মনিরুল ইসলাম:
আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির পটভূমি (যা আমরা সুরা বাকারার ৩০ নং আয়াত থেকে জানতে পাই) বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হলো, আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট মালায়েকদের ডেকে বলেছিলেন যে, আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা সৃষ্টি করতে চাই। তিনি কিন্তু বলেন নি যে মানুষ সৃষ্টি করতে চাই। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, খলিফা সৃষ্টি করবেন। এই খলিফা শব্দের ভেতরেই রয়েছে আল্লাহর মানুষ সৃষ্টির রহস্য এবং পৃথিবীতে আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেওয়া মানবজাতির কাজ। সৃষ্টির (মানুষের) প্রতি স্রষ্টার (আল্লাহর) একমাত্র দাবি ফুটে উঠেছে এই শব্দের ভেতরেই। আসুন দেখে নেই আল্লাহ খলিফা বলতে কি বুঝিয়েছেন?
যে খেলাফত করে সেই খলিফা। মানবজাতি যখন আল্লাহর খেলাফত করবে তখনই তারা আল্লাহর খলিফা হিসেবে পরিগণিত হবে।
খেলাফত হচ্ছে কেউ তার নিজের কাজগুলো নিজে না করে যদি সে সেগুলি করার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে অন্য কাউকে নিযুক্ত করে তবে তাকে খেলাফত অর্থাৎ প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হলো এবং সেই নিযুক্ত লোকটি হলো খলিফা। আল্লাহ আদম (আ.) অর্থাৎ বনী আদম, মানবজাতিকে তাঁর খলিফা নিযুক্ত করলেন, এবং করলেন তাঁর মহাসৃষ্টির, মহাবিশ্বের মধ্য থেকে শুধু এই পৃথিবীতে। বললেন – ‘ফিল আরদি খালিফাতুন’ অর্থাৎ পৃথিবীতে, অন্য কোথাও নয়। তাহলে খলিফা হিসেবে পৃথিবীতে মানবজাতির কাজ কী? কর্তব্য কী?
বনী আদমকে, মানুষকে তাঁর খলিফা, প্রতিনিধি নিযুক্ত না করলে আল্লাহর যে কাজ ছিল সেইটাই হলো মানুষের কাজ, কর্তব্য। কী সেই কাজ? আল্লাহর কী কাজ? আল্লাহর কাজ হলো শাসন। নিজের সৃষ্ট এই মহাবিশ্বকে শাসন করাই হলো তাঁর কাজ। পৃথিবীতে এই কাজটা তিনি নিজে না করে দায়িত্ব দিলেন মানুষকে; অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর হয়ে , তাঁর খলিফা, প্রতিনিধি হয়ে পৃথিবীতে শাসন করবে। কেমন করে করবে? আল্লাহ যেমন সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে মহাবিশ্ব শাসন করছেন, যে আইন-কানুন, নিয়মনীতি দিয়ে শাসন করছেন সেই আইন-কানুন, নিয়মনীতি তাঁর খলিফাকে দিয়ে বললেন – এইগুলি অনুযায়ী তোমরা তোমাদের শাসনকার্য পরিচালনা করবে। এটাই হলো তোমাদের ইবাদত যে জন্য তোমাদের আমি সৃষ্টি করেছি।
কাজেই মানবজাতির প্রতি আল্লাহর দাবি একটাই। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর সার্বভৌমত্বভিত্তিক পাঠানো দ্বীন উল হক দিয়ে নিজেদের সমষ্টিগত জীবন পরিচালনা করা।
ঠিক এই দাবির বিপরীতে আজ দাঁড়িয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক দ্বীনের বিপরীতে সে দাঁড়িয়েছে মানুষের সার্বভৌমত্বভিত্তিক দ্বীন তথা নানা তন্ত্র-মন্ত্রকে মেনে নেওয়ার দাবি নিয়ে। মানবজাতি ইতোমধ্যেই আল্লাহর দাবিকে (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব) প্রত্যাখ্যান করে পাশ্চাত্যদের দাবিকে (মানুষের সার্বভৌমত্ব) মাথা পেতে নিয়েছে। বর্তমানে মানবজাতির রব পাশ্চাত্য ইহুদি-খ্রিস্টান সভ্যতা। মুসলিম নামধারী এই জাতিটিসহ সমস্ত পৃথিবীর এক ইঞ্চি মাটি বা পানি নেই যা তাদের প্রভাব বলয়ের বাইরে। তারা অস্ত্রের শক্তিতে মহা-শক্তিধর হয়ে মানবজাতিকে বলছে, তোমরা আমাকে প্রভু (রব) বলে স্বীকার করো, আমার আদেশ পালন করো, এবং তোমরা স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব (উলুহিয়াহ্) ত্যাগ করে মানুষের সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করো। স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব অনেক পুরানো ব্যাপার, ওটা অকেজো হয়ে গেছে। তবুও তোমরা যার যার ধর্ম পালন করো কোনো সমস্যা নেই। মুসলমান, তোমরা যত খুশি লম্বা দাড়ি রেখে, মোছ কেটে ফেলে, পাজামা হাঁটু পর্যন্ত টেনে উঠিয়ে মসজিদে দৌঁড়াও, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নামাজ পড়ো, আমার কোনো আপত্তি নেই; খ্রিস্টান, তুমি লম্বা জোব্বা পরে, গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে, গীর্জায় যেয়ে যত খুশি নীতি-বাক্য, বক্তৃতা করতে চাও করো, আমার কোনো আপত্তি নেই; বৌদ্ধ, তুমি গেরুয়া বসন গায়ে দিয়ে, মাথা ন্যাড়া করে, ভিক্ষা করে খাবার সংগ্রহ করে প্যাগোডায় যেয়ে বুদ্ধের মূর্তির সামনে বসে যত খুশি ‘বুদ্ধং’ স্বরণং গচ্ছামী, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামী’ গাও কোনো আপত্তি নেই; হিন্দু, তুমি নামাবলি গায়ে দিয়ে কপালে সিঁদুর আর চন্দনের ফোটা দিয়ে তোমাদের হাজারো রকম মন্দিরের যেটায় খুশি যেয়ে হাজারো রকম মূর্তির সামনে বসে ঘণ্টা বাজাও, কোনো আপত্তি নেই; ইহুদি, তোমরা লম্বা আলখাল্লা গায়ে দিয়ে মাথায় উঁচু টুপি পরে, বুকে ডেভিডের স্টার ঝুলিয়ে সিনাগগে যেয়ে প্রার্থনা করো, কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি তো নেই-ই, বরং এগুলো তোমরা যত বেশি করবে আমি তত খুশি হব; কারণ তোমরা ওগুলো নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত থাকবে আমি তত নিরাপদ হব।
এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইতোমধ্যেই মানবজাতি আল্লাহর একমাত্র দাবি অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে এর ফল মানবজাতি এড়াতে পারছে না। সমস্ত পৃথিবীতে আজ অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। মানবজাতির ইতিহাসে তারা আজকের মত এত কঠিন পরিস্থিতির শিকার আর কখনও হয়নি। পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে মানবজাতির অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। এখনও যদি তারা তাদের সার্বিক জীবন থেকে পাশ্চাত্য ইহুদি-খ্রিস্টান ‘সভ্যতা’র সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা না করে তবে তাদের ধ্বংস অনিবার্য।