সুলতানা রাজিয়া:
যে জ্ঞান মানুষের কোনো কল্যাণে লাগে না, মানুষকে শান্তি আর নিরাপত্তা দিতে পারে না, মানবতাকে সমুন্নত করে না- সে জ্ঞান নিরর্থক, মূল্যহীন। যে মহামানবদের আবির্ভাবে মানবসভ্যতা ধন্য হয়েছে তাদের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তারা কেউই স্বার্থের পেছনে দৌঁড়ে এই অমরত্ব লাভ করেন নি। তারা শুধু মানবতার কল্যাণের জন্য, মানুষকে ন্যায়-শান্তি আর নিরাপত্তাপূর্ণ জীবন উপহার দেওয়ার জন্য নিজেদের সমস্ত জ্ঞান, মেধা, শ্রম এবং তাদের পার্থিব সম্পদ, এমন কি নিজেদের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে গেছেন।
মানবজাতি এখন একটি বিরাট সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ আজ অন্তরে দেউলিয়া, বাইরে দিশেহারা। কোথায় গেলে শান্তি পাওয়া যাবে, কি করলে শান্তি আসবে এসব চিন্তায় তারা দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছে। কোনো ব্যবস্থাতেই তারা কাক্সিক্ষত শান্তি পাচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বে অগণিত শান্তি-সংঘ শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে কোটি কোটি ডলার খরচ করে যাচ্ছে, তবুও বিশ্বজুড়ে এ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণ কি? এর কোনো সদুত্তর তারা খুঁজে পাচ্ছে না।
এই সংকট থেকে যারা পৃথিবীকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন বলে মনে করা হয় তারা তা সফলভাবে করতে পারছেন না – এর কারণ তাদের মানবজাতি ও মানবজীবন সম্পর্কে আকীদার (সামগ্রিক ধারণা) ত্রুটি। একটি বস্তুর নির্মাতাই জানেন সে বস্তুটি তৈরির পেছনের রহস্য। বস্তুটি নষ্ট হলে কীভাবে ঠিক করতে হবে তাও তার জানা। অন্য কেউ যত জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান হোক না কেন সেই বস্তুটির সম্পর্কে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা অর্জন করতে পারে না। ঠিক সেভাবে মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টি। সুতরাং স্রষ্টাই ভাল জানেন তাঁর এই সৃষ্টি কীভাবে শান্তিতে আর নিরাপত্তায় থাকতে পারবে। এর জন্য তিনি যুগে যুগে তাঁর নির্ধারণ করা মহাপুরুষদের কাছে সেই শান্তিপূর্ণ জীবনবিধান পাঠিয়েছেন। যখনই স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে তখনই কেবল সমাজ-সংসার শান্তি আর নিরাপত্তায় পরিপূর্ণ হয়েছে। এটা কোনো কল্পকথা নয়, এটা ইতিহাস। নিকট অতীতের ইসলামের স্বর্ণযুগের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সনাতন ধর্মের রাম রাজত্বের কথা, দাউদ (আ.), সোলায়মান (আ.) এর শাসনামলের কথা বলা যেতে পারে। শেষ রসুলের সময়ে অর্ধপৃথিবীতে এমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছিল যে, ধনীরা উটের পিঠে খাদ্য ও সম্পদ বোঝাই করে নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরত কিন্তু গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেত না। এমন সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, একা একটা যুবতী মেয়ে, দামী অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় শত শত মাইল নির্ভয়ে পাড়ি দিতে পারতো। নামাজের সময় হলে স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে মানুষ মসজিদে চলে যেত। এটা যদি শান্তি না হয় তবে শান্তি কাকে বলে? এই রকম একটা শান্তি আর নিরাপত্তাপূর্ণ সমাজ কি মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত ব্যবস্থা দিয়ে কখনও তৈরি করা গেছে? কখনও যায় নি, এবং যাবেও না। কারণ মানুষ নিজেই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়, সে কী করে স্রষ্টার ন্যায় ত্রুটিহীন দীন তৈরি করতে পারবে?
যখনই মানবজাতি স্রষ্টার তৈরি এই জীবনব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে নিজেরা নিজেদের সুবিধামতো করে জীবনব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে তখনই সেখানে স্বার্থেল মিশেল ঘটেছে এবং ক্রমে তারা অন্যায়-অশান্তিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
মানবজাতি গত কয়েকশ’ বছরে একের পর এক বেশ কিছু জীবনপদ্ধতি পুঁজিবাদ, সাম্যবাদ, গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছে। কিন্তু শান্তি আসে নি বলেই নতুন নতুন ব্যবস্থার দিকে তারা ধাবিত হয়েছে। এইভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে আমরা এখন একটি পারমাণবিক যুদ্ধের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। আর কতদিন এভাবে বৃথা সময়ক্ষেপণ করবে মানবজাতি? মানুষের যদি সেই যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকতো যে সে নিজের জন্য এমন একটি জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারে যা অনুসরণ করলে সে একাধারে মানুষ হিসাবে উন্নত হবে এবং অন্যান্য জাগতিক সর্ববিষয়ে প্রগতির মধ্যে বাস করবে, তাহলে সে তা এতদিনে করতে পারত। গত কয়েক হাজার বছরে অগণিত উল্লেখযোগ্য জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী, পদ্ধতি, বিশ্লেষক অতীত হয়ে গেছেন। মানবসভ্যতার অগ্রগতিতে তাদের বিপুল অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তারা একটা জায়গায় ব্যর্থ, সেটা হচ্ছে তারা মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তা উপহার দিতে পারেন নি। পুলিশি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেও লাভ হয় নি। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় তারা রোধ করতে পারেন নি বলে অপরাধগুলো প্রতিনিয়ত বেড়েছে। যখন মানুষ প্রযুক্তিগত দিক থেকে অকল্পনীয় উন্নতি সাধন করেছে, আকাশ-মহাকাশ তার হাতের মুঠোয়, তখন তারা পৃথিবীতে কী করে শান্তি আসবে সেটা কেন আবিষ্কার করতে পারছে না, কেন একটি নিখুঁত জীবনব্যবস্থা তারা প্রণয়ন করতে পারছে না?
কারণ একটাই। তারা আদৌ জানেই না মানুষ কিভাবে ভাল থাকতে পারে, কীসে সে সুখী হয়, কীসে বেদনাক্লিষ্ট হয়, কীসে মানুষের রিপু সংযত হয়। এটা সে জানে না কারণ মানুষের জটিল মনস্তত্বের কিয়দাংশও তার জ্ঞাত নয়। সেটা তিনিই জানেন যিনি এই মস্তিষ্কের স্রষ্টা, যিনি মানুষের অন্তরের খবরও রাখেন, যিনি অন্তরেরও স্রষ্টা। এই জন্যই তাঁর তৈরি জীবনব্যবস্থা, দীন চিরন্তন, শাশ্বত, সনাতন, সহজ-সরল, প্রাকৃতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ। স্রষ্টার দেওয়া জীবনব্যবস্থা পৃথিবীর সকল স্থানে প্রয়োগযোগ্য, সকল জাতি, সকল নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, সকল ধর্মের মানুষের জন্য প্রযোজ্য, সকল আবহাওয়ার জন্য উপযুক্ত। মানুষের পক্ষে এমন একটি জীবনব্যবস্থা তৈরি করা কখনই সম্ভব নয়। তার প্রমাণ মানুষের অতীত। এভাবে আরও কোটি বছর পার হয়ে গেলেও সমস্ত মানুষ মিলেও তাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত জীবনব্যবস্থা তৈরি করতে পারবে না। এই ঘোষণা মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বার বার দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, হে রসুল! আপনি সমগ্র বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিন, যদি পৃথিবীর সকল মানুষ ও জিন একত্রিত হয়ে এই কোর’আনের মতো কিছু আনয়ন করতে চেষ্টা করে এবং পরস্পর-পরস্পরকে সহযোগিতা করে তারপরও কখনও তারা তা আনতে সক্ষম হবে না (সূরা বনী ইসরাঈল-৮৮)।