রাকীব আল হাসান:
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়াবহ সঙ্কটগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাদকব্যবসা, ধর্মব্যবসা ও জঙ্গিবাদ। প্রথমেই বলি মাদক ও মাদকব্যবসা সম্পর্কে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য মাদক একটি ভয়াবহ সমস্যা। একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার তরুণ প্রজন্মের উপর, আর মাদকের করাল গ্রাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এই তরুণ প্রজন্ম। কেউ যখন পুরোপুরি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তখন তার দ্বারা পড়ালেখা, চাকুরি, ব্যবসা, সামাজিক কোনো কাজ বা সংসারের কোনো কাজ আর করা সম্ভব হয় না। তার ভবিষ্যৎ বলতে আর কিছুই থাকে না। তার শরীর ও মন উভয়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে, সে একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। তার কাছ থেকে তার আপন মানুষদের আর কিছু প্রাপ্তির আশা থাকে না, সে কেবলই বোঝায় পরিণত হয়। একজন মানুষ মানে একটা জগৎ। কত সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে সে- বৌ, বাচ্চা, বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু, প্রিয়জন। সেই মানুষটা যখন মাদকাসক্ত হয় তখন স্বপ্নভঙ্গ হয় বহু মানুষের, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তার সাথে সম্পর্কিত আরও অনেকের। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে সে চুরি, ছিনতাই, পকেটমার, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা ইত্যাদি অবৈধ কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ে। যে মেধাবী ছাত্রের পেছনে রাষ্ট্র বহু অর্থ খরচ করল এজন্য যে, সে শিক্ষিত হয়ে রাষ্ট্রের একজন সুনাগরিক হবে, রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই ছাত্রই যখন মরণনেশা মাদকে আক্রান্ত হয় তখন সে রাষ্ট্রের শত্রুতে পরিণত হয়।
মাদক সেবন ও মাদকব্যবসা একটা সমাজ, একটা সভ্যতা ধ্বংস করে দেবার জন্য যথেষ্ট। এই মাদক দ্বারা আজ আমাদের সমাজ ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী প্রতিদিন সর্বনাশা নেশার চোরাস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। এ মরণনেশা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের রাজধানীর অলি-গলি থেকে শুরু করে জেলা শহর, থানা শহর এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল-মাদ্রাসাতেও প্রবেশ করেছে মাদক। বাংলাদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে মাদকাসক্তদের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু-কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা ১৫ শতাংশ। তবে আরও বেশ কয়েকটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকার মুদ্রা বিদেশ পাচার হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ লাখ। কোনো কোনো সংস্থার মতে ৭০ লাখ, নব্বইয়ের দশকে যার পরিমাণ রেকর্ড করা হয় ১০ লাখেরও কম এবং মাদকসেবীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক, তাদের ৪৩ শতাংশ বেকার। ৫০ শতাংশ অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে।
মাদক সেবন, মাদকব্যবসা ও চোরাচালানি রোধে এ পর্যন্ত বহু আইন করা হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনা সৃষ্টির প্রয়াস করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বহু অভিাযান পরিচালনা করেছে- এভাবে বহু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কিন্তু কোনোভাবেই এগুলো বন্ধ হয়নি বরং দিনকে দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশেষে সরকার এই মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। “চলো যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে”- এই স্লোগানকে সামনে রেখে মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ যেন রীতিমতো যুদ্ধ। একদিকে সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকবিরোধী জনগণ আর অন্যদিকে হলো মাদকব্যবসায়ী, চোরাকারবারি ও মাদক সেবনকারীরা। যুদ্ধে শতাধিক মাদকব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। কিন্তু এ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয় পরাজয় কার এটা এখনো বলা কঠিন। মাদকবিরোধী পক্ষের জয় সুনিশ্চিত তখনই বলা যাবে যখন সমাজ থেকে মাদক সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাদকের বিরুদ্ধে এমন বহু অভিযান বহু দেশে চালানো হয়েছে, তাতেও মাদক নির্মূল হয়নি। কখনো সাময়িক নিয়ন্ত্রণে থেকেছে কখনো বা মাদকব্যবসার মালিকানায় পরিবর্তন এসেছে। আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে মাদকের চাষ হয়। আফগান যুদ্ধের পূর্বে এখানকার মাদকব্যবসা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন এ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। সমালোচকরা এমন বলে থাকেন যে, মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া আফগান যুদ্ধের অন্যতম একটা কারণ। সে যাই হোক, আন্তর্জাতিকভাবে মাদকব্যবসার বিরাট একটা নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা বিভিন্ন উপায়ে আমাদের মতো দেশে মাদক পাচার করে থাকে। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতিক দুনিয়ায় মানুষ কেবল ধনী হতে চায়, তারা রাস্তা খুঁজে বেড়ায় কীভাবে রাতারাতি ধনী হওয়া যাবে। তাদের জন্য মাদকব্যবসা বেশ উপযোগী। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার ও ভারত থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মাদক ঢুকছে সীমান্ত দিয়ে।
একসময় মানুষ নেশা করত তালের তাড়ি, গাঁজা-ভাঙ, ভাত পচানো চোলাই এগুলো খেয়ে। ইসলাম ধর্মে মাদক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়াই মুসলিমদের কোনো অনুষ্ঠানে মাদকের বিশেষ প্রচালন ছিল না তবে কিছু উপজাতি ও অন্যান্য ধর্মের লোকদের বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে বন্ধু-বান্ধব একসাথে হয়ে এগুলো খেত। এগুলো তৈরি করা হতো বাড়িতেই তাই এগুলো নিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা করা যেত না। ব্যবসায়িক মুনাফা হাসিলের জন্য সময়ের বিবর্তনের সাথে সাথে কারখানায় তৈরি নানা রকম মাদকদ্রব্য প্রবেশ করল আমাদের সমাজে। আসলো কোকেন, ক্যাথিড্রিন, হেরোইন, ফেনসিডিল ইত্যাদি। হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিলসহ মাদকব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হয়েছে, কোর্টে মামলা উঠেছে, একসময় তারা হয় জামিন না হয় খালস পেয়ে আবার মাদকব্যবসায় জড়িত হয়েছে। ইদানীং ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা। এখন সেই মাদকব্যবসায়ীরাই ধরা পড়ছে লক্ষ লক্ষ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ। কারখানায় উৎপাদিত এসব মাদকদ্রব্য শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানীই নয় সচেতন মানুষমাত্রই জানেন। আর মাদকনেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্বারা কত পারিবারিক হত্যাকাÐ হয়েছে, কত রাজনৈতিক হত্যাকাÐ হয়েছে, কত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা সমাজবিজ্ঞানীরা অবগত আছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কি মাদক পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে? এ প্রশ্নের উত্তর পরে খুঁজব, এখন আসি জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে।
পৃথিবীব্যাপী ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে জঙ্গিবাদ সঙ্কট। বিশেষ করে মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলো জঙ্গিবাদের ভয়াবহতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এই জঙ্গিবাদকে ইস্যু করে পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো একদিকে একটার পর একটা মুসলিম দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে অন্যদিকে পৃথিবীব্যাপী মুসলমানদের বিরুদ্ধে, আমাদের প্রিয় ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা যেন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত এই জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে আফগান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আফগানিস্তানের মাটি থেকে সোভিয়েত শক্তিকে তাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ এবং তাদের মিত্র পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আই.এস.আই মিলিতভাবে আফগানিস্তানের মাটিতে অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গিবাদের বীজ বপন করে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু আলেম ভাড়া করে জেহাদী ওয়াজ করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে আফগানিস্তানে রিক্রুট করে। এখান থেকেই জঙ্গিবাদের উৎপত্তি ঘটে। আমরা এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত, যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে বহু লেখা লিখেছি, পত্র-পত্রিকা, বই-পুস্তক, হ্যান্ডবিল, জনসভা, পথসভা, মানববন্ধন ইত্যাদি করে মানুষকে এই জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতন করার চেষ্টা করেছি, আদর্শিক লড়াই করেছি। এখনো করছি। আমরা কোর’আন, হাদিস, ইতিহাস ও যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, জঙ্গিবাদ কখনোই প্রকৃত ইসলাম থেকে সৃষ্টি হয়নি, বরং দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলমান তরুণ এই কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, তাদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে কোর’আন-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে, খÐিত ইতিহাস তুলে ধরে ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে এই ধ্বংসাত্মক পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন এটাকে ইস্যু করে মুসলমান দেশগুলো একটা একটা করে ধ্বংস করে দেবার, দখল করে নেবার পায়তারা চালানো হচ্ছে। আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের চর্চা ছিল না। সর্বশেষ আফগান যুদ্ধের পরে ধীরে ধীরে জঙ্গিবাদ আমাদের দেশেও আমদানি করা হয়েছে। এখানে ওখানে জঙ্গিহামলা, একযোগে সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা হয়েছে। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তো মসজিদ, ঈদগাহ, হোটেল, রাস্তাঘাট কোথাও বাকি নেই, সব জায়গাতেই হামলা হয়েছে। এই জঙ্গিবাদের উত্থানের ফলে ইসলামের কথা যারাই বলেছে তাদের উপরই আযাব আর গজব নেমে এসেছে। ইসলামের কথা বলাই যেন অপরাধ। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়ে জঙ্গিাবদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান হয়েছে, কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে জঙ্গিরা, ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে এক কথায় শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ দমনের আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। আবার পুলিশের অভিযান কালে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে আত্মঘাতীও হয়েছে অনেক জঙ্গি, নারী-শিশুও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কিছু বিস্ফোরণের ঘটনায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যও প্রাণ দিয়েছেন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধেও সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
জঙ্গিবাদের সাথে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট যুক্ত থাকায় ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের একটা অংশ জঙ্গিবাদবিরোধী নীতিকে ইসলামবিরোধী নীতি মনে করছে। তারা মনে করে জঙ্গিরা তো ইসলামের জন্যই কাজ করছে, ইসলামের জন্য জীবন দিচ্ছে, যুদ্ধ করছে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র শক্তিপ্রয়োগের এই নীতি একদিকে এই ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভ‚তিতে আঘাত করছে অন্যদিকে জঙ্গিবাদ যেহেতু আন্তর্জাতিক একটি ষড়যন্ত্র, এর সাথে যেহেতু পরাশক্তিধর দেশগুলোর কানেকশন তাই এর বিরুদ্ধে সফলতা অর্জনও অত্যন্ত কঠিন। মনে রাখতে হবে এটা দেশ ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র। এবার আসি ধর্মব্যবসা প্রসঙ্গে।
ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণে। যখনই মানবসভ্যতা কোনো সঙ্কটে পড়েছে তখন তার সমাধান করেছে ধর্ম। কিন্তু এই ধর্মই যখন বিকৃত হয়েছে, স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে তখন অশান্তির কল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মকে যারা বিভিন্নভাবে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার বানায় তারাই ধর্মব্যবসায়ী। ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করতে হলে ধর্মের লেবাস ধরতে হয়, ধর্মীয় পুস্তক মুখস্থ করতে হয়। আমাদের সমাজেও লেবাসধারী, পুস্তক মুখস্থকারী স্বার্থবাজ ধর্মব্যবসায়ী রয়েছে। সাধারণ মানুষ ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে এই শ্রেণির উপর নির্ভরশীল। এদের যে কোনো প্রচারে সাধারণ মানুষ সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত হয়, অতীতে এটা বার বার দেখা গেছে। অথচ এই ধর্মজীবীরাই নিজেদের হীনস্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে, সত্যকে বিকৃত করে এবং মিথ্যার প্রসার ঘটায়। তাদের করা ধর্মের অপব্যাখ্যার দ্বারা সাধারণ মানুষ বহু অধর্মকে ধর্ম হিসাবে বিশ্বাস করে এবং ঘোরতর অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জঙ্গিবাদ ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি।
মাদকব্যবসা এবং জঙ্গিবাদ রাষ্ট্রীয় আইনেও অবৈধ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অবৈধ এটা প্রায় সকলেই জানে। তাই এর পক্ষে সাধারণত কেউ দাঁড়াতে পারে না বরং মাদকব্যবসায়ী এবং জঙ্গিদেরকে মানুষ ঘৃণা করে কিন্তু ধর্মব্যবসা যে অবৈধ এবং অন্যায় এটা অধিকাংশ মানুষই জানে না। ধর্মব্যবসায়ীদেরকে অর্থ দান করা সওয়াবের কাজ বলে মনে করে, এতে ধর্মব্যবসা আরও চাঙ্গা হয়। কিন্তু মাদকব্যবসা বা জঙ্গিবাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো ধর্মব্যবসা। মাদক একজন ব্যক্তিকে, একটা পরিবারকে ধ্বংস করে, কখনো বা সমাজেও এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ে কিন্তু ধর্মব্যবসা পুরো মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যে ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণের জন্য সেই ধর্মকে যখন ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটি নিজেদের কুক্ষিগত করে স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে তখন মানবজাতি ধর্মের কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের স্বার্থে তারা ধর্মকেই বিকৃত করে ফেলেছে যার ফলে ধর্ম সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না, উল্টো অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মই অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আঙ্গুর, খেজুর আল্লাহ নেয়ামত স্বরূপ দিয়েছেন মানুষের উপকারের জন্য কিন্তু স্বার্থবাজ ব্যবসায়ীরা যখন নিজেরা লাভবান হওয়ার জন্য এই ফলগুলো থেকে মদ তৈরি করে তখন সেটা মানুষের ক্ষতির কারণ হয়, ইসলামের দৃষ্টিতেও তা পান করা অবৈধ হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের হীনস্বার্থে ধর্মের অপব্যবহার করে ধর্মকে কলুষিত করে। এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ধর্মকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে, এক শ্রেণির ধান্দাবাজ ধর্মব্যবসায়ী ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে, এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী পীর-পূজা, মাজার-পূজা ইত্যাদি করে লক্ষ-কোটি টাকার মালিক হচ্ছে আবার একটা বড় শ্রেণি আছে যারা অর্থের বিনিময়ে ধর্মের বিভিন্ন কাজ করে দেয়। ধর্মকে যে কোনো প্রকার স্বার্থের হাতিয়ার বানানোই ধর্মব্যবসা। ধর্মব্যবসার কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে, সঠিক পথ পাচ্ছে না। রাষ্ট্র ধর্মনিরোপেক্ষ নীতি গ্রহণ করায় ধর্মের বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই। ধর্মব্যবসার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই, কোনো বক্তব্য নেই যদিও ধর্মব্যবসায়ীদের উসকানিতে যখন সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের উপরেই চড়াও হয়, রাষ্ট্রের সম্পত্তি ধ্বংস করে তখন কিন্তু রাষ্ট্রই আক্রান্ত হয়। আবার ধর্ম যেহেতু ধর্মব্যবসায়ীদের কুক্ষিগত তাই ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে ধর্মের যে বক্তব্য সেটাও বেশিরভাগ মানুষ জানে না। ফলে সাধারণ মানুষ ধর্মব্যবসায়ীদেরকে ধর্মের কর্তৃপক্ষ মনে করছে, জান্নাতে যাবার জন্য তাদেরকে টাকা দিচ্ছে, তাদেরকে ঘৃণা করার পরিবর্তে তাদেরকে দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছে, তাদেরকে বয়কট করার পরিবর্তে তাদের উসকানিতে দেশের সম্পদ ধ্বংস করতেও দ্বিধান্বিত হচ্ছে না।
এখন প্রশ্ন হলো- মাদকব্যবসা, জঙ্গিবাদ ও ধর্মব্যবসা এ ভয়ঙ্কর সঙ্কট থেকে জাতিকে উদ্ধার করা যাবে কীভাবে? কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করলে এ সমস্যাগুলো সমাজ থেকে চিরতরে নির্মূল হয়ে যাবে? আসুন দেখি আমাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদুর রসুলাল্লাহ (সা.) কী করেছিলেন এমন পরিস্থিতিতে?
নবী করিম (দ.) যে সমাজে এসেছিলেন সেই সমাজের নাম ছিল আইয়্যামে জাহেলিয়াত অর্থাৎ অন্ধকারের যুগ, মূর্খতার যুগ। সেই সমাজ বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত ছিল। এ সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এই মাদক, সন্ত্রাস ও ধর্মব্যবসা। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মানুষগুলো মদ খেয়ে চুর হয়ে পড়ে থাকত। প্রায় প্রতিটা মানুষ ছিল মাদকাসক্ত। মদ খাওয়া ছিল তাদের কাছে অতি সাধারণ ব্যাপার এবং অত্যন্ত পছন্দের। আর সন্ত্রাস, যুদ্ধ, গোত্রে গোত্রে হানাহানি, ছিনতাই ও রাহাজানি ছিল তাদের সমাজের নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। অন্যদিকে আবু জেহেল, আবু লাহাবরা ধর্মকে নিজেদের কুক্ষিগত করে ক্বাবা কেন্দ্রিক ব্যবসা করে খাচ্ছিল। নিজেদের মনগড়া কথাকে ধর্মের নামে চালিয়ে দিত। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আরবরা দাবি করত যে তারা ইব্রাহিম (আ.) এর অনুসারী কিন্তু তারা ধর্মের নামে যে অশ্লীলতা, যে বেহায়াপনা, অন্ধত্ব ও কুসংস্কারের বিস্তার ঘটিয়েছিল তা মোটেও ইব্রাহিম (আ.) রেখে যাননি। বরং তাদের সমাজের ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের মনমতো ধর্মটাকে পরিবর্তন করে নিয়েছিল।
রসুল (সা.) একে একে সমস্ত অন্যায় নির্মূল করলেন। মাদক দূর করলেন, ধর্মব্যবসা দূর করলেন, সন্ত্রাস, হানাহানি, অনৈক্য, রাহাজানি, ছিনতাই এগুলো সব নির্মূল হয়ে গেল। এক মহাপবিত্র সমাজ নির্মাণ করলেন। ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি স্থাপন করলেন। এই সমাজ নির্মাণের গাইডলাইন দিয়েছিলেন মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন। সেই গাইডলাইনটা হলো- “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মদুর রসুলাল্লাহ” (সা.)। এই একটামাত্র সমাধান। জনগণকে এই কথার উপরে আনলেন যে তোমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবে না। এই কথার উপর সমাজটাকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রসুলাল্লাহ (সা.) যে, যখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা এসেছে তখন যত কঠিনই হোক মানুষ সেটা মেনে নিয়েছে, তারা রাষ্ট্রের শাস্তির ভয়ে নয় বরং আত্মিক পবিত্রতা থেকে আল্লাহর হুকুম মান্য করেছেন। যুগ যুগ ধরে যারা মদের নেশায় আসক্ত ছিল তারাই আল্লাহর হুকুমের ফলে এমনভাবে মদকে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, যরা হুকুম জানার পূর্বে মদ পান করেছিল তারা বোমি করে সেটা উগরে দিয়েছিল, যাদের বাড়িতে মদ ছিল তারা সেটা রাস্তায় এনে ঢেলে দিয়েছিল, পাত্র ভেঙ্গে ফেলেছিল। শরিয়াহ প্রয়োগ করা হয়েছে পরে, আগে মানুষকে এমনভাবে আল্লাহর হুকুমের ব্যাপারে আনুগত্যশীল হবার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে এমনিতেই অপরাধ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। আল্লাহর হুকুম হবার সাথে সাথেই মাদক চিরতরে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। ক্রসফায়ার দিয়ে কাউকে হত্যা করতে হয়নি। যারা ইসলামের সমালোচনা করেন তারা কি এমন কোনো ব্যবস্থা কায়েম করতে সক্ষম হয়েছেন যে দণ্ড ঘোষণা বাদেই শুধুমাত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করাতেই সে অপরাধ প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছে? প্রচলিত ব্যবস্থাগুলো তো আমাদের সামনে বর্তমান। মাদক নির্মূলের জন্য ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট দুতার্তে কয়েক হাজার মানুষকে ক্রসফায়ারে হত্যা করেছে কিন্তু এখনো সেখানে মাদক নির্মূল হবার কোনো খবর আমরা পাইনি। মামুলি অপরাধেও ফাঁসির দাবি করা হয় যেন সেটা নির্মূল করা যায়। অর্থাৎ যে আইন, যে দণ্ডবিধি আছে তা ব্যর্থ হবার কারণেই এমন দাবি ওঠে। যাইহোক, রসুলাল্লাহ যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেখান থেকে সন্ত্রাস, দাঙ্গা, গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ, রাহাজানিও নির্মূল হয়ে গিয়েছিল। যারা একে অপরের সাথে যুদ্ধ করত তারাই হয়ে গিয়েছিল ভাই-ভাই। আর ধর্ম দ্বারা ব্যবসার পরিবর্তে যারা ধর্ম ধারণ করেছিলেন তারা নিজেদের জীবন ও সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে সমাজকে শিখিয়ে দিয়ে গেলেন ধর্মের কাজ করে বিনিময় আশা করা যায় না, এর বিনিময় আল্লাহর নিকট থেকে নিতে হয়। এখানে লক্ষ করার বিষয় হলো- সকলে একটা কথার উপর সাক্ষ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হলো যে, আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানব না, যা কিছু আল্লাহর হুকুম তা-ই ন্যায়, আর কোনোভাবেই আমরা অন্যায় করব না, সর্বাবস্থায় ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থাকব। এই ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থাকার ক্ষেত্রে সবচেয়ে অটল, অনড়, যত্নশীল ছিলেন রসুলাল্লাহ (সা.) নিজে এরপর ছিলেন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ও কাছের সাহাবাগণ। এভাবে তাঁরা নিজেরা ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থেকে, ন্যায়দণ্ড ধারণ করে জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন, জাতির মধ্যে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফলে পুরো সমাজ হয়ে গেল আল্লাহর হুকুমের উপর ঐক্যবদ্ধ, ভাই-ভাই। তারা সভ্য, ভদ্র হয়ে গেল, সুশীল হয়ে গেল, ন্যায় ও মানবতাবাদী হয়ে গেল। যে পথ তাদেরকে এমন সোনার মানুষে পরিণত করল সেই পথটির নামই হেদায়াহ, মুক্তির সহজ সরল পথ। এই পথই এখন অনুসন্ধান করতে হবে। না হলে কিছু অপরাধ হয়ত সাময়িকভাবে দমন করা যাবে কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে সেগুলোও ভয়ংকর আকার নিয়ে ফিরে আসবে। তখন কিছুই করার থাকবে না।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ফেসবুক: facebook.com/rblee77, মতামতের জন্য যোগাযোগ: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]