রাকীব আল হাসান:
ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুসলিমদেরকে বৈদেশিক আগ্রাসনকারী জাতি হিসাবে চিত্রিত করা হয়। এই ইতিহাস বিকৃতি ব্রিটিশদের একটি ষড়যন্ত্র। ব্রিটিশ শাসকরা চেষ্টা করেছে ভারতবর্ষে তাদের শাসনকে দৃঢ়মূল করার জন্য মুসলিম জাতিকে একটি পরসম্পদলোভী, অত্যাচারী, বর্বর জাতি হিসাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে। এজন্য তারা নিজেরা শত শত বিকৃত ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছে, অনেক ভারতীয় বুদ্ধিজীবীকে দিয়েও তারা ইতিহাস রচনা করিয়েছে যেসব ইতিহাসে দিনকে রাত রাতকে দিন করা হয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা সেটাই শিখছে। ফলে তারাও ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নামক বিষফল ভক্ষণ করে জাতির মধ্যে সা¤প্রদায়িক অনৈক্যকে পুষে রেখেছে। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেছিলেন বিদেশির মতোই এবং রক্তপাতের ভেতর দিয়েই তা হয়েছিল, কিন্তু আলেকজান্ডারের উপর কোনো ঐতিহাসিকের এ রকম রাগ, দুঃখ, ঘৃণা নেই বাণিজ্যিক কারণে মুসলিম জাতি সেখানে বসতি স্থাপন করে। তাদের চরিত্রগত সত্যবাদিতা, আমানতদারি, ওয়াদারক্ষা, সততা প্রভৃতি গুণাবলীর কারণে সে অঞ্চলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই মুসলিমদের হাতে চলে আসে। এই মুসলমানদের একটি নাম ছিল মোপলা। তারা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। ব্যবসা আর চাকরি ছাড়া তাদের আর কোনো চিন্তা ছিল না। তবে তারা অত্যন্ত সাহসী, তেজস্বী, একরোখা, সৎ আর কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন। তাই হিন্দু জামোরিন রাজারা তাদের সৈন্য হিসাবে মোপলাদের ব্যবহার করতেন। রাজাদের শক্তির উৎস ছিল তখন মুসলমান মোপলা। তাছাড়াও মালাবারের প্রত্যেক হিন্দুরাজা এ মোপলাদের সৈন্য, দেহরক্ষী অথবা পরামর্শদাতা হিসাবে চাকুরি দিয়ে রাখতেন এবং তাদেরকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন। মোপলা শব্দটি এসেছে মহা পোলাহ থেকে যার অর্থ বড় ছেলে। এসব মোপলারা ভারতীয়দের সাথে অত্যন্ত মধুর ব্যবহার করতেন। তাদের বীরত্ব ও চরিত্র মাধুর্যে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, অস্ত্র বা ভয় দেখিয়ে নয়।
পশ্চিমা আগ্রাসন ও লুটপাটের সূচনা:
১৪৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগালের রাজা ‘ইমানুয়েল’-এর পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ভাস্কো-দা-গামা’ ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কার করতে পর্তুগাল থেকে পাড়ি জমান। এর শত শত বছর আগে থেকেই আরব নাবিকরা নৌপথে ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছিলেন। ভাস্কো দা গামা উত্তমাশা অন্তরীপ পাড়ি দেওয়ার পর রাস্তা হারিয়ে ফেলেন এবং আরব নাবিকদের কাছে সাহায্য চান। অবশেষে বিজ্ঞ আরব নাবিকদের সাহায্যে তিনি ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপক‚লে কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন। পর্তুগীজরা জলদস্যুতার জন্য কুখ্যাত ছিল। ভাস্কো দা গামার এই আবির্ভাবের উদ্দেশ্যও ছিল ঐ লুটপাট এবং ভারতে পর্তুগীজ উপনিবেশ স্থাপন। এজন্য তিনি গোলমরিচ ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। কালিকটের রাজা গোলমরিচের নতুন খরিদ্দার হিসাবে তাকে স্বাগত জানান। সেখানকার রাজাদের ধারণা ছিল এরাও মুসলমানদের মতো ব্যবসা করবেন এবং তাদের সাথে সহযোগিতা করবেন। এ সময় বিচক্ষণ মুসলমানরা তাদের চালচলন ও কার্যক্রম দেখে রাজাকে সাবধান করেন যে, এই ক্যাথেলিক খ্রিষ্টানদের উদ্দেশ্য কেবল ব্যবসা বা খ্রিষ্টধর্মের অমীয় বাণী প্রচার নয়, আসল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিল ও লুটতরাজ। রাজা তাদের কথা বিশ্বাস করেন এবং সাবধান হন। ভাস্কো দা গামা একই বছর ২৯ আগস্ট এ দেশের মানচিত্র এবং নানা সংবাদ ও তথ্য নিয়ে স্বদেশ রওয়ানা হলেন। ভাস্কো দা গামার স্বদেশ ফেরা সম্ভব হত না যদি না একজন বড় রাজকর্মচারী ব্রাহ্মণের সীমাহীন প্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব না পেতেন। ভাস্কো দা গামা সে ব্রাহ্মণকে জাহাজে ডেকে পাঠালেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিত বিনা দ্বিধায়, হয়তো পুরস্কারের আশায় সাক্ষাত করতে গেলেন। অতঃপর ভাস্কো দা গামা তার হাত দু’টি ও কান দু’টি কেটে একটি বাক্সে ভরে রাজা জামোরিনকে একটি চিঠিতে লিখে পাঠালেন — ভাস্কো দা গামার অনুরোধ, রাজা যেন এ মাংস রান্না করে খান (ভারতবর্ষ ও ইসলাম- শ্রীদাসগুপ্ত, পৃষ্ঠা ২১)।
ঠিক দুই বছর পরে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর পেড্রো আল ভারেজ কাব্রাল তেরটি নৌ-বহর নিয়ে ভারতবর্ষে আসেন এবং সামরিক কুঠি স্থাপন করেন। এসেই তারা মুসলিম বণিকদের মাল বোঝাই জাহাজ দখল করতে থাকে। ফলে মুসলিমরাও বীর বিক্রমে তাদের কুঠি আক্রমণ করেন। কুঠির অধ্যক্ষ আইরস কোরিয়াকে খতম করেন। ফলে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়। তারপর মি. কাব্রাল কোচিনে এসে সেখানকার রাজাকে কালিকটেরও রাজা করে দেওয়ার লোভ দেখালেন। এরপর ভাস্কো দা গামা ১৫০২ সনে ভারতে সামরিক নৌ-বহর নিয়ে এসে যা করলেন তা জানলে চমকে যেতে হয়। তিনি কালিকটে পৌঁছে রাজা জামোরিনকে আদেশ দিলেন ‘সমস্ত মুসলমানকে দেশ হতে বের করে দিতে হবে’। অবশ্য ন্যায়পন্থী রাজা তা অস্বীকার করেন। ফলস্বরূপ ভাস্কো দা গামার জাহাজ থেকে গোল মরিচের পরিবর্তে অবিরাম গোলা বর্ষণ হতে দেখা গেল। বহু নিরপরাধ মানুষ ভাস্কো দা গামার গোলায় মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এরপর তিনি মক্কাগামী হজযাত্রীদের জাহাজও লুট করেন। তিনি গোটা শহরটা শ্বশ্মান করে ছাড়লেন। এরপর আরও কয়েকজন রাজার সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি করে মি. কাব্রাল কোচিনে নিরাপদ দুর্গ ও গীর্জা তৈরি করলেন। এটাই বোধ হয় ‘এক হাতে অস্ত্র আর অন্য হাতে শাস্ত্র’ নিয়ে শাসনের ভিত্তি। ক্যাথেলিক খ্রিষ্টানরা গুপ্তচর দিয়ে খবর নিতে লাগলেন কোন সময় রাজা জামোরিন বাইরে যান। ১০ বছর পর সময় উপস্থিত হল। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি কালিকটে হামলা চালালো পর্তুগীজ বাহিনী। শহরবাসী রুখে দাঁড়ালো এবং প্রধানত মুসলমান বণিক ও মোপলাদের বীরত্বের ফলেই পর্তুগীজদেরকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হলো। এই ঘটনাগুলিকে বিকৃত করে ইংরেজদের লিখিত ইতিহাসগুলিতে বলা হয়েছে যে, ধর্মান্ধ মুসলমান মোপলাদের নিষ্ঠুর আক্রমণে পর্তুগীজরা বিতাড়িত হয় এবং পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে মোপলাদের এই পদক্ষেপের একমাত্র কারণ হচ্ছে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা (উইকিপিডিয়া)। অথচ ঐতিহাসিক শ্রীদাসগুপ্ত লিখেছেন, ‘(ইউরোপীয়রা) নিজেদের চরিত্র নিষ্কলঙ্ক রাখার জন্য ভারতীয় ও আরবদের এ সম্মিলনকে ধর্মান্ধতার ভিত্তিতে দাঁড় করিয়েছে এবং যে অভিযোগের অনুক্ত তাৎপর্য হল নিজেদের ইউরোপীয় সাধুতা প্রমাণ করা।”
কলিকট থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর খ্রিষ্টানরা বুঝতে পারলেন মুসলমানদের না হটালে তাদের ব্যবসা ও ক্ষমতার প্রসার কোনোটাই সম্ভব নয়। তাই এর পর থেকে তারা মুসলমানদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করলেন এবং ভারতীয়দের সঙ্গে কিছু কিছু বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করলেন। এদিকে ১৫২৪ সনে ভাস্কো দা গামা মারা গেলেন। তার এত বড় কাণ্ড মোটামুটি গোপনই আছে। তার উপর কু-ধারণা জন্মানোর কোনো প্রয়োজন ইংরেজদের হয় নি। শুধু মুসলমানদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর তুলে রাখা তাদের খুবই প্রয়োজন হয়েছিল, ভারতবর্ষকে শোষণ করার জন্য।
মোপলা বিপ্লব:
মোপলাদের বড় দোষ অথবা গুণ হচ্ছে, তারা বরাবর ইংরেজ বিরোধী। তাঁরা ছোট বড় অসংখ্য বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে পাঁচটি বিদ্রোহ ‘বিপ্লবের’ দাবিদার। ১৮৫৭ এর বিপ্লবের পরেও তাঁদের এ বিদ্রোহগুলো যথাক্রমে হয়েছিল ১৮৭৩, ১৮৮৫, ১৮৯৪, ১৮৯৬, ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে।
বিপ্লবীদের একশ ভাগই ছিলেন মুসলমান। আর যেহেতু সেখানকার রাজা-মহারাজা-জমিদাররা বারে বারে ইংরেজদের সাহায্য করে এসেছেন, তাই বিপ্লবী মোপলা বাহিনী হিন্দু বিত্তবানদেরও শত্রু মনে করতে দ্বিধা করে নি। উপেক্ষিত শোষিত অনুন্নত নিম্নশ্রেণির অমুসলমানরা প্রতিবারেই মোপলাদের সাথে যোগ দেয়ার ইচ্ছা করলেও নেতৃস্থানীয় মধ্যবিত্তদের কৌশলময় প্রচারের দ্বারা তাদের বোঝান সম্ভব হয়েছে যে ওটা হিন্দু-মুসলমানদের লড়াই। তাই অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যবহারের ফলে নীল বিদ্রোহের মতো হিন্দু-মুসলমান একত্রিত হতে পারে নি। ইংরেজ সরকার সারা ভারতে যা করেনি তা করেছে মোপলাদের মালাবারে। তাঁরা সভা-সমিতি ও সম্মেলন করতে পারতেন না, কারণ কঠোরভাবে তা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তাতেও বিপ্লবকে দমানো যায় নি, বরং আগুনে পেট্রোল ঢালা হয়েছে। ফল হিসাবে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে মোপলারা মালাবারকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন এবং স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দেন। সৈন্যদের সাথে মুসলমান মোপলাদের ভয়াবহ সংগ্রাম শুরু হয়। একদিকে শোষক ও শাসক ইংরেজ ও তাদের ধামাধরা স্তাবকের দল, অন্য দিকে শাসিত শোষিত ভগ্নদেহ মৃত্যু পথযাত্রী বিপ্লবীর দল। ইংরেজ সৈন্যদের হাত হতে ওয়ালুতানাদ ও এরনাদ নামক দু’টি স্থান ছিনিয়ে নেয়া হলে যুদ্ধ আরো জোরদার হয়।
তাছাড়া, সে সময় এ এলাকার বাইরে চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম ইত্যাদির যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়। আর বাইরে থেকে আসা প্রত্যেকটি চিঠি পরীক্ষা করে তবে বিলি করা হতো। সামান্য ক্ষতির গন্ধ থাকলে তা বিনষ্ট করা হতো। তবে সরকারি খবরাখবর আদান প্রদান অব্যাহত ছিল। মোপলা বাহিনী ইংরেজের সাহায্যকারী কিছু ভারতীয় নেতাদের এ সময় নিহত করেন। চতুর ইংরেজরা দ্রুত গতিতে সফলতার সঙ্গে প্রচার করে দিল ‘মুসলমান কর্তৃক হিন্দু আক্রান্ত’। ইংরেজদের এ সমস্ত কুকীর্তি সরকারিভাবে গোপন রাখার চেষ্টা করা হলেও ভারতীয় নেতৃমহলে তা পৌঁছে যায়। সাথে গান্ধীজী, মাওলানা মহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী মোপলা হত্যা এবং নকল সা¤প্রদায়িকতার খেলা বন্ধ করতে মালাবারে প্রবেশ করতে উদ্যত হলে ইংরেজরা তাঁদের মালাবারে ঢুকতে না দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, কাউকে এখন মালাবারে ঢুকতে না দেয়ার আইন চালু রয়েছে (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২৩০-১)। এবার ব্রিটিশ সরকার মালাবারে হাজার হাজার সৈন্য নানা ধরনের ট্যাঙ্ক, কামান, বোমা কতকগুলো গানবোট এবং রণতরী নিয়ে আসে। তার আগে ইংরেজি কায়দায় অপপ্রচার হয়েই ছিল। সুতরাং হিন্দুরা বিপ্লবী মুসলমানদেরকে তাদের জাতীয় শত্রু মনে করে লড়াইয়ে নেমে পড়েন। একদিকে ইংরেজ শক্তি তো আছেই, অন্যদিকে বাড়িতে পল্লীতে হিন্দু-মুসলমান লড়াই এক বীভৎস রূপ নিল। যুদ্ধ চলল একমাস। তারপর একদিন ইংরেজরা আকাশ হতে বোমা বর্ষণ, রণতরী হতে শেল বর্ষণ, ট্যাঙ্ক ও কামান হতে গোলা বর্ষণ করে মোপলাদের ঘর-বাড়ি, দোকান পাট, ভষ্মস্ত‚পে পরিণত করে। যুদ্ধ শেষে মোপলা বাহিনীর দশ হাজার পুরুষ নারীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। আর জীবন্ত যাদের পাওয়া যায় তাদের বন্দী করে বিচারের’ জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। বিচারের পূর্বেই অনেক পুরুষ ও শিশুকে হত্যা এবং নারীদের উপর লজ্জাষ্কর পাপাচার করা হয়। বাকী বেঁচে থাকা আসামীদের বিচার-ফল এমন দাঁড়ায়-এক হাজার জনের ফাঁসি, দু’ হাজার লোকের দ্বীপান্তর অর্থাৎ সে আন্দামানে শ্রমসহ নির্বাসন আর আট হাজার লোকের পাঁচ হতে দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। শাস্তির কি সুষম বণ্টন! যাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হয় তাদেরকে প্রকাশ্য স্থানে গাছের ডালে ফাঁসি দেওয়া হয়। এত বড় ঘটনাও ব্রিটিশদের কারসাজিতে ইতিহাস বইগুলির পাতায় ঠাঁই পায় না।
এ অত্যাচারের ইতিহাসে আর একটি মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে। জীবন্ত বিপ্লবীদের মধ্যে যাঁরা শিক্ষিত ও নেতৃস্থানীয় ছিলেন তাদের মধ্যে বাছাই করা আশিজনকে ট্রেনের একটা ছোট্ট কামরায় দরজা জানালা বন্ধ করে কালিকটে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে তৃষ্ণায় কাতর হয়ে বন্দী বিপ্লবীরা পানির জন্য চিৎকার করেন এবং পানি ভিক্ষা চান। কিন্তু সে আর্তনাদে নিষ্ঠুরদের প্রাণবিগলিত হয়নি। যখন ট্রেন কালিকটে পৌঁছাল তখন দেখা গেল অধিকাংশই মৃত্যুবরণ করেছেন। আরও দেখা গেল, একজন অপর জনের জিভ চুষে পিপাসা মেটাবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সে শুষ্ক রসনা ততটুকু রস দিতে পারেনি যা তাঁদের বাঁচাতে পারত। এতবড় একটা কাণ্ড ঘটিয়েও ইংরেজরা একে হিন্দু-মুসলিম রায়ট বলে চালিয়ে দেয় এবং ভারতের রাজনৈতিক নেতারা এই দুঃখজনক ঘটনার আদ্যোপান্ত জেনেও নিশ্চুপ থাকে। খেলাফত কমিটির নেতা মাওলানা মহাম্মদ আলী এটা নিয়ে হৈ চৈ করতে গিয়ে পার্টির নেতাদের থেকে বাধা পেয়ে খুব আঘাত পান এবং কংগ্রেসের উপর আস্থা হারান (আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২৩১-২৩৩)।
‘মুসলিমরা এই উপমহাদেশে সাত শতাব্দী ধরে শাসন প্রশাসন চালিয়েছে। এত দীর্ঘ সময়ে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে কোথাও একটিও দাঙ্গা হলো না, আর ব্রিটিশ শাসনামলেই হিন্দুরা কেন মুসলমানদের জাতশত্রুতে পরিণত হলো’ — এই রক্তস্নাত প্রশ্নবোধক চিহ্নটি ভারতবর্ষের আকাশে বাতাসে আজও হাহাকার করে ফিরছে। কিন্তু দুঃখ এখানেই শেষ নয়। আজও প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সেই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া গোলামি শিক্ষাই সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে; যে শিক্ষা শিখে আমাদের এই জাতিটি না জানছে তাদের গৌরবময় অতীত, সাহসী পূর্বপুরুষদের বিক্ষোভজ্বালা, না জানছে সভ্যতার মুখোসধারী নরপশুদের তৈরি করা ইতিহাসের নির্মম নিষ্ঠুরতার কালো অধ্যায় বরং উল্টো তারা পরিণত হচ্ছে সেই পাশ্চাত্য প্রভুদের পা-চাটা গোলামে।