রাকীব আল হাসান:
মাননীয় এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর পরিবারের ইতিহাস অতি প্রাচীন। রসুলাল্লাহর প্রিয় সাহাবী এবং জামাতা, ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) এর বংশধারায় পন্নী বংশের উদ্ভব। তাঁর পূর্বপুরুষগণ সমগ্র পৃথিবীর বুকে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে উম্মতে মোহাম্মদীর সঙ্গে আরবভূমি থেকে বহির্গত হয়েছিলেন। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় ৬৫২ সনে রসুলাল্লাহর সাহাবি আহনাফ ইবনে কায়েস (রা.) এর নেতৃত্বে পরিচালিত খোরাসান অভিযানের সেনানী হিসাবে পন্নী বংশের পূর্বপুরুষগণ আফগানিস্তানের হিরাত অঞ্চলে আগমন করেন এবং এখানে বাস করতে থাকেন। পরবর্তীতে ইসলাম যখন ভারতবর্ষে প্রবেশ করে, এই বংশেরই এক ব্যক্তি দিল্লিতে আগমন করেন। ততদিনে আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলাম বিকৃত হয়ে এর মধ্যে বিকৃত অধ্যাত্মবাদ বা সুফিবাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এমামুযযামানের পূর্বপুরুষগণের মধ্যেও জন্ম নেন অনেক আধ্যাত্মিক সাধক, সুফি ও দরবেশ যার মধ্যে ভারতের বিখ্যাত সুফি সাধক সৈয়দ খাজা মোহাম্মদ হোসাইনী গেসুদারাজ বন্দে নেওয়াজ (র.) (১৩২১-১৪২২ খ্রি.) অন্যতম। তিনি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন আফগানিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি কাররানী (মূল গোত্র কাকার) নামক পাঠান গোত্রে বিবাহ করেন। এই কারণে পরবর্তীতে তার বংশধরগণ তাদের নামের শেষে কাররানি ব্যবহার করতেন। কাররানী স্ত্রীর গর্ভে সৈয়দ খাজা মোহাম্মদ হোসাইনী (র.) এর একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করে যার নাম পান্নী (উচ্চারণভেদে হান্নি)। তার বংশধরেরা নামের শেষে কাররানি বা পন্নী দুটোই ব্যবহার করতেন। এ বংশেই জন্ম নেন তাজ খান কররানি যিনি ষোড়শ শতাব্দীতে বঙ্গভূমিতে কাররানী রাজবংশের [Karrani dynasty (1564-1576)] পত্তন করেন। প্রবাদপ্রতিম বীর যোদ্ধা কালাপাহাড় ছিলেন তারই সেনাপতি। বাংলা, বিহার, গৌড়, উড়িষ্যা, ভারতের উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তৃত করেন কররানি বংশীয় শাসকবর্গ। তারা নিজ নামে খোতবা প্রদান ও মুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং পুরো ভারতবর্ষ মোগল সম্রাট আকবরের প্রভাবাধীন থাকা সত্ত্বেও দাউদ খান কররানি নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা দিয়ে দিল্লির সঙ্গে যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটান। ১৫৭২-১৫৭৬ পর্যন্ত বার বার মোগল বাহিনী বাংলা আক্রমণ করে কিন্তু একবারও নিরঙ্কুশ জয়লাভ করতে পারে নি, একবার আপাত জয়ী হলেও কিছুদিন বাদেই দাউদ খান কররানি তা পুনরুদ্ধার করেন। অতঃপর সাতমাসের রক্তক্ষয়ী রাজমহলের যুদ্ধে দাউদ খান কররানি দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন দিয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান হিসাবে ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নেন। কররানি রাজবংশের অধীনে যে জমিদারগণ বাস করতেন তারা ইতিহাসে বারভূঁইয়া নামে খ্যাত। তাদের প্রতিরোধের কারণে মোগল সাম্রাজ্য এ অঞ্চলে পূর্ণাঙ্গরূপে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন নি দীর্ঘ দিন যাবত। ১৭১৬ পর্যন্ত সাঁইত্রিশজন মোগল সুবাদার বাংলায় শাসন করেন, তারা কেউই শান্তিপূর্ণরূপে শাসন করতে সক্ষম হন নি।
তাজখান কররানির ভাই সুলায়মান খান কররানি তার শাসনামলে জনৈক সুফি সাধক আলী শাহান শাহ্ বাবা আদম কাশ্মিরী (র.)-কে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে টাঙ্গাইল জেলার জায়গিরদার নিয়োগ দান করলে তিনি এই অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন; এলাকাটি আতিয়া পরগনা বলে খ্যাত হয়, কারণ আতা শব্দের অর্থ দান। পরবর্তীতে বাবা আদম কাশ্মিরী সম্রাট জাহাঙ্গীরকে পরামর্শ দেন কররানি বংশীয় বায়াজীদ খান পন্নীর (সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কাররানির বড় ভাই) সন্তান সাঈদ খান পন্নীকে আতিয়া পরগণার শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দান করার জন্য, সম্রাট জাহাঙ্গীরও সাঈদ খান পন্নীর গুণমুগ্ধ ছিলেন বলে সানন্দে তিনি এ প্রস্তাবে রাজি হন। এই সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। ১৬০৯ সালে বাবা আদম কাশ্মিরীর কবরের সন্নিকটে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন যা বাংলাদেশের অন্যতম প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক মুদ্রিত ১০ (দশ) টাকা মূল্যমানের নোটের একপার্শ্বে আতিয়া মসজিদের ছবি রয়েছে। পরবর্তী সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষই ব্রিটিশ শাসনের অধীন হয়। তখনও টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-বগুড়া অঞ্চলে এ ক্ষয়িষ্ণু রাজপরিবারের জমিদারি বজায় থাকে। প্রজাহিতৈষীতা ও ধর্মপরায়ণতার জন্য তারা ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাঙালি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করতে তারা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। এক কথায় মাননীয় এমামুযযামানের পরিবারের সঙ্গে আবহমান বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি এক সূত্রে গাঁথা।
এই ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারেরই উত্তর পুরুষ মাননীয় এমামুযযামানেরও রয়েছে এক কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবন-ইতিহাস। তিনি একাধারে ছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম একজন বিপ্লবী, দক্ষ শিকারী, অলিম্পিকে চান্সপ্রাপ্ত রাইফেল শ্যুটার, প্রখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান আবু সাঈদ চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি তাঁর রোগীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নজরুল একাডেমির একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
১৯৬৩ সনে এমামুযযামান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য অর্থাৎ এম.পি. নির্বাচিত হন। সমাজসেবায় তাঁর ছিল অনন্য অবদান। ১৯৬৩ সনে তিনি করটিয়ায় হায়দার আলী রেডক্রস ম্যাটার্নিটি এ্যান্ড চাইল্ড ওয়েলফেয়ার হসপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন যার দ্বারা এখনও উক্ত এলাকার বহু মানুষ উপকৃত হচ্ছেন। পরবর্তীতে তিনি সা’দাত ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নামে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন সত্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি তাঁর সমগ্র জীবন সত্য সন্ধান এবং সত্যের জন্য লড়াই করে গেছেন। তাঁর ৮৬ বছরের জীবনে একবারের জন্যও আইনভঙ্গের কোন রেকর্ড নেই, নৈতিক স্খলনের কোন নজির নেই। আধ্যাত্মিক ও মানবিক চরিত্রে বলীয়ান এ মহামানব সারাজীবনে একটিও মিথ্যা শব্দ উচ্চারণ করেন নাই।
তিনি ছোট বেলা থেকেই দেখেন আমরা মুসলিম জাতি হয়েও ব্রিটিশ খ্রিষ্টানদের দাসে পরিণত হয়ে আছি। যে জাতির হওয়ার কথা ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি সেই আজ সারা পৃথিবীতে নিকৃষ্ট গোলামের জাতিতে পরিণত হয়ে আছে। তিনি এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। পরিণত বয়সে এসে মহান আল্লাহ তাঁকে বোঝালেন যে মুসলিম দাবিদার এই জাতি তওহীদ (আল্লাহর সার্বভৌমত্ব) ও সত্যদীন ত্যাগ করে কার্যতঃ কাফের-মোশরেকে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ মাননীয় এমামুযযামানকে সত্যের জ্ঞান দান করলেন, হেদায়াহ দান করলেন। তিনি সেই সত্য প্রচারের জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ১৯৯৫ সালে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংস্কারমূলক আন্দোলন হেযবুত তওহীদ প্রতিষ্ঠা করলেন। অকুতভয় একদল মোজাহেদ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হেযবুত তওহীদে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করলেন এবং সত্য প্রচারে, মানবতার কল্যাণে নিজেদের জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে ২০ বৎসর যাবৎ কাজ করে যাচ্ছেন।