যামানার এমামের লেখা থেকে:
মোমেনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে আল্লাহ বলেছেন, “মো’মেন শুধুমাত্র তারা যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনে অতপর কোন সন্দেহ পোষণ করে না, জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে; তারাই সত্যনিষ্ঠ” (সুরা হুজরাত-১৫)। আর উম্মতে মোহাম্মদীর প্রধান কাজই হোল জাতিগত ভাবে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার ঐ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। এই জাতি রসুলাল্লাহর (দ:) প্রকৃত সুন্নাহ অর্থাৎ তাঁর মাধ্যমে প্রেরিত দীনকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম ছেড়ে দেবার ফলে জাতি হিসাবে প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল আর আল্লাহর দেওয়া সংজ্ঞা মোতাবেক তারা মো’মেনও রইলো না। তখন জাতি হিসাবে রইলো মোসলেম। মোসলেম শব্দের অর্থ হলো- যে বা যারা আল্লাহর দেয়া জীবন ব্যবস্থাকে তসলীম অর্থাৎ সসম্মানে গ্রহণ করে নিজেদের জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা করে, অন্য কোন রকম জীবন বিধানকে স্বীকার করে না, সে বা তারা হলো মোসলেম। এ জাতির সংবিধান রইলো কোর’আন ও হাদীস, রাজনৈতিক, আর্থ সামাজিক সবরকম ব্যবস্থা শাসন ও দণ্ডবিধি সবই রইলো ঐ কোর’আন ও হাদিস মোতাবেক। ওর বাইরে অন্য কোন রকম রাজনৈতিক বা আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাকে তারা শেরক বলে বিশ্বাস করতেন। কিছুদিন আগের নিঃস্ব জাতিটি তখন আটলান্টিকের তীর থেকে চীনের সীমান্ত আর উত্তরে উরাল পর্বতমালা থেকে দক্ষিণে ভারত মহাসাগরের তীর পর্যন্ত বিশাল এলাকার শাসনকর্তা। তারা তখন সম্পদে, সামরিক শক্তিতে জনবলে প্রচণ্ড শক্তিধর, পৃথিবীর কোন শক্তির সাহস নেই এই জাতির মোকাবেলা করার।
যেহেতু তারা এই শেষ জীবন ব্যবস্থা, দীনের উপরই মোটামুটি কায়েম রইলো তাই এর সুফলও তারা লাভ করলো। কোর’আনের ও হাদিসের নির্দেশ মোতাবেক শাসন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার ফলে জাতি আইন শৃঙ্খলা ও সম্পদ বিতরণে অপূর্ব সাফল্য লাভ করলো, আল্লাহ ও রসুলের (দ:) জ্ঞান আহরণের আদেশ উৎসাহ ভরে পালন করে অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর শিক্ষকের আসনে উপবিষ্ট হলো। যে সময়টার কথা আমি বোলছি অর্থাৎ জাতি হিসাবে সংগ্রাম ত্যাগ করে উম্মতে মোহাম্মদীর সংজ্ঞা থেকে পতিত হওয়া থেকে কয়েকশ’ বছর পর ইউরোপের বিভিন্ন জাতির পদানত ও গোলামে পরিণত হওয়া পর্যন্ত এই যে সময়টা, এই সময়টা পার্থিব হিসাবে অর্থাৎ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা ইত্যাদিতে এক কথায় উন্নতি ও প্রগতি বোলতে যা বোঝায় তাতে এই জাতি পৃথিবীর সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রইলো। শেষ নবীর (দ:) মাধ্যমে শেষ জীবন ব্যবস্থা মোটামুটি নিজেদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করার অনিবার্য ফল হিসাবে এই জাতি এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হলো যে, তদানীন্তন বিশ্ব সভয়ে ও সসম্ভ্রমে এই জাতির সামনে নতজানু হয়ে পড়েছিল। এই সময়ে এই জাতির সাফল্য, কীর্তি, বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্ঞানার্জন, গবেষণা, পৃথিবীর অজানা স্থানে অভিযান ইত্যাদি প্রতি বিষয়ে যে সাফল্য লাভ করেছিল তার বিবরণ এখানে দেওয়ার স্থান নেই এবং প্রয়োজনও নেই। এ ব্যাপারে বহু বই কেতাব লেখা হয়ে গেছে। এই সময় টাকেই বলা হয় ইসলামের স্বর্ণযুগ।
কিন্তু এত কিছুতেও কোন লাভ নেই- কারণ আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হোলে বাকি আর যা কিছু থাকে সবই অর্থহীন। এ সত্য রসুলাল্লাহর (দ:) ঘনিষ্ঠ সহচর এই জাতির প্রথম খলিফা আবু বকর (রা:) জানতেন। তাই খলিফা নির্বাচিত হয়ে তার প্রথম বক্তৃতাতেই তিনি উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্বোধন করে বোলেছিলেন- হে মোসলেম জাতি! তোমরা কখনই সংগ্রাম (জেহাদ) ত্যাগ কোরো না। যে জাতি জেহাদ ত্যাগ করে- আল্লাহ সে জাতিকে অপদস্থ, অপমানিত না করে ছাড়েন না। আবু বকর (রা:) এ কথা তাঁর প্রথম বক্তৃতাতেই কেন বোলেছিলেন? তিনি বিশ্বনবীর (দ:) ঘনিষ্ঠতম সাহাবাদের একজন হিসাবে এই দীনের প্রকৃত মর্মবাণী, হকিকত তাঁর নেতার কাছ থেকে জেনেছিলেন। বিশ্বনবীর কাছ থেকে জানা ছাড়াও আবু বকর (রা:) আল্লাহর দেয়া সতর্কবাণীও কোর’আনে নিশ্চয়ই পড়েছিলেন যেখানে আল্লাহ এই মো’মেন জাতি ও উম্মতে মোহাম্মদীকে লক্ষ্য করে বোলছেন- যদি তোমরা (জেহাদের) অভিযানে বের না হও তবে তোমাদের কঠিন শাস্তি (আযাব) দেবো এবং তোমাদের বদলে (তোমাদের পরিত্যাগ করে) অন্য জাতিকে মনোনীত করবো (কোর’আন- সুরা আত তওবা ৩৮)। শুধু আবু বকর (রা:) নয়, তারপর ওমর (রা:), ওসমান (রা:) এবং আলী (রা:) ও যে ঐ মর্মবাণী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন তার প্রমাণ এই যে, তাদের সময়েও এই শেষ জীবন ব্যবস্থাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। খোলাফায়ে রাশেদা তো নয়ই এমনকি মহানবীর (দ:) একজন মাত্র সাহাবাও কোনদিন এই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরতির জন্য একটিমাত্র কথা বোলেছেন বোলে ইতিহাসে প্রমাণ নেই। বরং প্রতিটি সাহাবা তাদের পার্থিব সব কিছু কোরবান করে স্ত্রী পুত্রকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়ে বছরের পর বছর আরব থেকে বহু দূরে অজানা অচেনা দেশে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। আবু বকরের (রা:) মতো তারাও জানতেন যে, এই সংগ্রাম বিশ্বনবীর (দ:) উপর আল্লাহর অর্পিত দায়িত্ব, যা তাঁর উম্মাহ হিসাবে তাদের উপর এসে পড়েছে। তারা জানতেন এ সংগ্রাম ত্যাগ করার অর্থ উম্মতে মোহাম্মদীর গণ্ডি থেকে তাদের বহিঃষ্কার, আল্লাহর রোষাণলে পতিত হওয়া ও পরিণামে আল্লাহর শত্র“দের হাতে পরাজিত, অপমান, অপছন্দ ও লাঞ্ছনা, যা আবু বকর (রা:) বলেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক জাতি সেই কাজটিই কোরল। তারা জাতির মধ্যে সৃষ্ট আলেম-পণ্ডিতদের দীনের অতি-বিশ্লেষণের কারণে বিভিন্ন মাজহাব ও ফেরকায় বিভক্ত হয়ে গেল এবং সুফি-দরবেশদের বিকৃত তাসাউফের অনুসরণ করে বহির্মুখী, বিস্ফোরণমুখী চরিত্র হারিয়ে অন্তর্মুখী হয়ে গেল।
জাতির এই পচনক্রিয়া যে কয়েকশ’ বছর ধরে চললো এই সময়টায় কিন্তু এই উম্মাহর শত্র“রা বোসে ছিল না। তারা ক্রমাগত চেষ্টা করে চলছিল এই জাতিকে ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু এই উম্মাহর জনক মহানবী (দ:) এর মধ্যে যে বিপুল পরিমাণ সামরিক গুণ ও চরিত্র সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন তার প্রভাবে ইউরোপীয়ান শক্তিগুলি কোন বড় রকমের বিজয় লাভ করতে পারে নি। কিন্তু ফকীহ, মুফাস্সের ও সুফীদের প্রভাবে উম্মাহর আকীদা বিকৃত হয়ে যাবার ফলে পচনক্রিয়া আরও যখন ভয়াবহ হয়ে উঠলো তখন আর এই জাতির শত্র“র আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি রোইল না। ফলে তারা হয়ে গেল ইউরোপীয় খ্রিস্টান জাতিগুলির গোলাম। এই বার শত্র“ যখন তাদের নিজের তৈরি আইন ও শাসন ব্যবস্থা তাদের দাস জাতির উপর প্রবর্তন করলো তখন এই জাতি আর ঐ মোসলেমও রইলো না, হয়ে গেলো তাদের প্রভুদের মতো মোশরেক ও কাফের। পূর্ববর্তী দীনগুলির বিকৃত অবস্থা ও মানুষের তৈরি আইন-কানুন ধ্বংস করে আল্লাহর পাঠানো আইন কানুন প্রবর্তন করে পৃথিবীময় শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা যে জাতির দায়িত্ব সেই জাতিই যদি জাতীয় জীবনে ঐ আইন-কানুন পরিত্যাগ করে যে আইন-কানুন ধ্বংস করার কথা সেই আইন কানুন গ্রহণ করে তবে সে জাতির রইলো কী? জাতীয় জীবনে মানুষের তৈরি, ইউরোপের তৈরি আইন-কানুন গ্রহণ করে এই জাতি কার্যতঃ মোশরেক ও কাফের হয়ে গেলো এবং সেই যে মোশরেক ও কাফের হলো তা থেকে সে আজও প্রত্যাবর্তন করে নি, আজও সেই মোশরেকই আছে।