মোহাম্মদ আসাদ আলী:
রসুলাল্লাহর (সা.) এন্তেকালের ৬০-৭০ বছর পরই এ জাতি তাদের লক্ষ্য ভুলে গেল, তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ভুলে গেল। সারা পৃথিবীতে শান্তি, ন্যায়, সুবিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছেড়ে দিয়ে তারা পৃথিবীর অপরাপর রাজা-বাদশাহদের মত ভোগ বিলাসের সঙ্গে শাসন করতে লাগলো। আর যে যুদ্ধ তারা আরও কিছুকাল চালিয়ে গেল তা নিছক সাম্রাজ্যবিস্তারের যুদ্ধ।
তারা ভুলে গেল যে তারা আল্লাহর খলিফা, প্রতিনিধি। জাতির মধ্যে একটি শ্রেণি জন্ম নিল যারা দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েল রচনা করতে বসলেন। ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে ফতোয়া, পাল্টা ফতোয়া দিতে দিতে হাজার রকমের ফতোয়ার পাহাড় গড়ে উঠল। তাদের উপর ভিত্তি করে হাজারো ফেরকা আর মাজহাবে এক উম্মতে মোহাম্মদী খ- বিখ- হয়ে গেল।
এদিকে বিকৃত সুফিবাদী শ্রেণী জাতির মধ্যে বিস্তার লাভ করে উম্মতে মোহাম্মীর সংগ্রামী জীবনটাকে উল্টিয়ে একেবারে অন্তর্মুখী করে ফেলল। মানবজীবনে বিরাজিত অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে জুলুমের বিরুদ্ধে সত্য দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে পরিহার করে, গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত করে বিকৃত আধ্যাত্মিক সাধনায় তারা লিপ্ত হয়ে গেলেন।
এ কয়েকশ বছরে জাতির মধ্যে হাজার হাজার ফকীহ জন্ম নিলেন, বড় বড় আলেম জন্ম নিলেন, বহু গাউস কুতুব পীর দরবেশ জন্ম নিলেন, ইমাম জন্ম নিলেন, বড় বড় মুফাসসির মুহাদ্দিস জন্ম নিলেন। একেকজনের ক্ষুরধার লেখনীতে বিরাট বিরাট ভলিউম ভলিউম বই রচিত হলো। কিন্তু সেই আলী (রা.), খালেদ (রা.), মুসান্নাদের (রা.) মতো আর কেউ জন্ম নিল না।
জাতি সংখায় বাড়তে লাগল। সংখ্যায় কোটি কোটি হয়ে গেল। কিন্তু তাতে কি হবে? জাতি তখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে শিয়া, সুন্নী, শাফেয়ী, হাম্বলী, হানাফী ইত্যাদিতে বিভক্ত। তারা কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করবেন? বরং তারা নিজেরা নিজেরা একে অপরকে দোষারোপ করে মারামারি হানাহানি করতে লাগলো। কী দুর্ভাগ্যজনক! উম্মাহর ঐক্যের প্রতিক যে ক্বাবাঘর, সেই ক্বাবায় গিয়েও এই চার মাজহাবের অনুসারীরা একত্রে সালাহ (নামাজ) করতে পারেন নি। তারা কাবার চার কোণে চারটি মেহরাবসহ তাবু স্থাপন করে যার যার মাজহাবের ইমামের পেছনে নামাজ পড়েছেন শতাব্দির পর শতাব্দি।
দুর্দান্ত খরস্রোতা নদী যখন গতি হারিয়ে ফেলে তখন তাতে শেওলা আর কচুরিপানা জমে। এই জাতির ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। জাতির মাথার মধ্যেও পঁচন ধরেছে। যে জন্য আল্লাহর রসুল (সা.) এসেছিলেন অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে, সেই কাজের অর্ধেক কিন্তু তখনও রয়ে গেছে। এরই মধ্যে পঁচনক্রিয়া সমাপ্ত হয়ে পতনের কাল আসলো, অনিবার্য পরিণতি আল্লাহর শাস্তি আসলো। এর সতর্কবার্তাই আল্লাহ সুরা তওবার ৩৯ নম্বর আয়াতে দিয়েছিলেন। আল্লাহ কঠিন শাস্তি দিয়ে এই জাতিকে ইউরোপীয় জাতিগুলোর পায়ের তলার গোলামে পরিণত করে দিলেন। তখন তারা আল্লাহর দেয়া সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের দেয়া জীবন বিধান আমাদের উপর চাপিয়ে দিল। আমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের জীবনব্যবস্থা থেকে বহিষ্কৃত হয়ে গেলাম।
আমাদেরকে চিরকালের জন্য গোলাম বানিয়ে রাখতে তারা একটি শয়তানী বুদ্ধি করল। তারা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করল। স্বভাবতই সেই শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলিমদের জাতীয় ঐক্যের শিক্ষা দেওয়া হয় না, বরং পূর্ব থেকে যে অনৈক্য জাতির মধ্যে ছিল সেটাকেই তারা আরও পাকাপোক্ত করার বন্দোবস্ত করল। দীনের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তা নিয়ে তর্ক বিতক করা শিক্ষা দেওয়া হলো। আর দীনের অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন তওহীদ ও তওহীদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হলো যেন মুসলিমরা ইউরোপীয় শাসকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম না করতে পারে। জাতি গঠনের মূল যে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্য, সেই ঐক্যের গুরুত্ব শিক্ষা হলো না। সেই শিক্ষাই ১৪৬ বছর ধরে ব্রিটিশরা নিজেরা মাদ্রাসাগুলোর অধ্যক্ষপদে থেকে আমাদেরকে দিয়েছে। এভাবেই সেই ব্যক্তিগত মাসলা মাসায়েলের ইসলাম আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।