রিয়াদুল হাসান:
দাজ্জাল নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া, গণমাধ্যমের অবিশ্রান্ত, নিরবচ্ছিন্ন অপপ্রচারের ফলে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলি, যার মধ্যে কোন কোন দেশের ৯৮% মুসলিম, তারা স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে দাজ্জালের সৃষ্ট জীবনব্যবস্থা বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র ইত্যাদি গ্রহণ করেছে এবং ফলে তারা অন্যায়, অশান্তি, অবিচার, নানাবিধ সংঘর্ষে, রক্তপাতে নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন করছে।
দাজ্জাল কীভাবে তার গণমাধ্যমকে সাম্রাজ্যবিস্তারে কাজে লাগাচ্ছে তার একটি উদাহরণ ইরাক। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই অভিযোগ তুলেছিল পাশ্চাত্য শক্তি। আসল উদ্দেশ্য ছিল সাদ্দাম হোসেনকে শায়েস্তা করা ও ইরাক দখল করা। এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমাবিশ্ব একযোগে প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে প্রপাগান্ডা শুরু করল। বিখ্যাত বিখ্যাত গণমাধ্যমগুলো বিবিসি, সি এন এন- ইত্যাদি সকল গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেল সাদ্দাম হোসেন। ভাবে মনে হলো পৃথিবীর সমস্ত অশান্তি, সন্ত্রাস, হানাহানি, দুঃখ, যন্ত্রণার মূল কারণ সাদ্দাম। টকশো-সম্পাদকীয় সবখানে শুধু সাদ্দাম।
তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। একটি সরকার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেল, হাজার বছরের ব্যবিলনীয় সভ্যতা, মুসলিম সভ্যতার ক্ষেত্র ইরাক ধ্বংস¯তূপে পরিণত হলো, ১০ লাখ বনি আদম (মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, নাস্তিক, পারসিক) মাটির সাথে মিশে গেল। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের খনিজ সম্পদ বোমার আঘাতে ধ্বংস হলো, লুট হলো। এখন ইরাক এক মৃত্যুপুরি যেখানে সর্বদা আতঙ্ক বিরাজ করে। যে কোনো মুহূর্তে বোমার আঘাতে মানুষ নিহত হয়। আর এই ঘটনার নায়ক জর্জ বুশ হোয়াইট হাউজে দাড়িয়ে বলেন, ‘আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্টে ভুল ছিল। তার বিশ্বস্ত অনুচর টনি ব্লেয়ার বলেন, ‘ইরাক আক্রমণ আমাদের ভুল ছিল।’
এই ভুলের খেসারত দিতে গিয়ে নির্মম পরিণতি নেমে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যা সেই এলাকা থেকে ক্রমশ চতুর্পার্শ্বে সম্প্রসারিত হচ্ছে। সিরিয়ার লক্ষ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে পথে পথে ঘুরছে। সেখানে তাদের মানবেতর জীবের মতো ঘৃণা বিদ্বেষের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। বিশ্বনেতাদের ‘ভুলের’ পরিণতিইে জন্ম হয়েছে আইএস-এর। ব্রিটিশ নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, ‘আই.এস. আমেরিকা-যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি।’ ‘সাদ্দাম হোসেন উৎখাতে ইরাক আক্রমণের ফলেই আইএস সৃষ্টি হয়েছে’- বলে মন্তব্য করেছেন আমেরিকার সাবেক রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান রন পল। এমনকি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও এই সত্যটি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ‘আইএস উত্থানে বুশ দায়ী’। (আমাদের সময়.কম : ১৫/১১/২০১৫)
একই সত্য আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন সব দেশের বেলায় প্রযোজ্য। বলতে গেলে শুধুই কলেবর বৃদ্ধি পাবে।
যাই হোক, যে কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমাদের মিডিয়াকে মনে রাখতে হবে আমাদের দেশটি উন্নয়নশীল দেশ। এখনো এখানে দারিদ্র্য দূরীকরণের লড়াই চলছে। ১৯৭১ সনে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। এখানে আমাদের বড় সংকট জাতীয় ঐক্য। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে একদিনের জন্যও জাতিটিকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় ন। এখানে সেই পশ্চিমারা যাকে ফোকাস করবে তাদের দেখাদেখি আমরাও তা ফোকাস করব, তারা যেটাকে সমাধান বলবে আমরাও সেটাকেই সমাধান মনে করব এই অন্ধ অনুকরণের নীতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় আমাদের মেরুদণ্ড কোনোদিনও ঋজু হবে না, আমাদের স্বাধীনতাও অর্থপূর্ণ হবে না। অনেকে বলতে পারেন যে বর্তমান যুগে বিশ্ব একটি গ্রামের মতো। বিশ্বব্যবস্থার বাইরে আমরা চলতে পারব না। আমরা বলব তা সত্ত্বেও আমাদের ভুললে চলবে না যে পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, বস্তুবাদী, যুদ্ধোন্মাদ পশ্চিমা দানব মানবজাতিকে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে প্রায় ১৩ কোটি বনি আদমকে হত্যা করেছিল। সেই থেকে যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র, সংঘাত, রক্তপাত একদিনের জন্যও বন্ধ হয় নি। এখন তারা গণতন্ত্র, মানবতা, বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার ইত্যাতি চাতুর্যপূর্ণ শব্দ আউড়িয়ে ভালো মানুষ সেজেছে। অথচ তাদেরই লোভের পরিণামে মানবজাতি আবার আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। ভয়, আতঙ্ক আর ত্রাস ঘিরে ধরেছে প্রতিটি দেশকে। এখনই যদি আমরা এই অন্যায়কে চিহ্নিত না করি তবে যদি যুদ্ধ মহাযুদ্ধ করতে করতে সমগ্র মানবজাতি ধ্বংস হয়, সেই ধ্বংস থেকে এই জাতিও অর্থাৎ আমরাও বাঁচতে পারব না।
সত্য সত্যই, মিথ্যা মিথ্যাই।
প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে আমাদের সাংবাদিকতার নীতি কী হওয়া উচিত। আমাদের সেই চিরন্তন, সনাতন, চির সত্য নীতি গ্রহণ করতে হবে। সেটা হচ্ছে- যা সত্য সত্যই, যা মিথ্যা মিথ্যাই। অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মিশ্রিত করে, সত্যের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই সেখান তা দিয়ে সংবাদ তৈরি করা, তিলকে তাল করা, এমন কি তিলও নেই সেটাকেও স্বার্থের প্রয়োজনে তাল বানিয়ে ফেলা, শব্দ বাক্যের চাতুর্যপূর্ণ ব্যবহারের দ্বারা ভালোকে মন্দ বানিয়ে ফেলা যাবে না। এই প্রবণতা পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু আইন করে সংবাদমাধ্যমগুলোকে পরিচ্ছন্ন ও মিথ্যমুক্ত রাখা যাবে না। আমাদের প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট আছে, তথাপি নতুন নতুন ফাঁক ফোকর খুঁজে তা ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে সেগুলো বন্ধ করতে আরো বহু আইন, ধারা উপধারা তৈরি করা হয়েছে। তবু সাংবাদিকদেরকে জনগণ সুযোগসন্ধানী বলেই মনে করছে। এ প্রসঙ্গে গত ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও একাত্তর টেলিভিশনের অ্যাফেয়ার্স এডিটর সামিয়া রহমানের লেখা চোখে পড়ল। তিনি খুব সরলভাবেই এই সত্যটি স্বীকার করে নিয়ে লিখেছেন “… গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে যে, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ এবং তা প্রচার ও প্রসারের জন্য তারা এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। … সত্যি কি আমার গণমাধ্যমকর্মীরা এখন মানুষের চিন্তার দিক পরিসর ঠিক করে দেওয়া দায়িত্ব নেওয়ার নামে প্রহ্মাণ্ডের মহাপ্রলয় ঘটাতে যাচ্ছি?
একটি অন্যায় শত অন্যায়ের জন্ম দেয়
এটি শুধুমাত্র ধর্মের আপ্তবাক্য নয়, এটি প্রাকৃতিক সত্য যে একটি মিথ্যা শত শত মিথ্যার জন্ম দেয়। একটি সমাজে যখন মিথ্যা চলতে থাকে অন্য সচেতন মানুষগুলো সেই মিথ্যাকে প্রমোট করে তখন সমাজে মিথ্যা আসুরিক রূপ নিয়ে সবাইকে গ্রাস করে, আজ নয়তো কাল। মিথ্যার একটি বিষধর সাপ, তাকে দুধ কলা দিয়ে যতই প্রতিপালন করা হোক, একটা সময় সে তার প্রভুকেও ছোবল দিতে ছাড়ে না। হয় আজ নয় কাল।