হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

বেড়ে চলেছে অপরাধ: শান্তি ফেরানোর উপায় কী?

শাহাদৎ হোসেন:
দেশে দিন দিন বেড়ে চলেছে নানা ধরণের অপরাধ। ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দস্যুতা, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ, চুরি, নারী নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধ বৃদ্ধির ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, কেবল আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই সামাজিক অপরাধ, অন্যায় ও অশান্তি বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই নানা অপরাধের চিত্র ফুটে ওঠে।

সাম্প্রতিক অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশি ব্যবস্থার ভেঙে পরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় না থাকায় অপরাধ বাড়ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ও আত্মিক অবনতি এতটাই তলানিতে পৌঁছেছে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে পারলেই তারা অপরাধ সংঘটিত করছে। অপরাধের মধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণের মতো অপরাধ ছাড়াও সামাজিকভাবে ক্ষতিকর একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মব কালচার’। ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর হামলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা, মাজারে হামলা ইত্যাদি ঘটনা বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা মাজার ভাঙচুর, সাংস্কৃতিক অঙ্গণে হামলা, ইত্যাদির ঘটনা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এসব হামলায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট যেন এখন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে। বেকারত্ব, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, মাদকের সহজলভ্যতা, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতাও অপরাধ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তবে মব কালচারের বৃদ্ধির পেছনে ধর্মীয় মতাদর্শভিত্তিক বিরোধ কিংবা আক্রোশকে দায়ী করা হয়।

অপরদিকে বিশ্বের সকল দেশেই অপরাধের লাগাম টেনে ধরতে পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি, আধুনিক প্রশিক্ষণ, উন্নত প্রযুক্তি ও অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হলেও বাস্তবে অপরাধপ্রবণতা কমছে না। তবে ইতিহাস বলে, এমন এক সময় ছিল যখন কোনো পুলিশ বাহিনী ছিল না, তবু মানুষের জীবন ছিল সর্বোচ্চ নিরাপদ। তখনকার আদালতগুলোতে অপরাধজনিত মামলার উপস্থিতি ছিল বিরল। কল্পনা করা কঠিন হলেও বাস্তব ইতিহাস বলে, ১৪শ’ বছর আগে রাসূল (সা.) এর হাতে গড়ে ওঠা সমাজে এমনই শান্তি বিরাজ করেছিল। আল্লাহ প্রদত্ত জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সে সমাজে অপরাধ দমন সম্ভব হয়েছিল।

একটি জাতীয় পত্রিকার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সামগ্রিক অপরাধ বেড়েছে ৬ দশমিক ১৬ শতাংশ। দস্যুতা ৪১ শতাংশ, অপহরণ ৮৬ শতাংশ, খুন ৬৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।

প্রতিবেদন অনুসারে, গত সাত মাসে খুনের মামলা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৮৪০টি খুনের মামলা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত ৯৮৬টি খুনের মামলা ৫ আগস্টের পর দায়ের করা হয়েছে। এ হিসাব বাদ দিলে খুনের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ।

অপরাধ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি। পুলিশি ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, অপহরণ, খুন, ধর্ষণ, চুরি ও সিঁধেল চুরির মতো অপরাধ বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল কঠোর আইন প্রয়োগ বা পুলিশ পাহারার মাধ্যমে অপরাধ দমন সম্ভব নয়। কারণ, মানুষ শুধু শরীরসর্বস্ব প্রাণী নয়, তার একটি আত্মাও আছে, যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি নিশ্চিত না করা গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে অপরাধ বন্ধ করা অসম্ভব।

বর্তমানের আইন, বিচার ও শাসনব্যবস্থা পাশ্চাত্যের অনুসরণে তৈরি, যা মানুষের আত্মার সংশোধন নিশ্চিত করতে পারে না। বরং দেখা যায়, ছোট অপরাধে জেলে যাওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হয়ে বের হয়, আইনের ফাঁক গলে আরও ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সমাজ থেকে চুরি দূর করতে হলে প্রথমে অভাব দূর করতে হবে, যেন কেউ চুরি করতে বাধ্য না হয়। এরপর মানুষের নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে তাদের মনে আত্মিক বাধা সৃষ্টি করতে হবে। এরপরও কেউ চুরি করলে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এভাবেই ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

সঠিক নৈতিক শিক্ষার অভাব, দুর্নীতি ও বৈষম্যমূলক বিচার ব্যবস্থাই অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

ইসলামের শাসন ব্যবস্থায় সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং নৈতিকতার শিক্ষা ছিল অপরাধ দমনের মূল চাবিকাঠি। যাকাত ব্যবস্থা দ্বারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন করা হয়েছিল, যার ফলে চুরি করার প্রয়োজন হতো না। ইসলামী সমাজে পারিবারিক বন্ধন মজবুত থাকায় বিচ্ছিন্নতা, হতাশা ও অবক্ষয়ের সুযোগ কম ছিল। এছাড়াও, অপরাধের শাস্তি যেমন ছিল নিশ্চিত, তেমনই অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগও দেওয়া হতো।

তাই একমাত্র প্রকৃত ইসলামই পারে এমন ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে, যা অন্যায়-অপরাধের মূল উৎপাটন নিশ্চিত করবে। তাই অপরাধ দমন করতে হলে কেবল কঠোর আইনই নয়, বরং ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। একমাত্র আল্লাহর দেওয়া ইসলামের সঠিক আদর্শই পারে সমস্ত অন্যায়, অবিচার দূর করতে।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...