আমাদেরকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, “আপনারা যে বলেন দেশকে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অপরাজনীতি থেকে, সর্বোপরি অনিবার্য বিশ্বযুদ্ধের করাল থাবা থেকে নিরাপদ রাখার জন্য যে আদর্শ দরকার সেটা আপনাদের কাছে আছে। আচ্ছা বলুন তো সেই আদর্শটি কী?”
বস্তুত এ আদর্শটা দু’ এক কথায় বোঝানো সম্ভব না। একটু ভাবুন তো, আল্লাহর রসুল (সা.) কোন আদর্শ দিয়ে আইয়ামে জাহেলিয়াতের আরবের সমাজ থেকে যাবতীয় হানাহানি, বর্বরতা, কুসংস্কার, অন্যায়, অবিচার দূর করেছিলেন? কোন আদর্শ দিয়ে মরুবাসীদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-চিকিৎসা, প্রযুক্তি, সামরিক অর্থনৈতিক সর্বদিকে শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছিলেন? কোন আদর্শ দিয়ে আজন্ম শত্রুদেরকে ভাই বানিয়েছিলেন? এ সবগুলো প্রশ্নের এক কথায় উত্তর হচ্ছে, আল্লাহর রসুলের সুমহান নেতৃত্ব ও শিক্ষাই ধীরে ধীরে একটি বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠীকে মহান জাতিতে, উম্মাহয় পরিণত করেছিল। তিনি স্বয়ং ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, আদর্শের শিক্ষালয়, যে জন্য তাঁকেই পবিত্র কোর’আনে উসওয়াতুল হাসানাহ বা সর্বোত্তম আদর্শ বলা হয়েছে।
যারা প্রশ্ন করেন যে, হেযবুত তওহীদের কাছে কী আদর্শ আছে তারা যদি সহজে বিষয়টি বুঝতে চান তাহলে বলব, আপনারা হেযবুত তওহীদকে দেখেন। হেযবুত তওহীদ আন্দোলনটাই হচ্ছে সেই আদর্শ। যে আন্দোলনটি ২২ বছর ধরে একটু একটু করে বহু ত্যাগ তিতীক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই পাচ্ছে সেই আন্দোলনের প্রতিটি সদস্যকে যোগদানের পর থেকে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে তারা পরিচালিত করা হয়েছে। না, কোনো আনুষ্ঠানিক রীতি-রেওয়াজ নয় বরং কিছু নীতিমালা শক্তভাবে তাদেরকে মান্য করতে হচ্ছে। যেমন –
(১) এ আন্দোলনের সদস্যরা কোনোরূপ অবৈধ অস্ত্রের সংস্পর্শে যাবে না।
(২) কোনো অবৈধ পথে রোজগার করবে না।
(৩) মানবতার কল্যাণে তারা নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করবে।
(৪) ধর্মের কাজের কোনো বিনিময় নেবে না।
(৫) জাতির ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবে না।
(৬) ধান্ধাবাজির রাজনীতিতে জড়িত হবে না।
এ কথাগুলো কেবল আন্দোলনের নীতিমালার বইয়ে লেখা আছে তেমন নয়, এই কথাগুলোকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য নিজেদেরকে কোরবান করে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে এর নিবেদিতপ্রাণ কর্মীগণ। অন্যায়পূর্ণ সমাজে এ যে কত কঠিন কাজ তা চিন্তাশীল মানুষমাত্রই বুঝতে পারবেন। যখন চারদিকে দুর্নীতির হাতছানি, হারাম উপার্জনের প্রলোভন, প্রতিটি মানুষ যখন দুর্নীতির ভুক্তভোগী তখন লোক দেখানোর জন্য দুর্নীতিবিরোধী মানববন্ধন করা হয় তো সোজা কিন্তু নিজেরা দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ না করা, হালাল উপার্জন করা অত সোজা নয়। সমস্ত সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করছে স্বার্থের পূজারী হতে, সেখানে স্বার্থে পেছনে না ছুটে উল্টো নিজের সর্বস্ব মানুষের জন্য বিলিয়ে দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম করে যাওয়া কতটুকু কঠিন একটু চিন্তা করুন। একটি মহাকাশযানকে পৃথিবীর আকর্ষণ বলয় অতিক্রম করার জন্য প্রতি সেকেন্ডে ১১.১৮৬ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। ঠিক তেমনি অসততা, স্বার্থপরায়ণতা, আত্মকেন্দ্রীকতা প্রতিটি মানুষের জীবনকে, কর্মকে, সিদ্ধান্তকে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে নিচের দিকে টেনে নামাচ্ছে। এই নিম্নমুখী আকর্ষণের বিরুদ্ধে গত ২২ বছর ধরে বিপরীতমুখী লড়াই করে যাচ্ছে হেযবুত তওহীদ।
আত্মার সাথে বাস্তবতার এ অসম লড়াইয়ের কথা বলা সহজ কিন্তু করা কঠিন। এরই মাঝে কয়েক হাজার কর্মী সেই চরিত্রে ও আদর্শে সমুন্নত বলীয়ান হয়েছে যার পরিণতিতে আজ পর্যন্ত হেযবুত তওহীদের কেউ কোনো আইন ভঙ্গ করে নি, কোনো অবৈধ অস্ত্রের সংস্পর্শে যায় নি, দেশ ও জাতির কোনো ক্ষতিসাধন করে নি, অবৈধ পথে রোজগার করে নি। বরং নিজেদের জীবন-সম্পদ যতটুকু আছে ততটুকুই উজাড় করে দিচ্ছে সমাজের জন্য। যাদের মুক্তির জন্য এই আত্মদান সেই মানুষ ধর্মব্যবসায়ীদের প্ররোচনায় তাদেরকে গালি দিচ্ছে, মারছে, তাদের বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে, হত্যা করে ফেলছে তবু তারা দমে যায় নি। বর্তমান পৃথিবীতে এমন একটি আন্দোলনের তুলনা কোথায়?
হেযবুত তওহীদের আদর্শ পেয়ে, এর নেতৃত্বের অধীনে থেকে, এর কর্মসূচি মান্য করে, এর নীতিমালা ও দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দশ হাজার মানুষ যদি নিজেদেরকে এমন বৈপ্লবিকভাবে পাল্টে ফেলতে পারে তাহলে এটা স্বাভাবিক যে, ষোল কোটি মানুষও একই আদর্শে দীক্ষিত হলে তারাও একই প্রকার ন্যায়নিষ্ঠ, দেশপ্রেমিক, পরের কল্যাণে আত্মোৎসর্গকারী ন্যায়যোদ্ধায় পরিণত হবে। তারাও কোনো অন্যায় করবে না, তারাও দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে উদগ্রীব হবে, তারাও স্বার্থবাদী ধান্ধাবাজির রাজনীতিকে ঘৃণা করবে, তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করবে না, তারাও ধর্মের দ্বারা স্বার্থসিদ্ধি করবে না, তাদের সামনে টাকার বস্তা পড়ে থাকলেও আত্মসাৎ করবে না, তাদের সমাজে কোনো নারী অসম্মানিত হবে না, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো বেতনভুক্ত বাহিনীর প্রয়োজন হবে না। তারা জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড করবে না বরং জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করবে। তারা সবাই আত্মিকভাবে এতটুকু পরিশুদ্ধি অর্জন করবে যে তারা লোকচক্ষুর অগোচরেও কোনো অপরাধ করবে না এবং তাদের সামনে কাউকে কোনো অপরাধ করতে দেবে না।
এটা জানা কথা যে, একটি সমাজ থেকে অপরাধপ্রবণতা নির্মূল করতে নৈতিক মূল্যবোধ ও দণ্ডবিধি দুটোই প্রয়োজন হয়। বর্তমানে হেযবুত তওহীদের হাতে কাউকে দণ্ড প্রদানের কোনো অধিকার নেই, যতটুকু ন্যায়নিষ্ঠার স্বাক্ষর হেযবুত তওহীদ রাখতে পেরেছে সেটা কেবল আদর্শেরই গুণে। এর সঙ্গে যদি অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার বৈধতা পাওয়া যায় তাহলে নিশ্চিত রূপে বলা যায় অন্যায় অপরাধ থেকে জাতিকে প্রায় শতভাগ পবিত্র করার উদাহরণ হেযবুত তওহীদ সৃষ্টি করতে সক্ষম ইনশাল্লাহ।
মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে যতই প্রচারণা চালানো হোক, যতই নিরাময়কেন্দ্র তৈরি হোক, যতই পুলিশি অভিযান পরিচালনা করা হোক মাদকের অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পাচ্ছে না। অথচ হেযবুত তওহীদের কোনো সদস্য যদি পূর্বে মাদকাসক্ত থেকেও থাকে, হেযবুত তওহীদের সংস্পর্শে এসে তারা নিজেদের জীবনের একটি লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে, সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে। তারা আর নিজেদের প্রাণশক্তিকে, নিজের শরীর ও মনকে ধ্বংস করতে রাজি নয়। তারা বুঝতে পারছে যে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের মূল্য রয়েছে। যে পথভ্রষ্ট তরুণের দল নিজেরাই ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত তারাই এখন দেশ ও জাতিকে চূড়ান্ত ধ্বংসের হাত থেকে উদ্ধার করতে পাগলপারা হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে এই মানসিক পরিবর্তন হেযবুত তওহীদ ছাড়া আর কে আনতে পারছে? এখানে প্রতিটি অন্যায়কে ঘৃণা করা হচ্ছে, অন্যায়কারীর হস্ত চেপে ধরা হচ্ছে, কেউ মন্দ কাজে বা আলস্যে সময়ের অপচয় করলে অন্যরা তাকে গতিশীল করে তুলছে, তার সুপ্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুলছে। তাই হেযবুত তওহীদের বলয়ের মধ্যে যেই আসছে সেই একটি ভিন্ন গতিশীলতার আস্বাদ লাভ করছে। দেশে বা দেশের বাইরে আর কোন সংস্থা আছে, কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষা দিয়ে সুশৃঙ্খল নাগরিক তৈরি করছে?
কাজেই হেযবুত তওহীদ নিজেই সেই আদর্শের মূর্তরূপ যা মানবজাতিকে যাবতীয় সংকট ও বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করার প্রত্যয় নিয়ে মানবের দুয়ারে অপেক্ষমান রয়েছে। ষোলো কোটি মানুষ হেযবুত তওহীদকে ধারণ করলেই কাক্সিক্ষত মুক্তির মহাসড়কে উত্তীর্ণ হতে পারবে।