মুক্তবুদ্ধির চর্চা আসলে কী? বুদ্ধিকে কে বন্দীকে করে রেখেছে যে তাকে মুক্ত করার প্রয়োজন পড়লো? এর উত্তর সকলের জানা। যুগে যুগে ফতোয়ার চোখরাঙানি মানুষের স্বাধীন বিবেচনা শক্তিকে আবিষ্ট করে ফেলতে চেয়েছে। যারা চিন্তাহীন নির্বোধ পশুতে পরিণত হয় নি তারাই সেই ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে মাথা সোজা করে দাঁড়িয়েছেন। মুক্তবুদ্ধির চর্চা তাই মানবজাতির চিন্তার অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। কিন্তু আজকের এই প্রতারণার যুগে সবকিছুর সংজ্ঞা একরকম আর প্রয়োগ সম্পূর্ণ উল্টো রকম। এটা যুগের ধর্ম। দুধের মধ্যে বিষ, মানুষের মধ্যে শয়তান, গণতন্ত্রের মধ্যে ফ্যাসিবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা। পৃথিবীতে অবৈধ বলে কিছু নেই, অবৈধ কেবল ধর্ম। তাইতো আল্লাহ-রসুলের নামে অশস্নীল সাহিত্য রচনাকে মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বাক স্বাধীনতা বলে চালু করে দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবাধ বিদ্বেষ আর মিথ্যা প্রপাগান্ডার পথ সুগম করার উদ্দেশ্যে কথিত মুক্তমনারা বলে “”MUZZLE ME NOT” – আমাকে বলতে দাও। ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের কথা বলার অধিকার দেওয়ার জন্য সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় পর্যায়ে হাক ডাক ফেলে দেন। কিন্তু অন্য বহুক্ষেত্রে তারা নীরব থাকেন। যাদের উদারতা দেখে মুক্তমনাদের আঁখি ফেরে না, সেই পশ্চিমা বিশ্বে মুক্তবুদ্ধির চর্চা কতটুকু হচ্ছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্পর্কে কুৎসামূলক বুগ বা পর্নোগ্রাফিক সাহিত্য সৃষ্টি করে নয়, মাতাল অবস্থায় কিছু গালাগালি করায় ল্যুক অ্যাঞ্জেল নামের এক ব্রিটিশ তরম্নণকে চির জীবনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১০ এর সেপ্টেম্বরে। ঐ তরুণের পক্ষে মার্কিনি বুদ্ধিজীবীরা জনমত তৈরি করার প্রয়োজন বোধ করেন নি, কিন্তু আল্লাহ-রসুলকে নিয়ে কুৎসা রচনার অধিকার সংরক্ষণ করতে সবাই কী তৎপর!
আসলে ‘মুক্তমনা’রা কী বলতে চায়? তাদের সব কথার পেছনের কথাটি কী? সাদা ভাষায় তাদের মূল চাহিদা আপাতত অবাধ ইন্দ্রীয় সম্ভোগের সুযোগ সুবিধা; যেমন সমাজে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা থাকবে না, ব্যভিচার শব্দটি ডিকশনারিতেও থাকবে না। যে কেউ যে কারও সঙ্গে (রক্তীয় সম্পর্কসহ) যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে, সমকামিতার অধিকার থাকবে, যে কেউ সর্বত্র নগ্ন থাকতে পারবে, মদ্যপানকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হবে। ইন্দ্রিয়সুখের বিরুদ্ধে যে কোনো কথাই তাদের গায়ে জ্বালা ধরায়। প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের এই স্বপ্নের সমাজ কত দূরে? ইতোমধ্যেই ইউরোপ, আমেরিকার অনেক দেশে মানুষের এ ‘অধিকারগুলো’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর আমাদের এখানে এখনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি, কারণ মানুষের বুদ্ধি এখনও ধর্মের ‘কারাগারে’ বন্দী। বলা হয়ে থাকে, পশ্চিম জ্ঞানভিত্তিক – প্রাচ্য বিশ্বাসভিত্তিক। এ বন্দিদশা থেকে মানুষের মনকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই তথাকথিত প্রগতিশীল মুক্তমনারা শপথ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের এ প্রচেষ্টা কতটুকু সফল হয়েছে এবং হবে সেটা বর্তমানের প্রেক্ষাপটে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ইস্যু। কারণ কম্পাসের কাঁটা এখন আবার উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করেছে।
ইউরোপীয় জাগরণের উত্তর যুগের দার্শনিকগণ যুক্তিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, আদর্শবাদ সহ বিভিন্ন রাজনীতিক দর্শন আবিষ্কার করলেন। এটা করতে হলো কারণ ভাববাদী দর্শন তথা ধর্মগুলো বহু আগেই মানবকল্যাণের উপযোগিতা হারিয়েছিল। সেই আদ্যিকালের ধ্যানধারণা ঝেড়ে ফেলতে হলে বিকল্প ধ্যানধারণা দাঁড় না করালে চলবে কী করে? তাই শূন্যতা পূরণ করতে তথা যুগের চাহিদাই এসকল দার্শনিকদের সৃষ্টি করেছিল। এদের নামের লিস্টি ও কাজের তালিকা অনেক লম্বা। আমাদের বিষয় ধর্মকে বাদ দিয়ে মানবজাতির জীবন পরিচালনার যে স্বপ্ন তারা দেখেছিলেন সেটা কতটুকু পূরণ হলো। উপরোক্ত দার্শনিকদের মধ্যে কিছু আছেন রাজনীতিক দার্শনিক যাদের মতবাদ বিশ্বের ইতিহাস এবং মানুষের চিন্তাধারাকে পাল্টে দিয়েছে। তাদের মধ্যে থমাস হবস, জ্যাক রুশো, স্পিনোজা, ইমানুয়েল কান্ট, ডেভিড হিউম, কার্ল মার্কস, হেগেলস, ফেডরিখ এঙ্গেলস, স্টুয়ার্ট মিল প্রমুখের নাম না করলেই নয়। যুগটা ছিল বাণিজ্যিক উপনিবেশ সৃষ্টি আর সাম্রাজ্য বিন্তরের। ইউরোপের দেশগুলো নতুন যুগশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে বণিকের বেশে দিকে দিকে দেশ দখলের অভিযান চালালো। যেখানে তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল সেখানেই চেষ্টা করল তাদের নিজ দেশের রাষ্ট্রনীতি, সংস্কৃতি ও দর্শনকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য, যাতে করে আধুনিক দাসদের মন-মগজ নিজেদের চিন্তা ও শাসনের অনুকূলে থাকে। এজন্য তারা শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক ক্লাব, পত্রিকা প্রকাশ, সাহিত্য অনুবাদ, বুদ্ধিজীবী ভাড়া করাসহ বহুপ্রকার পথ গ্রহণ করেছিল। আমাদের উপমহাদেশেও এ প্রক্রিয়া চলেছে।
শিক্ষা বিস্তারের নামে ইতিহাস বিকৃতি, মানসিক দাস তৈরি ধর্মহীনতার বিস্তার ঘটানোর এ সুবিশাল চক্রাত্ম কী বিরাট কলেবরে সাধিত হয়েছিল তা যারা এ ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন, বিস্ময়ে বিহ্বল হতে বাধ্য হবেন। আমাদেরকে দুধের বোতলে পুরে দু-শো বছর যে বিষ খাওয়ানো হয়েছে তার ফল ভোগ না করে উপায় নেই। আমাদের সমাজের শিক্ষিত শ্রেণি প্রায় পুরোটাই আল্লাহর অস্তিত্ব, পরকালীন জীবন, মালায়েকদের অস্তিত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে সংশয়গ্রস্ত। আর যারা সে বিষ পুরোটাই খেয়েছে তারা ভাবছে ধর্মকে পুরোপুরি উৎখাত না করা পর্যন্ত মানবতা মুক্তি পাবে না, ধর্মের প্রতি তাদের মনোভাব হিংসাতক। এরা নিজেদেরকে মানবতার অবতার এবং মহান চিন্তানায়ক মনে করে যার প্রমাণ দাখিল করার জন্য আল্লাহ-রসুল-মালায়েক, আখেরাত, জান্নাত, জাহান্নাম এক কথায় মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে হাসি-তামাশা করে, ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে গরু-ছাগলের অধম মনে করে।বিগত শতাব্দীর পুরোটা জুড়ে ধর্মের বিরোধিতা করা হয়েছে নগ্নভাবে, আর এ শতাব্দীতে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধেই মুক্তবুদ্ধির কৃপাণ বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। সমাজতন্ত্রকে নাস্তিকতার প্রতিশব্দরূপে ব্যবহার করা হয়, কারণ গত শতাব্দীতে সেভাবেই এর প্রয়োগ করা হয়েছিল। আমরা যদি মার্কস পড়ি, দেখব তার অবস্থান ছিল মূলত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, আর্থনীতিক অবিচারের বিরুদ্ধে; নাস্তিকতা প্রতিষ্ঠা তার মূল বাণীর অত্মর্ভুক্ত ছিল না। ধর্ম সম্পর্কে তিনি তার মনোভাব একটি লাইনে এত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন যে তার মেধার প্রতি শ্রদ্ধা না এসে পারে না। তিনি বলেছিলেন, Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people. (অর্থাৎ ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িত প্রাণের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয়স্বরূপ, আত্মহীন পারিপার্শ্বিকতার মাঝে আতস্বরূপ। মানুষের কাছে ধর্ম যেন আফিমের মত।”
আফিম খেয়ে মানুষ জীবনযন্ত্রণা ভুলে থাকে, ধর্মও মানুষকে তেমনি জীবন যন্ত্রণা ভুলতে সাহায্য করে। মার্কস যে ধর্মটি সামনে দেখেছিলেন সে সম্পর্কে তার এ উক্তি সর্বাংশে সত্য, আজও সেটা সত্যই আছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, মার্কস প্রকৃত ধর্ম দেখতে পান নি, পেয়েছেন সহস্র বছরের বিকৃত ধর্মের লাশ, যার দিকে তিনি করুনা দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। তিনি কি ধর্মকে পদদলিত করতে চেয়েছিলেন? মনে হয় না। কিন্তু তার সৃষ্ট মতবাদকে যখন বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠা করা হলো তখন সেখানে স্রষ্টাকে নিয়ে কী নির্মম তামাশা করা হয়েছে সেটা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। রসুলালল্লাহকে নিয়ে নয়, সরকারি উদ্যোগে স্বয়ং আল্লাহকে নিয়ে কার্টুন আঁকা হয়েছে যা বিলবোর্ডে টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কার্টুনগুলো আল্লাহকে প্রায়শই সাদা দাড়িওয়ালা একজন বৃদ্ধরূপে চিত্রিত করা হয়েছে যাঁকে সবুট লাথি দিয়ে বিতাড়িত করার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করাও ঝুঁকিপূর্ণ। এতসব করেও মানুষকে সমাজতান্ত্রিকরা বা মুক্তবুদ্ধির ফেরিওয়ালারা নাস্তিক বানাতে পারে নি কেন? উল্টো আজ সমাজতন্ত্র ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নেওয়া মতবাদ। নতুন প্রজন্ম এ সম্পর্কে বাস্তব কিছুই জানে না। উল্টোদিকে ধর্ম উঠে এসেছে বিশ্বের প্রধান আলোচিত বিষয়ের তালিকায়। গণমানুষের ধর্মীয় আবেগ রীতিমত মুক্তচিন্তাশীলদের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত দুই যুগ পৃথিবীর তাবৎ যুদ্ধে ধর্ম ছিল প্রধান ইস্যু। এমন কি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও যথাক্রমে উসমানীয় খেলাফত ধ্বংস করা ও ইহুদি নিধন করার সাম্প্রদায়িক লক্ষ্য মূলশক্তিরূপে ক্রিয়াশীল ছিল। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিক হারে ইসলাম গ্রহণ দেখে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ‘সভ্যতার ধ্বজাধারীদের’ যারা কিনা ধর্মীয় স্বাধীনতার শেস্নাগান দেয়। মুক্তচিন্তাবিদরা যে আদতে কত বড় গোঁড়াপন্থী তা কি তারা জানেন? মানুষ যখন ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে তারা বলেন যে, এটা মানুষের বাক-স্বাধীনতা, কিন্তু যখন তারা স্রষ্টার কথা বলে তখন বলে মানুষ কূপম। একাধারে নন্দিত ও নিন্দিত বুদ্ধিজীবী হুমায়ূন আজাদ বলেছিলেন, “এদেশের মুসলমান একসময় ছিলেন মুসলমান বাঙালি, তারপর বাঙালি মুসলমান, তারপর বাঙালি হয়েছিল; এখন আবার তারা বাঙালি থেকে বাঙালি মুসলমান, বাঙালি মুসলমান থেকে মুসলমান বাঙালি, এবং মুসলমান বাঙালি থেকে মুসলমান হচ্ছেন। পৌত্রের ঔরসে জন্ম নিচ্ছে পিতামহ।”
যে ধর্মের উত্থান দেখে হুমায়ূন আজাদ আতঙ্কিত, সেটা আতঙ্কিত হওয়ার মত। কারণ সেটা ধর্ম নয়, ধর্মের উল্টোটা। তালেবানি শাসন, আই.এস. শাসন কি ইসলামের শাসন? মোটেও নয়। তারপরও কথা হচ্ছে, এত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মানুষ আবার ধর্মের দিকে যাচ্ছে, ধর্ম থেকে কেন তাদের ফিরিয়ে রাখা যাচ্ছে না? কারণ-
ক) প্রতিটি মানুষের মধ্যে যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই স্রষ্টার আত্মা, রূহ আছে (সুরা হিজর ২৯)। এর শক্তিশালী প্রভাব মানুষের চিন্তা-চেতনায় ক্রিয়াশীল থাকে। এজন্য যখনই তারা বিপদাপন্ন হয় তখন প্রতি নিঃশ্বাসে স্রষ্টার কাছেই আশ্রয় চায়। স্রষ্টাকে বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট রকম উপাদান প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেগুলো পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ আয়াত বা নিদর্শন বলেছেন, যার সামনে মানুষের মক্তক অবনত হয়। এগুলো দেখার পরও কেবল একটি শ্রেণির প্রচারণায় মানুষ নাস্তিক পরিণত হবে না। আল্লাহর নাজেলকৃত ধর্মগ্রন্থগুলোর বেশ কয়েকটি এখনও মানুষের কাছে আছে যেগুলো স্রষ্টার অত্মত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। মানুষ সেগুলো সম্মানের সঙ্গে পড়ছে, জানছে, বিচার বিশ্লেষণ করছে। এগুলোর স্বর্গীয় বাণীসমূহ মানুষের আত্মার গভীরে প্রভাব ফেলছে। অধিকাংশ মানুষ সেগুলোকে মাথায় করে রাখছে, সন্তানকে যেমন যত্ন করা হয় সেভাবে যত্ন করছে। সুতরাং মানবজাতিকে ধর্মহীন করে ফেলার চেষ্টা অপ্রাকৃতিক ও বাস্তবতাবর্জিত।
খ) অতীতে হাজার হাজার, হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর মানুষকে শান্তি দিয়েছে ধর্ম। এই কিংবদত্মী মানুষের জানা আছে। সময়ের সেই বিশাল ব্যাপ্তির তুলনায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদির শাসনামল এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র এবং এগুলোর অভিজ্ঞতাও শান্তিময় নয়। ধর্মের শাসনে প্রাপ্ত সেই শান্তির স্মৃতি মানবজাতির মন থেকে মুছে যায় নি। অধিকাংশ মানুষ এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে একমাত্র স্রষ্টার বিধানেই শান্তি আসা সম্ভব। কাজেই যুগের হাওয়া তাদেরকে যতই অন্য দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক তারা শান্তির আশায় বারবার ধর্মের পানেই মুখ ফেরায়। উপরন্তু প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে, শেষ যুগে (কলিযুগ, আখেরি যামানা, The Last hour), আবার ধর্মের শাসন বা সত্যযুগ প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, কোনো অবিচার, অন্যায় শোষণ থাকবে না, পৃথিবীটা জান্নাতের মত শান্তিময় (Kingdom of Heaven) হবে। এই বিশ্বাস থেকে অধিকাংশ মানুষ ধর্মের উত্থানই কামনা করে। এটা তাদের ঈমানের অঙ্গ, এ বিশ্বাস মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়।
গ) শান্তির আশায় ধর্মের পানে ছুটে চলা মানুষকে ফেরাতে চাইলে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োজন হবে ধর্মের বিকল্প এমন একটি জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন যা তাদেরকে সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি দিতে পারবে, একই সঙ্গে দেহ ও আত্মার প্রশান্তি বিধান করতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে কি সেটা মানুষ আজ পর্যšত্ম করতে পারে নি এবং কোনো কালে পারবেও না। বহু চেষ্টা করেছে কিন্তু সবই মাকাল ফল। শান্তি শ্বেতকপোত গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক কারো হাতেই ধরা দেয় নি। ধরুন, যদি কোনো ব্যক্তিকে বলা হয় যে, তুমি কীভাবে মরতে চাও? গুলি খেয়ে না বিষ খেয়ে? বাঁচার কোনো পথ নেই, কেবল মরার জন্য দু’টো পথ। ঐ মানুষটিকে একটা না একটা পথ বেছে নিতেই হবে। মানুষের উদ্ভাবিত জীবনব্যবস্থাগুলোকে যত সুন্দর সুন্দর নামেই ডাকা হোক না কেন তা হচ্ছে মানবজাতির সামনে মৃত্যুর বিকল্প পথ। জীবনের পথ একটাই; আর সেটা হলো ধর্ম অর্থাৎ স্রষ্টাপ্রদত্ত দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। বর্তমান স্রষ্টাবর্জিত জীবনদর্শন মানুষকে কেবল নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর জীবন উপহার দিয়েছে। কাজেই মানুষ এখন জীবন রক্ষার আশায় ধর্মের দিকেই যেতে চাইবে, কেননা তাদের শান্তি দরকার। সুতরাং মানুষকে ধর্মহীন করার যে চেষ্টা করা হয় সেটা কোনোদিন সফল হয় নি, হবেও না। এখন একটাই করণীয়, মানুষের ঈমানকে, ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে চালিত করা।
সুতরাং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতিকবর্গকে এখন বুঝতে হবে যে, ধর্মবিশ্বাসকে অস্বীকার করে কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করা ও পরিচালনা করা যাবে না। পশ্চিমা বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে আমাদের সমাজে যে তথাকথিত মুক্তমনা, শিক্ষিত ও উন্নাসিক শ্রেণির জন্ম হয়েছে যারা স্রষ্টাকে মানবসৃষ্ট জুজু মনে করেন, ধর্মকে কল্পকাহিনী মনে করেন, তারা ধর্মের নামগন্ধকেও মানবজীবন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চান। রাষ্ট্রপরিচালকগণও অনেক ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। ধর্মবিদ্বেষীদের কাজের ফলে সমাজে দাঙ্গা ও গোলোযোগ সৃষ্টি হয়। আমাদেরকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে যে, এই তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা যতই চান না কেন, তাদের এই ধর্মবিশ্বাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। অধিকাংশ মানুষই এসব কথা শুনবে না। এ কথা বিগত কয়েক শতাব্দীতে শত শতবার প্রমাণিত হয়েছে। তাছাড়া যে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে অনুসরণ করে তাদের এ প্রচেষ্টা, সেই পাশ্চাত্যও নিজেদের ধর্মবিশ্বাস দ্বারাই প্রভাবিত। তাদের রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি সবকিছুর পেছনে ধর্মবিশ্বাস মূল চালিকাশক্তি। এজন্যই আফগান যুদ্ধের আগে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ মুখ ফসকে যুদ্ধকে ‘‘ক্রডেস’ বলে ফেলেছিলেন। তাই ধর্মকে বাদ দিয়ে জীবন চালানোর পরিকল্পনা বাদ রেখে এখন সকলের উচিত হবে, ধর্মকে কীভাবে মানবতা ও রাষ্ট্রের কল্যাণে ব্যবহার করা যায় সে পথের অনুসন্ধান করা।