কাজী নজরুল ইসলাম:
আজ যে চারিদিকে এত কলহ কোলাহল, এর মানে হচ্ছে আমরা যতটা দেশের কল্যাণ চাইছি, তার চেয়ে বেশি চাইছি আত্মপ্রচার বা লোকপ্রতিষ্ঠা। কারণ যখনই আমরা বাইরের খোসা নিয়ে টানাটানি করি তখনই আমাদের অতৃপ্তির মাত্রা বেড়েই চলে অবশেষে লাঠালাঠি করে নিজেরা রক্তাক্ত হই, আর শত্র“রা হাসে। বাঙ্গালীর ভাবোচ্ছাস আছে, কর্মোন্মদনা আছে। কিন্তু যা নেই সে হচ্ছে জ্ঞান বা জিজ্ঞাসা; কিন্তু এই জিজ্ঞাসা না হলে ভেদ বিষাদের মীমাংসা কোনো কালেই হয় না।
আমাদের দেশের মূঢ় জড় জনসাধারণের, শুধু তাই কেন, তথাকথিত শিক্ষিতদের মনে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করার ও সনাতন ধর্মের নামে পুরাতন সংস্কারের দাসত্ব করার মতন মতি, এমন ভীষণভাবে শিকড় গেড়েছে যে, আমরা সত্য ন্যায়ের অনুরাধেও বাধা বিপদের কাঁটাবন কেটে নতুন পথ খুলে নিতে পারলে মুক্তি ও মঙ্গলের পথ অবাধ ও অব্যাহত করবার মত প্রেরণাও প্রাণে জাগে না। আমাদের এই দেহ মনের আড়ষ্টাতা এই যে আমাদের হাতে পায়ে খিল ধরে গিয়েছে একটু নড়ে চড়ে সত্যের বিরুদ্ধতার সাথে লড়ে এগোবার ক্ষমতা নেই, একে কি আমরা মানবতা বলতে রাজি আছি? আজ চাই আমাদের প্রতি কর্ম ও চিন্তুায় জীবনের প্রকাশ, প্রাণে চাঞ্চল্য, আর পরিপূর্ণ জীবনের জন্য বিপুল ব্যাকুলতা।
আর আমাদের নিরাশায় মুষড়ে পড়ে থাকার সময় নেই, সবাইকে মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে জাগতে হবে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে। আমাদের অন্তরে, বাহিরে, সমাজে, ধর্মে, রাষ্ট্রে মৃত্যুর বিষবীজ ছড়িয়ে আছে সে করাল কবল থেকে আমাদের রক্ষা পেতেই হবে আর তার জন্যে সর্বাগ্রে চাই স্বরাজ। মুক্তি পাগল মহাপ্রাণ চিত্তরঞ্জনের কাউন্সিল প্রবেশের প্রস্তাব অসহযোগীর কানে বেসুরো বাজতে পারে কিন্তু শুধু চরকা খদ্দর সম্বল করে দেশ যে কত কাল কোন্ সুদূর ভবিষ্যতের দিনে স্বরাজের আশায় পথ চেয়ে থাকবে তা বুঝতে পারি না। আর ঐভাবে মদালস গমনে গোরুর গাড়ির চালে চলনে আমাদের স্বাধীনতা আলেয়ার আলোর মত দূরে আরো দূরে সরে যাবে, মুক্তিদেবী হাততালি দিয়ে বলবেন, ‘ও তোর হাতের ফাঁসি রইল হাতে আমায় ধরতে পারলি না’আর খলখল করে উপহাসের হাসি হেসে চলে যাবেন। চরকা খদ্দরের আন্দোলন ও প্রচলনে দেশের লুপ্ত শিল্পের উদ্ধার হচ্ছে, এ দেশের রক্ত শোষণের কলটা বন্ধ হবার অনেকটা পথ হয়েছে বটে। কিন্তু কে না জানে যে, দানবী মায়ার অন্ত নেই, আর তার কুহক জালে জড়িয়ে পড়ে আমাদের সরলপ্রাণ ও শিশুর মত অজ্ঞান জনসাধারণ আবার ঠুঁটো জগন্নাথ হবে না, মায়ার লোভে ভুলে অমৃত ভাণ্ডের দিকে পেছন ফেরাবে না। গৌরগণ, কত যে প্রেমে জানে, কত যে যাদু জানে, তা কি আমাদের জানা নেই? টাকাটা সিকিটা কম দিয়ে বিলেতি কাপড় পেলে অনেকেরই সে মাথা ঠিক থাকে না অনেকেই সে ‘প্রেমে জল হয়ে যাই গলে,’ এ আমরা কলকাতা মফম্বল সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। এর মানে কি? তাহলে ত গান্ধী চিত্তরঞ্জনের কাতর আহ্বান সকলের প্রাণকে আলোড়িত করেনি, অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ না হলেও, আজো তা সার্থক হয়েছে বলে মনে হয় না। আজ এদেশের প্রত্যেকের প্রাণের প্রদীপ মুক্তির অগ্নিস্পর্শে জ্বলে ওঠা চাই, সমস্ত দেশে আজ নতুন করে নবজাগরণের বিপুল সাড়া জাগিয়ে তুলতে হবে, আজ এমন প্রচণ্ড আগুন জ্বালা চাই, স্বাধীনতার শান্তিবারি ছাড়া যার প্রশমন হতে পারে না। স্বরাজ সাধনায় শিশুর মত শুদ্ধি সরলতার আশ্যকতা আছে, স্বীকার যাই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন সে হচ্ছে যৌবনের শক্তি ও একান্ত নিষ্ঠা। আজ ছোট লোকটির মত ‘চলি চলি পা পা’ করে খানিকদূর এগিয়ে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়লে চলবে না। আজ যদি আমরা মুক্তির আলোর ঝরনায় অবগাহন করে নবজন্ম ও নতুন চেতনা লাভ করে থাকি তাহলে আমাদের অহিরাবণের মত বীরবিক্রমে যুদ্ধসাজে সজ্জিত হতে হবে।
আমলাতন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের শক্তি পরীক্ষা করতে হলে কাউন্সিল ভেঙ্গে দেওয়া যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন, যারা পূর্ণ মুক্তির বিরোধী তাদের শাসনযন্ত্র হতে বেদখল করা এবং বুরোক্রেসি শাসন যে নেহাত ভুয়ো ছেলেখেলা ও আমাদের সকল অমঙ্গলের আদি নিদান তা প্রতিপন্ন করে গভর্নমেন্টের গিল্টি করা, মুখোস খুলে তার বিকৃত স্বরূপ ভালো করে দেখতে পারা যে একান্ত দরকার আর তাতে যে অসহযোগীদের ভাগবত অশুদ্ধ হবে না এই হচ্ছে এক দলের মত। সত্যি মুক্তি সাধনকে একটি গৌণ কর্ম মনে করে আমরা যে সকলেই পুরানো থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের তালিম দিচ্ছি এটি নিতান্ত অসহ্য ব্যাপার, কিভাবে আমাদের শক্তি, তেজ উঠে নিভে যাচ্ছে তাতে আমরা যে এগিয়ে না গিয়ে পেছিয়ে যাচ্ছি তা অস্বীকার করা চলে না। আমলাতন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের শক্তি পরীক্ষা করতে হলে কাউন্সিল ভেঙ্গে দেওয়া যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন, যারা পূর্ণ মুক্তির বিরোধী তাদের শাসনযন্ত্র হতে বেদখল করা এবং বুরোক্রেসি শাসন যে নেহাত ভুয়ো ছেলেখেলা ও আমাদের সকল অমঙ্গলের আদি নিদান তা প্রতিপন্ন করে গভর্নমেন্টের গিল্টি করা, মুখোস খুলে তার বিকৃত স্বরূপ ভালো করে দেখতে পারা যে একান্ত দরকার আর তাতে যে অসহযোগীদের ভাগবত অশুদ্ধ হবে না এই হচ্ছে এক দলের মত। সত্যি মুক্তি সাধনকে একটি গৌণ কর্ম মনে করে আমরা যে সকলেই পুরানো থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়ের তালিম দিচ্ছি এটি নিতান্ত অসহ্য ব্যাপার, কিভাবে আমাদের শক্তি, তেজ উঠে নিভে যাচ্ছে তাতে আমরা যে এগিয়ে না গিয়ে পেছিয়ে যাচ্ছি তা অস্বীকার করা চলে না।
আর একদল হচ্ছেন পুরাতন পন্থী তাঁরা পরিবর্তন চান না, কাউন্সিলে গেলে দেশের কথা মনে থাকবে না মন সাহেবি খানায় বিগড়ে যাবে। তারপর কাউন্সিলের জন্য ভোট একচেটে করে দেওয়া, কর্তাদের কাউন্সিল বাতিল করে দেওয়া যাবে না ও এমন বিষয় নয়, যা নিয়ে শক্তি ক্ষয় করে কোন সুসার হবে। আর যে জিনিসকে অশুচি বলে বর্জন করা হয়েছে তার সংস্রব থেকে দূরে না থাকলে আত্মা অশুদ্ধ হয়ে পড়বে।
কাউন্সিলে গিয়ে তার ফটক আটকে দিয়ে কেল্লা ফতে যারা করতে চাইছেন, আর যারা বলছেন ও স্থান মাড়ালেই মহাপাপ, এদের দু দলকেই জিজ্ঞাসা করছি’ যে, তাঁরা দু’দশটি সুখের পায়রা, ননীর পুতুল কি মুক্তি সংগ্রামের জন্য যে শক্তির প্রয়োজন তা ধারণ করেন? তাঁরা লড়বেন যে সব লড়িয়ে সেপাইদের নিয়ে, তাদের আশা আকাক্সক্ষার সঙ্গে তাঁদের পরিচয় আছে কি? তাদের অন্তরের বেদনার সন্ধান করে তার প্রতিকারের পথ দেখাবার জন্য ত অগ্রসর হতে হবে। তাদের শুষ্ক শূন্য জীবনের সুখ ও শক্তির রুদ্ধ উৎসটি ত খুলে দিতে হবে। শুধু নৈবিদ্যির চিনি দিয়ে ত দেবতার তৃপ্তি হবে না। আজ প্রচুর অন্নের ব্যবস্থা চাই, যারা দেশের শিরদাঁড়া তাদের শক্ত করতে হবে। নীচের মানুষদের টেনে উপরে তুলতে হবে তাদের মনে মুক্তি প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারলে পথ আপনি ঠিক হয়ে যাবে। কাউন্সিল করতে হবে কি না হবে তা নিয়ে আজ লাঠালাঠি করে ফল নেই, ও দড়ি এত শক্ত নয় যে, দুদিকের অত ভীষণ টান সইতে পারে, এতে নিজেদের পতনের পথই প্রশস্ত হচ্ছে। এ ঝগড়া কি ধামাচাপা দেওয়া যায় না, কাউন্সিল স্বরাজের কি গয়ায় পিণ্ডিদান হয় না?
দেশের কাজ পল্লীগঠন করতে হবে। মূক মৌনমুখে মুক্তির কলরব জাগিয়ে তুলতে হবে। সকল প্রকার মিথ্যা অত্যাচারের বিরুদ্ধে যাতে জনসাধারণ অকুণ্ঠচিত্তে পরিপূর্ণ বিদ্রোহ করতে পারে, তার ব্যবস্থা চাই, আর তা না হলে শুধু ভদ্রলোকের জটলাতে স্বরাজের পাকা বুনিয়াদের প্রতিষ্ঠা হবে না এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য চাই এই অগণিত জনসাধারণ যাতে পূর্ণ অধিকার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ হয়, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল রকম অবিচার কদাচারের বিরুদ্ধে, অন্তরে ভগবত্তার স্পর্শ ও অনন্ত শক্তি অনুভব করে, মাথা খাড়া করে দাঁড়াবার মত বল পায় সেইজন্য চেষ্টা ও আন্দোলন করা। এই ছত্রভঙ্গ ছিন্নভিন্নবিবাদ ক্ষিপ্ত বিরাট জনশক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ ও চালিত না করতে পারলে অত্যাচারীর দম্ভকে স্তম্ভিত করা যাবে না। আজ সেই সাধক ও সিদ্ধ নেতা কোথায়, যিনি এই দীনহীন জীর্ণ মলিন আচণ্ডাল ভারত সন্তানের বিষণ্ণ মুখে হাসির ও তেজের আলো ফুটিয়ে তুলবেন বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তাই বলছিলাম মুশকিল!