মো. আসাদ আলী
আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর রসুল যখন পৃথিবীতে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন তখনকার আরব সমাজ এতটাই অন্যায়, অবিচার, হানাহানি, খুনোখুনি, রক্তপাত, বর্বরতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত ছিল যে, ঐ সমাজকে বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়াত, অজ্ঞানতার যুগ, অন্ধকারের যুগ। ন্যূনতম সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নৈতিকতাবোধ, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, মানবিক উৎকর্ষতা, পার¯পরিক ভ্রাতৃত্ব, ঐক্যচেতনা ইত্যাদি কিছুই তাদের ছিল না। শুধু ছিল বংশানুক্রমিক গৃহযুদ্ধ, গোত্রে গোত্রে হানাহানি, রক্তারক্তি, শত্রুতা, সীমাহীন অজ্ঞানতা, কুসংস্কার, কাঠ-পাথরের মুর্তিকেন্দ্রিক চিন্তার স্থবিরতা, ধর্মবাণিজ্য, জেনা-ব্যাভিচার, চুরি, ডাকাতি, লুটতরাজ, হুজুগপ্রবণতা, মাদকাসক্তি, দাসপ্রথা, কন্যাশিশু হত্যা, নারী নির্যাতন ইত্যাদি। অর্থাৎ ভালোর মধ্যে কিছু না থাকলেও খারাপের মধ্যে কিছুই বাদ ছিল না তাদের। পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠী ছিল ঐ আরবরা। সেই আরবদের মধ্যে যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটল মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ইতিহাসের গতিপথই পরিবর্তিত হয়ে গেল। ঐ আরবদের মাধ্যমেই এমন যুগান্তকারী সভ্যতার উন্মেষ ঘটল যার সম্মুখে সমসাময়িক সকল আদর্শ, সকল মতবাদ, সকল সভ্যতা আবেদন হারিয়ে বর্ণহীন হয়ে গেল। সম্ভাবনাহীন একটি উপাদান বা শূন্য (পি. কে হিট্টির ভাষায়) থেকে জন্ম হলো বিরাট এক বটবৃক্ষের। সেই বৃক্ষের ছায়াতলে আসলো অর্ধ দুনিয়া। আসুন জেনে নেয়া যাক- প্রকৃত ইসলাম আরবদের মধ্যে কী পরিবর্তন সাধন করেছিল।
১। ইসলাম অনৈক্য-হানাহানিতে লিপ্ত দাঙ্গাবাজ আরবদেরকে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত করেছিল। বংশানুক্রমিক শত্রুতা আর রক্তপাতে নিমজ্জিত আরব জাতিকে একে অপরের ভাই বানিয়ে দিয়েছিল।
৩। আরব-অনারব, আশরাফ-আতরাফ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-নিরক্ষরের আকাশ-পাতাল মর্যাদার ব্যবধান দূর করেছিল। মর্যাদার একমাত্র মানদ- নির্ধারিত হয়- তাকওয়া অর্থাৎ ন্যায়ের পক্ষে থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা। যিনি যত ন্যায়ের পক্ষাবলম্বনকারী তিনি ছিলেন তত মর্যাদাবান।
৪। যে সমাজে দাসদেরকে মানুষ মনে করা হত না, সেই সমাজের ক্রীতদাস বেলালকে (রা.) ক্বাবার ঊর্ধ্বে উঠিয়ে (মক্কা বিজয়ের পর) আল্লাহর রসুল বুঝিয়ে দিলেন- সবার ঊর্ধ্বে মানুষ, সবার উপরে মানবতার স্থান। আল্লাহর কাছে একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষের মূল্য তাঁর ক্বাবার চেয়েও অধিক। কৃতদাস যায়েদ ও তার পুত্র উসামাকে সেনাপ্রধান বানিয়ে রসুল প্রমাণ করলেন- যোগ্যতা ও তাকওয়ায় যে শ্রেষ্ঠ সেই প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। বংশ-আভিজাত্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব নয়। এই সাম্যবাদী আদর্শ লাখ লাখ বেলাল, যায়েদদের অন্তরে মুক্তির তুফান সৃষ্টি করেছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
৪। সাম্প্রদায়িক ও গোত্রগত বিভাজন আরব সমাজের পশ্চাদপদতার অন্যতম কারণ ছিল। ইসলাম এই বিভাজন দূর করে সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-বংশের মানুষকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। কে কোন ধর্মের, কে কোন বর্ণের, কে কোন গোত্রের- তা বিবেচ্য বিষয় ছিল না, যারাই ন্যায় ও সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইসলাম তাদেরকেই আলিঙ্গন করে নিয়েছে। ইসলামের এই সার্বজনীনতার কাছে অন্য সব আদর্শ ম্রীয়মান হয়ে পড়ে।
৫। নির্যাতিত-নিপীড়িত, শোষিত মানুষ, যারা বেঁচে থাকত গোত্রপতি, সমাজপতি ও যাজক-পুরোহিতদের কৃপাগুণে, যাদের কোনো অধিকার ছিল না, সম্মান ছিল না, যাদের মাথাকাটা যাবার জন্য সমাজপতিদের একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট ছিল, ইসলাম তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। ওই দাসশ্রেণির মানুষই এক সময় তাদের ‘আমিরুল মু’মিনিনের’ গায়ের জামা কীভাবে বানানো হলো তার কৈফিয়ত জানতে চেয়েছে, জনসম্মুখে কৈফিয়ত দিতে হয়েছে অর্ধ-পৃথিবীর শাসককে। শুধু ওই সময়ের পৃথিবীতেই নয়, এমন দৃষ্টান্ত আজকের যুগেও কেউ স্থাপন করতে পারে না।
৬। ইসলাম ক্ষুধার্তকে খাদ্য দিয়েছে, বাস্তুহারাকে বাস্তু দিয়েছে। কে কোথায় কী সমস্যায় পড়ে আছে তার সমাধান করার জন্য রাতের আঁধারে রাস্তাঘাটে, অলি-গলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন ইসলামের খলিফা, অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা।
৭। ইসলাম এমন স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে যে, অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা একটি খেজুরপাতার ছাউনি দেয়া মসজিদে বসে রাজ্য শাসন করত। যার আবার একটির বেশি জামা ছিল না। যে ব্যক্তি তটস্থ থাকত তার শাসনের অধীনে কেউ কোথাও কষ্ট পাচ্ছে কিনা, একটি কুকুরও না খেয়ে থাকছে কিনা সেই দুশ্চিন্তায়। ঘুম এলে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়তেন। যার যখন ইচ্ছা খলিফার সাথে দেখা করত, সমস্যা বলত, সমাধান হয়ে যেত।
মূল কথা হচ্ছে ইসলাম মানুষের বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান করতে পেরেছিল। যখন মানুষের সমস্যা ছিল অধিকারহীনতা, অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, স্বাধীনতাহরণ, শোষণ, বঞ্চনা, দারির্দ্র; তখন ইসলাম মানুষকে মুক্তির সন্ধান দিতে এগিয়ে এসেছিল। প্রতিষ্ঠা করেছিল ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও নিরাপত্তা। এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, ওই ন্যায় ও শান্তি দেখেই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল।
প্রকৃত ইসলামের সেই প্রাঞ্জল আদর্শ আজ নেই। তাই এককালে যে মুসলিমরা অর্ধদুনিয়াকে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচারের অলঙ্কারে সাজিয়ে তুলেছিল সেই মুসলিমরাই আজ সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, নির্যাতিত ও অপমানিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। আমরা যেন পুনরায় আল্লাহর রসুলের আনিত প্রকৃত ইসলামের সেই হারিয়ে যাওয়া আদর্শকে ধারণ করতে পারি, বিশ্বনবীর পবিত্র জন্ম ও ওফাত দিবসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।