রাকিব আল হাসান:
সমগ্র বিশ্বকে যদি এক দৃষ্টিতে দেখা হয়, সমগ্র বিশ্বব্যবস্থাকে নিয়ে যদি একটি নিরীক্ষা করা হয় তবে দেখা যাবে, মানব ইতিহাসের যে পর্যায়গুলি আমরা অতিক্রম করেছি তার মধ্যে বর্তমান সভ্যতা বস্তুগত উন্নতির দিক দিয়ে যে উচ্চতায় পৌঁছেছে অতীতে কোনো সভ্যতা এর ধারেকাছেও পৌঁছুতে পারেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষ এগিয়েছে বহু দূর, আকাশের বিদ্যুতকে সে বেঁধে চাকরের মতো কাজ করাচ্ছে, নদীর গতিকে সে মোড় ঘুরিয়ে ফসল ফলাচ্ছে, তার গতি রুদ্ধ করে বিদ্যুত তৈরি করছে, সে লক্ষ লক্ষ মাইল দূরের চাঁদে গিয়ে ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয়, সে জানে আর কিছু দিন পর সে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াবে। রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, অত্যাধুনিক মুঠোফোন ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে পৃথিবীটা একটা গ্রামের মতো হয়ে গেছে, হাতের মুঠোয় চলে এসেছে সব।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা হচ্ছে, কৃষিখাতকে উন্নত করা হয়েছে, চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আধুনিক করা হয়েছে এভাবে বস্তুগত সমস্ত দিক দিয়ে পৃথিবী আজ পূর্বের সমস্ত রেকর্ড ভেঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে। বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ৮শ’ কোটি মানুষ, স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আছে প্রায় ২শ’, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এখন সবচেয়ে বড় সংস্থা অর্থাৎ জাতিসংঘ আছে, আরও অন্যান্য জোট, মহাজোট, সামরিক জোট ন্যাটো আছে, একসময় ছিল ওয়ার জোট, তারপর অর্থনৈতিক সংস্থা আছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ, আসিয়ান, জাইকা, আরব ব্যাংক, এডিবি ইত্যাদি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক বহু সংস্থা আছে, অর্থনৈতিক ফোরাম আছে, বহু অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান আছে। আর বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি বিভিন্ন আদর্শ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।
কোনো রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক, জনগণের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, প্রতিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, কোথাও সামরিক শাসন, কোথাও রাজতন্ত্র, কোনো কোনো দেশে সমাজতন্ত্র বা একটা গ্রুপের নেতৃত্বের শাসন- এইভাবে বিশ্বের বৈচিত্রময় শাসনব্যবস্থার মধ্যদিয়ে বিশ্ব যাচ্ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমরা যদি বিশ্বের শাসনব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করি তাহলে আমরা দেখব, ইউরোপের শিল্প-বিপ্লবের পর বিশ্বব্যবস্থা প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটা ইউরোপ আমেরিকার শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলি/উন্নত, আর অপরটি হলো- কাচামাল সরবরাহকারী উন্নয়নশীল বা গরিব দেশগুলি। শাসক-শাসিত, ধনী-দরিদ্র।
শিল্প-বিপ্লবের পর প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার হয়েছে, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হয়েছে। এর ফলে অর্থনীতিও কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে কিছু লোকের হাতে। এ কারণে শক্তিশালী সামরিকবাহিনী তৈরি হয়েছে, নতুন নতুন মারণাস্ত্র তৈরি হয়েছে, যে কারণে শক্তিও কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে, ফলে দুর্বল, প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ক্ষমতাবানদের অধীনস্থ হয়ে গেছে। এটা চলেছে কয়েক শতাব্দী, যাকে আমরা বলতে পারি ঔপনিবেশিক কাল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, তুর্কী সাম্রাজ্য, চীনা সাম্রাজ্য, জাপানি সাম্রাজ্য, রুশ সাম্রাজ্য, ফরাসী সাম্রাজ্য, স্প্যানিশ, ওলন্দাজ এভাবে কিছু জাতির হাতে সমগ্র পৃথিবী শাসিত হচ্ছিল। তখন আদর্শ বলতে ছিল রাজার কর্তৃত্ব, একটা পর্যায়ে রক্ত-আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজার কতৃত্ব খর্ব হয়ে আসলো জনগণের হাতে, যার নাম দেওয়া হয়েছে গণতন্ত্র, পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। এটা হলো ইউরোপের রেনেসাঁর পর। সামন্ত রাজা, জমিদারদের বিরুদ্ধে, পোপ, ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে জনগণ বিদ্রোহ করেছে, সাহিত্যিকরা, সাংবাদিকরা, নাট্যকাররা, শিল্পীরা, অভিনেতারা সবাই সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে একটা রেনেসাঁ করেছে, জাগরণ সৃষ্টি করেছে।
ফলে সেখান থেকে মানুষ কিছু কিছু অধিকার পেল। জনগণের কিছু কিছু অধিকার ফিরে পাওয়ার ফলেই সৃষ্টি হলো গণতন্ত্রের। জনগণ তাদের পছন্দমতো শাসক নির্বাচন করার অধিকার পেল, শাসন ক্ষমতায় নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হওয়াই তারা তৃপ্ত হলো। এই গণতন্ত্র একটা পর্যায়ে পর্যবসিত হলো মূলত পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে। অর্থাৎ পুঁজি একটা জায়গায় আবদ্ধ হয়ে গেল, রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের হাতে কুক্ষিগত হলো। এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হলো। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কার্লমার্কস বই লিখলেন, থিওরি অব সারপ্লাস ভ্যালু। এটা লিখে তিনি শ্রমিকদের বোঝালেন, তোমাদের অতিরিক্ত শ্রম কিন্তু কিছু লোকের হাতে যাচ্ছে। এটা সমাজের সমষ্টির হাতে যাওয়া দরকার, তোমাদের সমন্বয়ে গঠিত একটা ব্যবস্থার হাতে যাওয়া দরকার। এই তত্ত¡কে মানুষের মাঝে প্রচার করে, মানুষকে বুঝিয়ে বিপ্লবের সৃষ্টি করলেন ভøাদিমির ইলিচ লেলিন। এই সহজ-সরল তত্ত¡ পেয়ে মানুষ উজ্জীবিত হলো, ব্যাপক বিপ্লব করল। কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ জনতা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে উজ্জীবিত হলো, বলশেভিক বিপ্লব হলো রাশিয়ায়। কোটি কোটি মানুষ মুক্তির নেশায় এটাকে আলিঙ্গন করে নিলো। সেটার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিলো। প্রচণ্ড ধাক্কায় জার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেল। রাশিয়ার জার সম্প্রাট দ্বিতীয় নিকোলাস সপরিবার নিহত হলো। প্রচণ্ড ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্যের রাজাবাদশাহদের বাদশাহী নড়ে গেল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তখ্ত কেঁপে উঠল। সমাজতন্ত্র বহু জায়গায় গৃহীত হলো। কিছুদিনের মধ্যে মানুষ সমাজতন্ত্রের উগ্ররূপ ফ্যাসিবাদের যাঁতাকলে পড়ল।
ফ্যাসিবাদী সমাজতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র এই বাদ মতবাদের রেষারেষি, দখল, পাল্টা দখল, আধিপত্ত পাল্টা আধিপত্ত ইত্যাদির খেসারত দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ, তেরো কোটি বনি আদম খুন। হাজার হাজার শহর, বন্দর ধ্বংস হওয়ার পর, কয়েক কোটি মানুষ আহত, বিকলাঙ্গ হওয়ার পর, কয়েক কোটি নারী বিধবা হওয়ার পর, কয়েককোটি শিশু এতিম হওয়ার পর বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তৈরি হলো জাতিসংঘ। মানুষ এখানে দাঁড়িয়ে আজকে বলছে যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হওয়ার পর এখন সারা দুনিয়াতে সমাজতন্ত্র আবেদন হারিয়েছে। আর গণতন্ত্র প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, বিশ্বে এখন অনেক জায়গাতে জবরদস্তিমূলক গণতন্ত্র চলছে, গণতন্ত্র এখন কনফাইনড হয়ে গেছে নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যে, আর কোথাও এখন গণতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রের প্রবর্তকরা এখন অবাধ নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই মনে করছেন যে গণতন্ত্র আছে, এতটুকুতেই তারা সন্তুষ্ট।
আসলে গণতন্ত্র কেবল তত্ত¡ কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ কারণ অবাধ নিরপেক্ষ অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র তো হতে পারে না; দুর্নীতি, কালো টাকার মালিকদের ভোট কেনা, দলবাজি, দলভিত্তিক কাঠামো ইত্যাদি হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাধারণ ফল। দলের বাইরে চিন্তা করার আর কোন স্কোপ নাই। মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা, দিনকে রাত করা, রাতকে দিন করা। এখানে আর কোনো গণতন্ত্র আসলে নেই। আর সাম্প্রতিককালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে গণতন্ত্র এমন একটা ভুল ব্যবস্থা যার মধ্যে দিয়ে সবচেয়ে দুশ্চরিত্রবান, নারী পাচারকারী, দুর্নীতিকারী, সবচাইতে আইনলঙ্ঘনকারী, অর্থ লুটপাটকারী লোকও রাষ্ট্রের কর্ণধার হতে পারে। আর সমাজের সবচেয়ে চোর ডাকাত, খারাপ, ঘুষখোর লোকটাই চেয়ারম্যান, এম.পি এমনকি মন্ত্রীও হয়ে যাচ্ছে। এটা হলো গণতন্ত্রের সবচাইতে বড় ব্যর্থতা। সব মিলিয়ে এটা আজ প্রমাণিত যে গণতান্ত্রিক এই সিস্টেম শান্তি দিতে ব্যর্থ। তাহলে এ সিস্টেমটা এখন পরিত্যাজ্য।
গণতন্ত্র আবেদন হারিয়েছে, সমাজতন্ত্র আবেদন হারিয়েছে, ধর্মগুলো রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে ফেলা হয়েছে আর রাজতন্ত্র তো অচল, এখন চলছে আদর্শের এক ভয়াবহ সঙ্কট। এই ব্যবস্থাগুলোর পতনের পর এখন আবার পুরোনো ধর্ম মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বিভিন্ন জায়গায় ধর্মের পুনরুত্থানের চেষ্টা চলছে কিন্তু ধর্ম এরই মধ্যে বিকৃত হতে হতে প্রকৃত রূপ হারিয়ে ফেলেছে, কার্ল মার্কস যেটাকে আফিম বলেছেন। আসলে ধর্মের যে রূপ তিনি দেখেছেন সেটা আফিমই বটে, আফিমের নেশায় মানুষ যেমন বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে ঠিক তেমনি বিকৃত ধর্ম আজ ধর্মান্ধ মানুষগুলোকে বুঁদ করে রেখেছে, ধর্ম আজ এমন জায়গায় গেছে যে সভ্য সমাজের জন্য আসলে এ ধর্ম চলে না, উন্নতি, প্রগতির জন্য এ ধর্ম চলে না, চিন্তাশীলতার জন্য এ ধর্ম চলে না। তবুও ধর্ম এখন ধাঁই ধাঁই করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। ভারতে ধর্ম নিয়ে পলিটিক্স চলছে, ইউরোপে রাজনীতি চলছে, আমেরিকায় চলছে, মিয়ানমারে আগুন জ্বলছে। কাজেই এখন ধর্মের উত্থানের সময়। কিন্তু কোন ধর্ম? মানুষের কাছে যে বিকৃত, বিপরীতমুখী ধর্ম আছে সেটা তো মানুষকে শান্তি দিতে পারবে না। বহু আগেই খ্রিষ্টান ধর্ম ভারসাম্য হারিয়েছে তাই ইউরোপে রেনেসাঁ হয়েছে, ধর্মের কবর হয়েছে। বহু আগেই ভারতে প্রাচীন সনাতন ধর্ম ব্যর্থ হয়ে ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ হয়েছে। বহু আগেই বৌদ্ধ ধর্ম নাস্তিকতায় রূপ নিয়েছে। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয়, আন্তর্জাতিক জীবন পরিচালনার জন্য সর্বাধুনিক যে ধর্ম তথা জীবন ব্যবস্থাটি ছিল তা হলো ইসলাম। যার জীবন্ত ইতিহাস রয়েছে সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, রক্তপাত সমস্ত কিছু দূর করে সমাজে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার।
ইসলাম মানুষের মুক্তি দিয়েছে, মানবতা প্রতিষ্ঠা করেছে, সাম্য এনেছে, সমৃদ্ধি এনেছে, যুগের পরিবর্তন ঘটিয়েছে, শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটিয়েছে, মানুষের দৃষ্টি খুলে দিয়েছে, চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করেছে, অনৈক্য দূর করে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু বিগত তেরশ’ বছরের কালপরিক্রমায় এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ীদের স্বার্থের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হতে হতে ধর্মটি বিকৃত হয়ে তার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অতি পদ্ধতি শ্রেণির অতি বিশ্লেষণ আর কূটতর্কের ফলে সহজ সরল দীন আজ জটিল, দুর্বোধ্য মাকড়সার জালের মতো হয়ে গিয়েছে। এই ধর্মের অনুসারীরা এখন তর্ক-বিতর্ক করে করে হাজার হাজার মাজহাব-ফেরকা, মত-পথ আর দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। এখন একেক আলেমের কাছে একেক রূপের ইসলাম রয়েছে, কাজেই ইসলাম আর একক একটি আদর্শ নেই। ইসলামের কথা শুনলেই মানুষ প্রশ্ন করে শিয়া ইসলাম নাকি সুন্নী ইসলাম, শাফেয়ী ইসলাম নাকি হানাফি ইসলাম, মুজাদ্দেদীয়া ইসলাম নাকি নকশবন্দীয়া ইসলাম, রাজনীতিক ইসলাম নাকি জঙ্গিবাদী ইসলাম এভাবে বলতে গেলে ইসলামের এখন হাজার হাজার ফরমেট।
ধর্ম এখন ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যবসা, স্বার্থ উদ্ধার ও জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে। ধর্ম মানবজাতির সামগ্রিক জীবনব্যবস্থার মাধ্যম হিসেবে আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। কৃষক-শ্রমিক-মুটে-মজুর সাধারণ শ্রেণির মানুষ তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের প্রথাগুলোকে পালন করলেও শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল শ্রেণির মধ্যে অধিকাংশই বিশ্বাসগতভাবে ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আর সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মের ব্যবহার তো অধিকাংশ মানুষই চাচ্ছে না। তাহলে সমাজের যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, হত্যা, ধর্ষণ, বৈষম্য ইত্যাদি দূর করে একটা নতুন সমাজ বিনির্মাণের জন্য এখন কোন আদর্শটা লাগবে? মানবজাতি এখন এক বিরাট আদর্শিক সংকটে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষের সামনে এমন কোনো আদর্শ এখন আর নেই।
মানুষের যেমন দেহ আছে তেমনি একটা আত্মাও রয়েছে, তার যেমন দৈহিক সুখ দরকার তেমনি আত্মিক প্রশান্তিও দরকার, যেমন অর্থনীতিক উন্নয়ন দরকার তেমনি একটা চারিত্রিক উৎকর্ষও দরকার, তার যেমন রাষ্ট্র পরিচালনা, সমাজ পরিচালনার নীতি দরকার তেমনি পারিবারিক শৃঙ্খলাও দরকার, রাজনৈতিক সংকট দূর করার পাশাপাশি তার সামাজিক সংকটও দূর করা দরকার, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার পাশাপাশি তার উন্নত নৈতিক শিক্ষাও দরকার, যুদ্ধ-বিগ্রহ দূর করার পাশাপাশি তার ন্যায়পূর্ণ আইন-কানুন, দণ্ডবিধিও দরকার, সৎ চরিত্রবান শাসকের পাশাপাশি আনুগত্যশীল জনগণও দরকার। সামগ্রিক দিক থেকে একসাথে ব্যবহার করার মতো আদর্শ পৃথিবীর কোথাও নেই।
সামাজিক সংকট সমাজতন্ত্র দূর করতে পারে নাই। গনতন্ত্র এসেছে রাজনৈতিক সংকট দূর করার জন্য, সমাজতন্ত্র এসেছে অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করতে, কিন্তু মানুষের জীবন শুধু অর্থনৈতিক নয়, শুধু রাজনৈতিক নয়। তার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে, তার ধর্মীয় জীবন আছে, তার বিশ্বাসগত ব্যাপার আছে, ইহকাল এবং পরকালের একটা ব্যাপার আছে। মানুষ উহকালকে যেমন ছাড়তে পারবে না তেমনি পরকালকেও ছাড়তে পারবে না। সকল ধর্মে পরকাল একটা ফ্যাক্টর। ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম সব ধর্মে পরকাল একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু পরকালের কোনো সমাধান এই মতবাদগুলির মধ্যে নেই। তারা কিন্তু এগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। গনতান্ত্রিকরা বলে দিয়েছে ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম তোমাদের যার যার ব্যাপার কিন্তু রাষ্ট্র সবার, এ কথা বলে তারা রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করেছে। রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ করার জন্য সুদভিত্তিক অর্থনীতিক সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে, সমাজ পরিচালনার জন্য আইন রচনা করেছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করেছে, দিনকে দিন তাদের অস্ত্র-সস্ত্র বৃদ্ধি করা হচ্ছে, লোকবল বৃদ্ধি করা হচ্ছে, নতুন নতুন কৌশল প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে যেন সমাজে বিশৃঙ্খলা না হয়, যেন রাষ্ট্রকে শান্তিপূর্ণ রাখা যায়।
কিন্তু ধর্ম ও উপাসনালয়ের পুরোহিতগণ মানুষের ব্যক্তিজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একদিকে মানুষের ব্যক্তিজীবন নিয়ন্ত্রণ করে তারা, আর জাতীয় জীবন পরিচালনা করছেন রাজনীতিক, আমলা ও সুশীল সমাজ। ফলে এখানে বিরাট একটা টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে, এখন একটা টানাটানি, ছেড়াছেড়ি ব্যাপার। এই যে ধর্ম বনাম রাষ্ট্রের টানাটানি, গনতন্ত্র বনাম ইসলাম, ইসলাম বনাম সমাজতন্ত্র, নাস্তিকতাবাদ বনাম আস্তিকতাবাদ এই সঙ্কট বিশ্বব্যাপী। এই সঙ্কট থেকে শুরু হয়েছে যুদ্ধ মহাযুদ্ধ, এখন কী করবেন? এই সঙ্কট সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক আদর্শের। সেই সঠিক আদর্শ মহান আল্লাহ হেযবুত তওহীদকে দিয়েছেন। একাধারে সমস্ত সংকটের সমাধান আছে আমাদের কাছে। আমাদের আদর্শটা তাহলে কী? আমাদের আদর্শে প্রথম কথা হলো সকল মানুষকে একটা কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, “আমরা যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নিলাম”। এটা মুসলমানদের কাছে ঈমান আর অন্যদের কাছে কমিটমেন্ট।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ।
যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫
০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩