জাকারিয়া হাবিব
রসুলাল্লাহকে (দ:) মে’রাজে নিয়ে যেয়ে তাঁর সাথে কথাবার্তা বোলতে, আল্লাহকে কোন বৈজ্ঞানিক সত্য ভাঙ্গতে হয় নি বরং সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে তাঁর প্রেরিত প্রিয় বান্দাকে তিনি মে’রাজে অর্থাৎ ঊর্দ্ধারোহণে নিয়ে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসের ঠিক যে সময়টাকে, মানুষের জ্ঞানের বিবর্তনের যে মুহূর্তটায় আল্লাহ এ কাজটি কোরেছিলেন তখন মানুষ ততটুকু বিজ্ঞান আয়ত্ব কোরতে পারে নাই, যাতে সে বুঝতে পারে মে’রাজ কি? তাই ফিরে এসে রসুলাল্লাহকে কোনমতে প্রবোধ দিতে হোয়েছে সাহাবীদের তাঁর বাহনকে ডানাওয়ালা ঘোড়ার মত কিছু একটা বোলে। তিনি কি তখন তাঁদের বিদ্যুৎ আর Ultimate Speed বোঝাতে চেষ্টা কোরতেন? মেরাজ শব্দের আক্ষরিক অর্থ ঊর্দ্ধারোহণ। কিন্তু মোসলেমদের জন্য এই শব্দটি একটি বিশেষ ঘটনাকে নির্দিষ্ট কোরে বোঝায়। সংক্ষেপে তা হচ্ছে: বিশ্বনবী মোহাম্মদ রসুলাল্লাহর (দ:) জীবনের কোন এক সময় মালায়েক জিব্রাঈল (আ:) তাঁকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যান। আল্লাহর দরবারে আল্লাহর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, কথাবার্তা হয় এবং তারপর জিব্রাঈল (আ:) তাঁকে আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এই ঘটনাটি পবিত্র কোর’আনে উল্লেখ করা আছে।
কোন তাফসীরকারক বোলেছেন- ঘটনা সত্যিই, তবে হোয়েছে স্বপ্নে। কেউ বোলেছেন, তাঁর আত্মা ঊর্দ্ধারোহণ (মে’রাজ) কোরে আত্মার চক্ষু দিয়ে আল্লাহকে দেখে এসেছেন। আর কেউ বোলেছেন, তিনি স্বশরীরে গিয়েছেন এবং স্বশরীরে ফিরে এসেছেন।
কোর’আনের ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে এই যে দ্বিধা এর কারণ হোল মে’রাজের ঘটনা বুঝতে হোলে বিজ্ঞানের যে জ্ঞানের প্রয়োজন তা মে’রাজের ঘটনার সময় সমসাময়িক মানুষের ছিল না এবং তারপর যারা কোর’আনের তফসীর বা ব্যাখ্যা কোরেছেন তাদেরও ছিল না। আমরা বর্তমানে মসলা-মাসায়েলের ব্যাপারে শিক্ষিত যে শ্রেণির লোকদের আলেম বলি তাঁদেরও বিজ্ঞানের সে জ্ঞান নাই যাতে তারা মে’রাজের ঘটনা বুঝতে পারেন- তারা বিশ্বাস কোরেন ঠিকই, কিন্তু তা অন্ধ বিশ্বাস। বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত যতটুক অগ্রসর হোয়েছে তাতে মে’রাজের ঘটনাটাকে আংশিক বোঝা যাচ্ছে- ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের যতই অগ্রগতি হবে ক্রমশঃই মে’রাজের ঘটনা ততই বোঝা যেতে থাকবে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞান যতটা আবিষ্কার কোরতে পেরেছে সেই আলোকে পবিত্র মে’রাজ যতটুকু বোঝা যায় তার আলোচনা করবো।
প্রথম কথা হচ্ছে ‘সময় এবং দূরত্ব’ (Time and space) এই দু’ই বিস্তৃতি (Dimension) সম্বন্ধে যার যথেষ্ট জ্ঞান নেই তার পক্ষে মে’রাজ বোঝা অসম্ভব। আমি সম্পূর্ণ বুঝার কথা বোলছি না- সম্পূর্ণ বুঝা যাবে ভবিষ্যতে, বিজ্ঞান আরও বহু অগ্রসর হবার আগে নয়। আমি বর্তমান পর্যন্ত বিজ্ঞান যতটুকু অগ্রসর হোয়েছে মাত্র সেইটুকুর আলোকে মে’রাজের যে সামান্য অংশ আলোকিত হোয়েছে তাই আলোচনা কোরব। বোলেছি Dimension না বুঝলে মে’রাজ বোঝা অসম্ভব এবং Time and space, অন্ততঃ এ দুই বিস্তৃতি Dimension না বুঝলে মে’রাজ আংশিক ভাবেও বোঝা সম্ভব নয়। তাই আমরা এই দুই Dimension বোঝার চেষ্টা করবো। বিজ্ঞান বোলছে যে, এই দৃশ্যমান মহাবিশ্ব কতগুলি বিস্তৃতির (Dimension) মধ্যে আবদ্ধ- তার মধ্যে দু’টো হোলো সময় (Time) এবং দূরত্ব (Space)। আমরা মানুষও এই দুই Dimension এর মধ্যে আবদ্ধ। যদি কোন মানুষ কোন উপায়ে নিজেকে এই সময়ের (Time) বাঁধন থেকে বিচ্ছিন্ন কোরে এর ঊর্দ্ধে উঠতে পারে তবে তার কাছে অন্তহীন অতীত (Past) এবং অন্তহীন ভবিষৎ ও বর্তমান (Present) হোয়ে যাবে অর্থাৎ তার কাছে অতীত এবং ভবিষ্যৎ বোলে কিছুই থাকবে না। সমস্তই তার কাছে বর্তমান। মনে হয় প্রাচীন হিন্দুদের এ সম্বন্ধে একটা ধারণা ছিল- কারণ তাদের কাছ থেকে ত্রিকালজ্ঞ পুরুষদের সম্বন্ধে শুনতে পাই।
অনুরূপভাবে যদি কেউ নিজেকে দূরত্বের (Space) বাঁধন থেকে মুক্ত কোরতে পারেন তবে তার কাছে দূরত্ব বোলে কিছুই থাকবে না। কোটি কোটি আলোক বর্ষ দূরের জিনিস এবং চক্ষুর সম্মুখে রাখা জিনিস তাঁর কাছে সমান দূর। মোট কথা দূর বোলে তার কাছে কিছুই নেই। আর এই উভয় বিস্তৃতি (Dimension) থেকে যদি কেউ নিজেকে মুক্ত কোরতে পারে তবে তাঁর কাছে ‘দূর-নিকট-অতীত বর্তমান’ কিছুই নেই। সবই তাঁর সম্মুখে, সবই তাঁর কাছে বর্তমান।
বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের আলোকে আমরা যদি নতুন কোরে মে’রাজকে দেখি তবে কি পাই? মে’রাজের বিবরণে আমরা পাই যে, রসুলাল্লাহ (দ:)-কে আল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে হযরত জিব্রাঈল (আ:) যে বাহনটি নিয়ে এসেছিলেন তার নাম তিনি বোললেন, বোরাক। বিবরণে আমরা আরো পাচ্ছি যে, বোরাক বোলে কোন জন্তু বা বাহনের নাম এর আগে কেউ শোনে নি-কেউ জানে নি। আরবি ভাষায় শব্দটির এই প্রথম ব্যবহার হোল। বিদ্যুৎ বা ইলিকট্রিসিটির (Electricity) আরবি হোলো ‘বরক’। এই বরক থেকে আগত বোরাক শব্দটির অর্থ হোলো বিদ্যুৎ জাতীয় বা বিদ্যুৎ সম্বন্ধীয় অর্থাৎ বৈদ্যুতিক। তার অর্থ হোল জিব্রাঈল (আ:) রসুলাল্লাহ (দ:) এর জন্য যে বাহনটিকে নিয়ে এসেছিলেন সেটা ছিল বৈদ্যুতিক অর্থাৎ তার গতি ছিল অন্ততঃ সেকেন্ডে ১,৮৬,২৭০ মাইল অর্থাৎ সর্বোচ্চ গতি The ultimate speed এই বাহনে কোরেই জিবরাঈল (আ:) রসুলল্লাহ (দ:) কে আল্লাহর কাছে নিয়ে গেলেন।
মে’রাজের বিবরণে আরও পাচ্ছি যে, আল্লাহর সাথে দেখা কোরে, তাঁর সঙ্গে যা কথাবার্তা ছিল তা শেষ কোরে, সাততলা আসমানের বিভিন্ন তলায় বিভিন্ন নবী-রসুলদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কোরে, জান্নাত-জাহান্নাম দেখে, সৃষ্টির আরও সমস্ত কিছু ঘুরে-ফিরে দেখে যখন ঐ বোরাকে চোড়েই এই পৃথিবীতে ফিরে এলেন, তখন দেখলেন যে, তিনি রওনা হবার আগে যে পানি দিয়ে অযু কোরে নিয়েছিলেন সে পানি তখনও গড়িয়ে যাচ্ছে। দরজার শিকল যেমন দুলছিল ঠিক তেমনি দুলছে। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি যে মুহূর্তে বোরাকে চোড়ে রওনা হোয়েছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ফিরে এসেছিলেন- মধ্যে কোন সময় পার হয় নি।
রসুলাল্লাহকে (দ:) মে’রাজে নিয়ে যেয়ে তাঁর সাথে কথাবার্তা বোলতে, আল্লাহকে কোন বৈজ্ঞানিক সত্য ভাঙ্গতে হয় নি বরং সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক উপায়ে তাঁর প্রেরিত প্রিয় বান্দাকে তিনি মে’রাজে অর্থাৎ ঊর্দ্ধারোহণে নিয়ে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসের ঠিক যে সময়টাকে, মানুষের জ্ঞানের বিবর্তনের যে মুহূর্তটায় আল্লাহ এ কাজটি কোরেছিলেন তখন মানুষ ততটুকু বিজ্ঞান আয়ত্ব কোরতে পারে নাই, যাতে সে বুঝতে পারে মে’রাজ কি? তাই ফিরে এসে রসুলাল্লাহকে কোনমতে প্রবোধ দিতে হোয়েছে সাহাবীদের তাঁর বাহনকে ডানাওয়ালা ঘোড়ার মত কিছু একটা বোলে। তিনি কি তখন তাঁদের বিদ্যুৎ আর Ultimate Speed বোঝাতে চেষ্টা কোরতেন?
তাহোলে দেখা যাচ্ছে, আল্লাহ তাঁর প্রিয় রসুলকে জিবরাঈল (আ:) এবং সর্বোচ্চ গতিবিশিষ্ট বাহন দিয়ে সময় (Time) এবং দূরত্বের (Space) বিস্তৃতির বাইরে বা উর্দ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সমস্ত গতি, সমস্ত সময় ছিল স্তব্ধ। তারপর তাঁর কাজ শেষ হবার পর তাঁকে সময় এবং দূরত্বের ঠিক যে বিন্দু থেকে উঠিয়ে নিয়ে ছিলেন ঠিক সেই বিন্দুতেই ফেরত দিয়েছিলেন। কাজেই হুজুর (দ:) ফিরে এসে দেখে ছিলেন এক মুহূর্ত সময় পার হয় নি। এবং আরও দেখা যাচ্ছে যে, তাঁর এই মে’রাজ সম্পূর্ণ ভাবে তাঁর পবিত্র শরীর নিয়েই হোয়েছিল এবং বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ নিয়মমাফিক হোয়েছিল। শুধু বিজ্ঞান তখনও বিস্তৃতি এবং সর্বোচ্চ গতি আবিষ্কার কোরতে পারে নাই বোলেই কারও পক্ষে মে’রাজ বোঝা সম্ভব ছিল না। তাই কোর’আনের তফসীরকারদের মধ্যে অনেকেই একদিকে বিশ্বাস অন্যদিকে আপাতঃ অসম্ভব এই দুয়ের টানা-হেঁচড়ায় একটা মাঝামাঝি আপোষ কোরতে চেষ্টা কোরে এই সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক, সম্পূর্ণ শারীরিক মে’রাজকে স্বপ্ন, ধ্যান, আত্মিক এমনকি শারীরিক ও আত্মিকের মাঝামাঝি একটা অবস্থার কথা বোলতে চেয়েছেন।
এ পর্যন্ত পবিত্র মে’রাজ যেটুকু বোঝা গেল তা আংশিক মাত্র। মে’রাজের বিবরণে আমরা আরও পাই এই যে, জিব্রাঈল (আ:) রসুলাল্লাহকে (দ:) বোরাকে চড়িয়ে আল্লাহর কাছে নিয়ে যেতে এক একে সাত আসমান পার হোলেন। এই সাত আসমান সম্বন্ধে কোর’আন শরীফে কয়েকবার উল্লেখ আছে। এই সাত আসমান বুঝতে হোলে যে জ্ঞান প্রয়োজন বিজ্ঞান (Science) আজও তা সম্পূর্ণ সংগ্রহ কোরতে পারে নি, নিঃসন্দেহে বলা যায় ভবিষ্যতে পারবে। এবং যখন পারবে তখন সাত আসমানের অর্থাৎ মহাশূন্যের বিভিন্ন স্তর সম্বন্ধে বুঝতে পারবে। যেমন কোরে বিস্তৃতির (Dimension) জ্ঞান লাভের পর বিজ্ঞান বুঝতে পারছে যে, ওজুর পানি বয়ে যাবার আগে, দরজার শিকল নড়া থামবার আগে কেমন কোরে মহাবিশ্ব ঘুরে আসা যায়। শুধু তাই নয়, যদি মক্কার কাফের মোশরেকরা, যারা মেরাজের ঘটনাকে অবিশ্বাস কোরেছিল, তারা যদি মেরাজ সংঘটনের মুহূর্তে রসুলাল্লাহকে ঘিরে তার দিকে তাকিয়ে বোসে থাকতো, চোখের একটি পলকও না ফেলতো তবু তারা বুঝতে পারতো না যে, আল্লাহ কখন রসুলাল্লাহকে তাঁর দরবারে নিয়ে গেছেন আর কখন মেরাজ সংঘটন কোরে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়েছেন।