কাজী আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ: বর্তমানের শতধাবিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত, হানাহানিতে লিপ্ত, হাজারো রকমের আকিদায় বিভক্ত, অন্য জাতির দ্বারা লাঞ্ছিত অপমানিত আক্রান্ত মুসলমান জাতির এ বিষয়টি জানা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে যে তারা নিজেদেরকে যাঁর উম্মত বলে বিশ্বাস করেন তাঁর অর্থাৎ মোহাম্মদ (সা.) এর আগমনের উদ্দেশ্য কী ছিল? এটা যদি মুসলমানদের কাছে সুস্পষ্ট থাকে তাহলে তাঁর হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড, ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি করার কোনো সুযোগ থাকবে না। তাঁর সমগ্র জীবনের এই যে কোরবানি, সাহাবিদের কোরবানি, শাহাদাত সব কিছুর বিনিময়ে তিনি কী করতে চেয়েছেন, তাঁর পবিত্র জীবনকে প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পুরো ঘটনা সামগ্রিকভাবে এক দৃষ্টিতে দেখার নাম আকিদা। খণ্ডিতভাবে, বিক্ষিপ্তভাবে দেখলে হবে না।
তিনি কি সাম্রাজ্যবিস্তার করতে এসেছেন, তিনি কি অন্য ধর্মের লোকদেরকে জোর করে ধর্মান্তরিত করতে এসেছেন, অন্যদের ধন স¤পদ জোরপূর্বক দখল করতে এসেছেন, নাকি অন্য কোনো কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে এসেছেন? (নাউযুবিল্লাহ!) যে বিষয়গুলো নিয়ে গত কয়েক শতাব্দী থেকে ইসলামের শত্রুরা বিষোদ্গার করে এসেছে, মিথ্যা বানোয়াট আজগুবি সব মতবাদ প্রচার করে দিয়ে ঘৃণা বিস্তার করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপপ্রয়াস করছে।
কাজেই আমাদের পরিষ্কারভাবে জানা দরকার যে আমাদের শেষ রসুল আসলে কী জন্য এসেছেন? হ্যাঁ, তিনি সেনাবাহিনী গঠন করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, সন্ধি করেছেন, আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন, বিচার করেছেন, ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন, সাংসারিক জীবনযাপনও করেছেন। তিনি ছিলেন একাধারে একটি ঐক্যবদ্ধ উদীয়মান জাতির জাগতিক ও আধ্যাত্মিক নেতা, ছিলেন বিচারক, ছিলেন সেনাপ্রধান, ছিলেন পরিবারের কর্তা। এই যে তার প্রচ- গতিময়, কর্মব্যস্ত জীবন, সেখানে তিনি কোন কাজ কখন কেন কোন পরিপ্রেক্ষিতে করেছেন এবং ঐ কাজগুলোর উদ্দেশ্য কী ছিল এটা সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে জানাই হচ্ছে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য ও সুন্নাহ সম্পর্কে প্রকৃত আকিদা।
ইসলামের শত্রুরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাঁর কর্মময় জীবনের এখান থেকে একটি ঘটনা, ওখান থেকে একটি ঘটনা এনে গোজামিল, জোড়াতালি দিয়ে রসুল সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা দাঁড় করিয়ে দেয়। তারা করে মুসলিম জাতির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আর ধর্মের ধ্বজাধারীরা, ধর্মব্যবসায়ীরা করেন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। তারা রসুলাল্লাহর জীবনের অতি ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলোকে মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত করে জাতির দৃষ্টি থেকে রসুলাল্লাহর আগমনের মূল উদ্দেশ্যকেই আড়াল করে ফেলেছেন। তাঁর আল্লাহ প্রদত্ত উপাধি কী লক্ষ করুন- রহমাতাল্লিল আলামিন, সমস্ত বিশ্বজাহানের জন্য রহমতস্বরূপ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সমস্ত মানুষকে সুখ শান্তিময়, শোষণ-অবিচারহীন একটি জীবন উপহার দেওয়াই তার আগমনের উদ্দেশ্য।
পবিত্র কোর’আনের অন্তত তিনটি আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “তিনি হেদায়াহ ও সত্যদীন সহকারে স্বীয় রসুল প্রেরণ করেছেন যেন তিনি একে অন্যান্য সকল জীবনব্যবস্থা, দীনের উপর বিজয়ী করেন (সুরা সফ ৯, সুরা তওবা ৩৩, সুরা ফাতাহ ২৮)। সুতরাং বোঝা গেল আল্লাহর প্রেরিত হেদায়াহ (সঠিক পথ) ও সত্যদীনকে সমগ্র মানবজাতির জীবনে প্রতিষ্ঠা করা তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রথম কী করলেন? সবাইকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ মানুষকে এক আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান করতে লাগলেন। শুরুতেই কাবাকেন্দ্রিক পুরোহিত ও ধর্মব্যবসায়ীদের অপপ্রচারের দরুন তিনি প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হলেন।
একদিন রসুলাল্লাহর চাচা তাঁকে ডেকে বললেন, “আমার কাছে মক্কার নেতারা এসেছিলেন। তাদের দাবি হচ্ছে তুমি মানুষকে যা বলছ সেগুলো আর বলবে না। তার বিনিময়ে তারা তিনটি তোমাকে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছে। তুমি কি আরবের বাদশাহ হতে চাও? তারা তোমাকে আরবের বাদশাহ বানিয়ে দেবে। তুমি যদি চাও তারা তোমাকে আরবের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীকে এনে দেবে। অথবা তুমি যদি চাও তোমাকে আরবের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসক দিয়ে তোমার চিকিৎসা করাবো। আর যদি তুমি তাদের প্রস্তাবে সম্মত না হও, তাহলে তারাই আগামীকাল তোমার ব্যাপারে ফায়সালা করবে (অর্থাৎ হত্যা করবে)।
এ প্রস্তাবনা শুনে রসুলাল্লাহ দৃপ্তস্বরে উত্তর দিলেন, “চাচা, আপনি তাদের বলে দিবেন, তারা যদি আমার এক হাতে চন্দ্র আর আরেক হাতে সূর্যও এনে দেয় তবু আমি আমার এ পথ ছাড়ব না। হয় আল্লাহর বিজয় হবে নয় এ পথে মোহাম্মদ শেষ হয়ে যাবে।” (সিরাত ইবনে ইসহাক)
লক্ষ্য করুন, এখানে আল্লাহর রসুলের জীবনের উদ্দেশ্যটি প্রকাশিত হয়েছে। তিনি যদি ক্ষমতা চাইতেন, ভোগবিলাস চাইতেন তো বাদশাহী ও সুন্দরী নারীর প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেগুলো প্রত্যাখ্যান করলেন এবং বললেন সেটা হচ্ছে আল্লাহর বিজয়। তিনি মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করলেন, বিপদসঙ্কুল সংগ্রামী জীবন বেছে নিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে আল্লাহর বিজয় হবে কীসে? অপর দুটো ঘটনায় এ প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে পাব।
একজন নির্যাতিত সাহাবী রসুলের কাছে এসে বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! আর সহ্য করতে পারছি না। আপনি দোয়া করেন তারা যেন ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু রসুল কাফেরদের ধ্বংস কামনা করেন নি। এখানেই প্রমাণ হয়ে যায় যে তিনি মানুষকে ধ্বংস করার জন্য আসেন নি, তিনি তাদেরকে দুর্দশা থেকে উদ্ধার করতে এসেছেন। তিনি জবাবে বললেন, শোনো, সেদিন বেশি দূরে না, যেদিন একজন যুবতী সুন্দরী মেয়ে সারা গায়ে অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত পথ রাতের অন্ধকারে হেঁটে যাবে। তার মনে আল্লাহ ও বন্যপ্রাণীর ভয় ছাড়া আর বিপদের আশঙ্কাও জাগ্রত হবে না। অর্থাৎ রসুলাল্লাহ একটি শান্তিময় সমাজব্যবস্থার ভবিষ্যদ্বাণী করলেন। একটি সমাজের শান্তিময়তা বোঝার জন্য এর চেয়ে বড় কোনো নির্দেশক থাকতে পারে না। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি পরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দিলেন। তারপর তিনি বেলালকে (রা.) কাবার উপরে উঠিয়ে আজান দেওয়ালেন। সেই বেলাল কোন বেলাল? সেই কোরায়েশদের দ্বারা অত্যাচারিত নিপীড়িত বেলাল, যার কোনো বলার অধিকার ছিল না, বিনোদনের অধিকার ছিল না, যাকে জন্তুর মতই ব্যবহার করা হতো। তিনি ছিলেন সমগ্র বিশ্বের বঞ্চিত, দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষের প্রতীক। সেই ক্রীতদাস বেলালকে তিনি কাবার উপরে উঠালেন। উঠিয়ে প্রমাণ করে দিলেন মানুষ ঊর্ধ্বে মানবতা ঊর্ধ্বে। মানুষকে সর্বোচ্চ আসনে উঠানোর জন্যই তিনি এসেছিলেন। এখানেই ঘটেছে রসুলাল্লাহর ‘রহমতাল্লিল আলামীন’ নামের বহিঃপ্রকাশ।
বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি বললেন, আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নাই। সমস্ত বৈষম্যের উঁচু নিচু দেয়াল তিনি ভেঙ্গে দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা যা খাবে তোমাদের অধীনস্থদেরও তাই খাওয়াবে, যা পরবে তা-ই তাদেরকে পরাবে। গোটা জাতিকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করলেন, সুশৃঙ্খল করলেন, সত্যের পক্ষে সংগ্রামে অবতীর্ণ করলেন। তিনি যেমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন তার ফল হলো যে একজন মেয়ে একা রাতের অন্ধকারে হেঁটে যেতে পারত। মানুষ উটের পিঠভর্তি করে খাদ্য, সম্পদ নিয়ে দরিদ্র মানুষের সন্ধানে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। রাস্তায় একটি মূল্যবান বস্তু হারিয়ে ফেললে সেটা খুঁজে যথাস্থানেই পাওয়া যেত। দোকান খোলা রেখে মানুষ মসজিদে যেত, বছররের পর বছর আদালতে কোনো অপরাধসংক্রান্ত মামলা আসতো না। সেখানে পথচারীদের খাওয়ার জন্য রেস্তোরা বসানো হতো না, বসানো হতো সরাইখানা। স্থানীয় লোকেরা তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য, ফলফলাদি, গৃহপালিত পশু সরাইখানাতে দিয়ে যেত যেন মুসাফির আর ক্ষুধার্তরা এসে খেতে পায়। একজন নিঃস্ব মানুষ দেশ ভ্রমণে বের হতো, কোথায় তার আশ্রয়ের সঙ্কটে পড়া তো দূরের কথা, সে মানুষের কাছ থেকে উপহার উপঢৌকন নিয়ে ধনী মানুষ হয়ে বাড়ি ফিরত।
রসুলাল্লাহ এন্তেকালের সময় পার্থিব সম্পদ হিসাবে কী রেখে গেছেন সেটা সর্বজনবিদিত। সেগুলো হচ্ছে (১) ১টি চাটাই, (২) ১ টি বালিশ (খেজুরের ছাল দিয়ে ভর্তি) ও (৩) কয়েকটি মশক। আরও রেখে যান- (১) ৯টি তরবারী, (২) ৫টি বর্শা, (৩) ১টি তীরকোষ, (৪) ৬টি ধনুক, (৫) ৭টি লৌহবর্ম, (৬) ৩টি জোব্বা (যুদ্ধের), (৭) ১টি কোমরবন্ধ, (৮) ১টি ঢাল এবং (৯) ৩টি পতাকা। (তথ্যসূত্র:- সিরাতুন্নবী- মওলানা শিবলী নোমানী)। যদি তাঁর ঘরভর্তি সোনা-দানা, হীরা-জহরত, প্রাসাদ রেখে যেতেন তবে বোঝা যেত যে তিনি এগুলোর জন্যই সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু তিনি একটি চাটাই, একটি বালিশ, কয়েকটি মশক ছাড়া কিছুই রেখে যান নি।
সুতরাং মানুষের মুক্তিই হচ্ছে রসুলাল্লাহর (সা.) আগমনের উদ্দেশ্য, সকল নবী রসুলের আগমনের উদ্দেশ্য। এটাই ইসলামের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য (আকিদা) যার সামনে থাকবে, সে আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে ইসলামের নাম বলে চালিয়ে দিতে পারবে না। পাশাপাশি ইসলাম বিদ্বেষীদের সকল অপপ্রচারও ভিত্তিহীন ও যুক্তিহীন হয়ে যাবে। তাই এখন সকলের জন্যই রসুলাল্লাহর আগমনের সঠিক উদ্দেশ্যটি জানা অত্যন্ত জরুরি।
ইসলামের উদ্দেশ্য কী সেটা পরবর্তী পর্বে লেখার আশা রইল।