মো’মেন, বা যে রোযা রাখবে সে মো’মেন, বা যে হজ্ব করবে, বা অন্য যে কোনো পূণ্য, সওয়াবের কাজ করবে সে মো’মেন। এ সংজ্ঞায় আছে শুধু আল্লাহ ছাড়া আর সমস্ত রকম প্রভুত্ব, সার্বভৌমত্ব অস্বীকার ও আল্লাহর পথে জেহাদ। এর ঠিক বিপরীতে তিনি এ সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন যে, এ তওহীদে যে বা যারা থাকবে না, যারা তাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের যে কোনো একটি ভাগে, অঙ্গনে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বা নিজেদের তৈরি আইন-কানুন, রীতি-নীতি গ্রহণ বা প্রয়োগ করবে, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ইলাহ বা সার্বভৌম হুকুমদাতা হিসাবে মানবে তারা শেরক করবে। আর শেরক ক্ষমা না করার জন্য আল্লাহ অঙ্গীকারাবদ্ধ (কোর’আন- সুরা নেসা ৪৮)। মহান আল্লাহ মো’মেনের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন আজ আমরা সেই সংজ্ঞা মোতাবেক মো’মেন আছি কিনা তা অবশ্যই বিবেচনা করে দেখতে হবে। কারণ মো’মেন না হলে তার জন্য জান্নাত নেই, যত আমলই করা হোক। আবার যারা আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে মানবরচিত হুকুম-বিধান দিয়ে সমাজ পরিচালনা করে তাদেরকে আল্লাহ কাফের বলেছেন স্পষ্টভাবে (সুরা মায়েদা-৪৪)।
এটা গেল সংজ্ঞার বিষয়। এবারে আসা যাক মো’মেনদের বৈশিষ্ট্যের সাথে আজকের মুসলিম নামক এই জাতির মিল কতটুকু তা নিরূপণে। কোর’আনের বহু স্থানে আল্লাহ মো’মেনদের বৈশিষ্ট্য বা চিহ্ন উল্লেখ করেছেন যা দিয়ে মো’মেনদেরকে চেনা যায়। যেমন তিনি মো’মেনদের সম্পর্কে বলছেন, “তারা কাফেরদের প্রতি কঠিন, কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি কোমলহৃদয়, দয়ার্দ্র (সুরা ফাতাহ ২৯)। এই আয়াতের আলোকে আমরা এই জনসংখ্যাটির দিকে তাকালে আল্লাহর বর্ণনার বিপরীত চিত্রই দেখতে পাই। আমরা দেখি এই জনসংখ্যাটি কাফেরদের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায় আপ্লুত, হীনমন্যতায়, ভয়ে, ত্রাসে তাদের পায়ে মাথা নত করে আছে, কাফেরদের প্রতি এতই অনুরক্ত যে তাদের ডাকে নিজ জাতির বিরুদ্ধেই যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, সর্ববিষয়ে শত্রুপক্ষের আনুগত্য করছে, অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে, সেটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমন কি ধর্মীয় যা-ই হোক না কেন, নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। উদাহরণ: শিয়া সুন্নী, বিভিন্ন মাজহাব ও মারেফতী তরিকার অনুসারীদের মধ্যে বিবাদ, মারামারি এবং জাতিগতভাবে বিভিন্ন ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে গত কয়েক শতাব্দী ধরে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধ-বিগ্রহ, গণহত্যা। পাশ্চাত্য ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতার’ প্রতি তারা এতটাই অনুগত ও গদগদচিত্ত যে তাদের মনরক্ষার জন্য নিজের দেশের মুসলিম নামধারী লক্ষ লক্ষ মানুষ গুলি করে, ট্যাংকের তলায় পিষে মারতেও তাদের আত্মা এতটুকুও কাঁপে না। সুতরাং আল্লাহ যে বললেন, মো’মেনরা কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি বিগলিত হৃদয় (রুহামা), বাস্তবে এর কোন নজির আমরা দেখি না। যেটা দেখি সেটা এর ঠিক বিপরীত। আবার আল্লাহ সুরা নূরের ৫৫ নম্বর আয়াতে বলেছেন, আল্লাহর ওয়াদা (ওয়াদাল্লাহ) হচ্ছে যারা ঈমান আনবে এবং আমলে সালেহ করবে (অর্থাৎ মো’মেনদের সাথে আল্লাহর ওয়াদা) তাদেরকে আল্লাহ পৃথিবীর কর্তৃত্ব (খেলাফত, অঁঃযড়ৎরঃু, চড়বিৎ) প্রদান করবেন, যেমনটি তিনি দিয়েছিলেন তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি তোমাদের দীনকে প্রতিষ্ঠা করবেন যেটা তিনি তোমাদের জন্য পছন্দ করেছেন। তোমাদের ভয়-ভীতি দূর করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান করবেন। সেখানে তোমরা কেবল আমারই ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যারা (এ বিশাল নেয়ামতকে) অস্বীকার করবে, তারাই ফাসেক ও অবাধ্য।” তিনি আরো বলেছেন, “আল্লাহ মো’মেনদের ওয়ালি (অভিভাবক, বন্ধু, রক্ষক, Protector) (সুরা ইমরান ৬৮)”। বলেছেন, “তোমরা হতাশ হয়ো না, নিরাশ হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে- যদি তোমরা মো’মেন হও (সুরা ইমরান ১৩৯)। বলেছেন, “মো’মেনকে সাহায্য করা আমার হক, কর্তব্য (সুরা রুম ৪৭)”।
আমরা যদি মো’মেন হই তাহলে কোর’আনের ভাষ্য অনুযায়ী আমাদের হাতে পৃথিবীর কর্তৃত্ব থাকার কথা (তিনি কর্তৃত্ব দিবেন বলে ওয়াদা করেছেন যেমন দিয়েছিলেন আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে)। আমরা যদি মো’মেন হই তাহলে আল্লাহ আমাদের অভিভাবক হবার কথা, আল্লাহ আমাদের অভিভাবক হলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা লাঞ্ছিত, অপমানিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত হবার কথা নয়। আল্লাহ আমাদেরকে বিজয় দিবেন এবং সর্বদা সাহায্য করবেন বলেও ওয়াদা করেছেন। কিন্তু এ পৃথিবী জোড়া মুসলিম জাতির করুণ দুর্দশা দেখলে যে কারো মনেই আল্লাহর এ সকল ওয়াদা সম্পর্কে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, আমরাই তাহলে পৃথিবীর সর্বত্র সকল জাতির হাতে গত কয়েক শতাব্দী থেকে মার খাচ্ছি কেন? একে একে আমাদের আবাসভূমিগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। সর্বহারা উদ্বাস্তু হচ্ছি আমরা মুসলমানরা। ধর্ষিতা হচ্ছে মুসলিম নারীরা। পানিতে ভেসে যাচ্ছে মুসলিম শিশুরা। তবে কি আল্লাহ তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন? কিংবা আল্লাহ কি ভুলে গেছেন তাঁর কৃত প্রতিশ্রুতির কথা? নাকি তিনি মুসলিমদের উদ্ধার করতে অক্ষম? (নাউযুবিল্লাহ)। না, সেটা অসম্ভব। তিনিই বলেছেন, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তাঁর চেয়ে সত্যবাদী আর কে আছে (সুরা তওবা- ১১১)। যুক্তিশীল মানুষের কাছে প্রশ্ন করলে এর একটাই উত্তর পাওয়া যাবে, তা হলো- আমরা আসলে মো’মেন নেই, আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতিগুলো আমাদের জন্য নয়। আমরা মো’মেন নেই, আর আমাদের দুনিয়া যেমন লাঞ্ছনাদায়ক তেমনি সকল আমলসহ আমাদেরকে পুড়তে হবে জাহান্নামে। হেযবুত তওহীদ মানুষকে কলেমার ভিত্তিতে, আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ মো’মেন হবার জন্য আহ্বান করছে। হেযবুত তওহীদ মানবজাতিকে বলছে- তোমরা আল্লাহর হুকুম মেনে নাও, তোমরা এই কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হও যে- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল।