সম্পাদনা: জুবায়ের আহমেদ
ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি ‘মুসলমান’ আর ‘বিজ্ঞান’ দুটি আলাদা আলাদা শব্দ। নিজের ধ্যান-ধারণা থেকে যতটুকু বুঝতে পেরেছি তা হলো- এ শব্দ দুটি কখনো এক করা যায় না, যা বাস্তবিকভাবেই একটু চিন্তা করলেই দেখা যায়। ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের যত আবিষ্কারের কথা জেনেছি সবই নাকি করছে ইহুদি খ্রিষ্টানরা, মুসলমানরা নাকি এর ধারে কাছেও ছিল না। ধর্মীয় আলেমদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, “ধর্ম হলো বিশ্বাসের বিষয়। কিন্তু বিজ্ঞান শুধু যুক্তিকে প্রাধান্য দেয়। বিজ্ঞান নাস্তিকতায় বিশ্বাসী, অধিকাংশ বিজ্ঞানীই নাস্তিক। তাই মুসলমানরা বিজ্ঞানে কোন অবদান রাখতে পারে নাই।” তাদের ব্যাখ্যাটা আমার কাছে খুব বেশি একটা সুবিধার ঠেকলো না। তারপরও প্রকৃত সত্যটি খুজতে লাগলাম। ধর্ম বই থেকে ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া আর বেশি কিছু জানা যায় না। আর বিজ্ঞান বই থেকে বিজ্ঞান সর্ম্পকে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেখানে ধর্মের সঙ্গে কোনো মিল নেই এবং মুসলমানদের কোনো ভূমিকাই সেখানে দেখতে পাই না।
আমার মনে পড়ে কোথায় যেন শুনেছিলাম রসায়ন-বিজ্ঞানের জনক জাবির ইবনে হাইয়ান। কিন্তু ইদানিং শুনছি ল্যাভয়সিয়ের কথা। আবার শুনতাম জ্যোর্তিবিজ্ঞানের জনক আল-বাত্তানী, কিন্তু এখন শুনছি আধুনিক জ্যোর্তিবিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও গ্যালিলি। আগে তারা বলতো শুধু ‘জনক’, এখন বলে ‘আধুনিক জনক’। আর এই শিক্ষাটাই এখন আমাদের গলাধকরণ করানো হচ্ছে, আমরাও বোকার মতো চাবিয়ে চাবিয়ে খাচ্ছি। অর্থাৎ বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে তারা ‘মুসলমান’ শব্দটা পুরোপুরি মুছে ফেলতে চায় এবং বরাবরই তারা সে কাজটিতে শতভাগ সফলও হয়েছে।
আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাস সর্ম্পকে জানতে চাইলে ইহুদী-খ্রিষ্টানরা তাদের বইগুলোতে প্রথমে বলে গ্রীক দার্শনিকদের (অর্থাৎ প্লেটো-আ্যরিস্টটল-সক্রেটিসদের) কথা, তারপর এক লাফে চলে আসে নিউটন-আইনস্টাইন-এডিসনদের যুগে। কিন্তু এরই মাঝে যে বিশাল সময়টা ছিল অর্থাৎ মুসলমানদের স্বর্ণযুগ (যেটাকে ইতিহাস থেকে ৯৯ শতাংশই মুছে ফেলা হয়েছে) আর ইউরোপিয়ানদের এই সময়টাকে বলা হয় বর্বরতার যুগ, অন্ধকার যুগ ইত্যাদি। সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথাটা ইহুদী-খ্রিষ্টানরা ইতিহাস থেকে লুকিয়ে রেখেছে।
আজ ইহুদী-খৃষ্টানরা আধুনিক সভ্যতার যে বিজ্ঞান নিয়ে অহঙ্কার করছে, তাতে কাদের অবদান বেশি সে ব্যাপারে পরে আসছি। আগে জেনে নেই, প্রকৃত ইতিহাসটা কী?
ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, ইউরোপে যে বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল তার শুরু হয়েছিল ১৬শ’ শতাব্দী থেকে। ১৬শ’ শতাব্দীর পূর্বে ইহুদী-খ্রিষ্টান উভয় জাতির মধ্যে তেমন কোন বিজ্ঞানীর পরিচয় পাওয়া যায় নি, অর্থাৎ তখনও তাদের বিজ্ঞানের অস্তিত্বের সূচনা শুরু হয় নি বললেই চলে। এ জন্য তারা দাবী করে, ১৬ শতাব্দী থেকেই নাকি আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা!
উইলিয়াম গিলবার্ট, কেপলার, গ্যালিলিও, স্নেল, বাইসেল প্যাসকেল, নিকোলাস কোপারনিকাস রবার্ট বয়েল, রবার্ট হুক, আলেকজেন্ডার গ্রাহাম বেল, আইজাক নিউটন সবাই যেন ১৬শ শতাব্দীতে এসে হঠাৎ করে নব নব বৈজ্ঞানিক সূত্র, মতবাদ আর প্রযুক্তির জন্ম দিতে শুরু করলো। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা কী?
এবার আসি মুসলিম বিজ্ঞানীদের সময়টায়, যেখানে তাদের জন্ম হয়েছে ১৪শ’ শতাব্দীর পূর্বে। যেমন:
মুসলিম বিজ্ঞানীদের সময়কাল |
অবদান |
অমুসলিম (ইউরোপীয়) বিজ্ঞানীদের সময়কাল |
মুসা আল খাওয়ারিজমি |
গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল। |
আইজ্যাক |
জাবির ইবনে হাইয়ান |
রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষ শাস্ত্র, প্রকৌশল |
এলবার্ট আইনস্টাইন |
আব্বাস ইবনে ফিরনাস |
চিকিৎসা, রসায়ন, প্রকৌশল বিদ্যা, আন্দালুসিয়ান |
গ্যালিলিও গ্যালিলাই |
আল বেরুনি |
পদার্থবিদ, গণিত, জ্যোতিবিদ্যা ও প্রকৃতি বিজ্ঞান, ইতিহাস, বহুভাষাবিদ, ইন্ডলজি, অর্থনীতি, জিওডেসি। |
আলভা এডিসন |
আবু নাসের আল ফারাবি |
দার্শনিক, আইনবিদ, যুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ। |
নিকোলাস কোপারনিকাস |
আল বাত্তানি |
জ্যোতির্বিজ্ঞানী, জ্যোতিষবিদ ও গণিত। |
অরভিল রাইট |
ইবনে সিনা |
জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, ভূগোল ও ভূতত্ত্ব, মনস্তত্ত্ব, ইসলামিক ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিজ্ঞান, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং কবিতা। |
উইলভার রাইট |
ইবনে বতুতা |
ভূ-পর্যটন |
জেমস ওয়াট |
ওমর খৈয়াম |
গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও কবি |
পিয়েরে ডি |
ইবনে কুরা (৮২৬-৯০১) |
“কিতাব আল-মুসিয়াক আল-কবির” এর লেখক |
রবার্ট বয়েল |
আবু বকর আল রাজী |
চিকিৎসা, রসায়ন, দর্শন ও চিকিৎসাবিদ্যা |
ব্লেইস পেসকেল |
আল কিন্দি |
দর্শন, গণি, চিকিৎসা ও সঙ্গীত। |
রেনে ডেসকার্টস |
ইবনে আল হাইসাম |
গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্য, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও চিকিৎসা। |
জোহানেস কেপলার |
ইবনে যুহর |
চিকিৎসক, সার্জন ও কবি। |
ক্রিস্টিয়ান হুইজেনস |
ইবনে খালদুন |
সমাজবিজ্ঞান ও জনসংখ্যা এর উপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ |
রবার্ট হুক |
ইবনে আল বাইতর |
চিকিৎসা |
গ্যাটফ্রিড উইলহেল্ম |
ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) |
যুক্তিবিদ্যা, আরিস্টটলিয়ান ও ইসলামী দর্শন, ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, রাজনৈতিক তত্ত্ব, আন্দালুসিয়ান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ভূগোল, গণিতের তত্ত্ব, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, বলবিদ্যা। |
উইলিয়াম হুইয়েল |
জাবির ইবনে হাইয়ান (৭২২-৮০৩) |
রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষ শাস্ত্র, প্রকৌশল বিদ্যা, ভূগোল, দর্শন, পদার্থবিদ্যা, ফার্মাসিস্ট ও চিকিৎসকা। |
মাইকেল ফ্যারাডে |
ইউরোপের আরো অনেক বিজ্ঞানী রয়েছেন যাদের জন্ম হয়েছে ১৬শ শতাব্দীর মধ্যে। অর্থাৎ মুসলমানরা যখন বিজ্ঞানের বিভিন্ন নতুন নতুন বিষয়াদি আবিষ্কার করতে শুরু করছিল। তখন ইহুদি-খ্রিষ্টানরা আমাদের ধারে কাছেও ছিল না। উল্টো আরো তখন ইউরোপ-আমেরিকা থেকে জ্ঞানী পণ্ডিতরা মুসলমানদের কাছে আসতো জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য। তার মানে হল- মুসলমানরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের শীর্ষে, তখন ইউরোপ অজ্ঞতার গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।
কিন্তু কিভাবে পেল ইউরোপীয়রা সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ছোঁয়া; আসুন দেখা যাক ইতিহাসের চোখে…….
১) বাগদাদ পতন: ১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত মঙ্গোলিয় জাতির প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খানের বংশধর হালাকু খান মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু বাগদাদ নগরীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মাত্র ৫০ হাজার সৈন্য বাহিনীর উপর হালাকু খানের দেড় লক্ষ বাহিনীর আক্রমণে মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে ধুলোয় মিশে যায় পুরো তৎকালীন সমৃদ্ধ শহর বাগদাদ। ধ্বংস করে দেয় মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র বাইতুল হিকমাহ লাইব্রেরী। আর এ লাইব্রেরী থেকে মুসলমানদের অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণা গ্রন্থ চুরি হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে ইহুদী ও খ্রিষ্টান জাতি করায়ত্ব করতে সক্ষম হয়।
২) স্পেন পতন: ১৪৯২ সালে রাণী ইসাবেলা এবং কস্টিলের রাজা ফার্দিনান্দ এর কাছে পরাজয় স্বীকার করে। এ সময় স্পেন ছিল মুসলিম সভ্যতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র, যেখানে বিশাল লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ছিল মুসলিম বিজ্ঞানীদের গবেষণাধর্মী বইসমূহ। স্পেন দখলের পর খ্রিষ্টানরা স্পেনের লাইব্রেরীগুলো দখল করে, তারা সেখান থেকে অনেক বই সরিয়ে ফেলে, অনেক বই নদীতে ফেলে দেয়, আবার অনেকগুলো আগুনে ধ্বংস করে দেয়।
১৫শ শতাব্দীতে মুসলিম বিজ্ঞানীদের থেকে লুট করা বইগুলো নিয়েই ১৭শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনা ঘটে, যাকে তারা নাম দিয়েছিল “আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনাকাল”। মুসলমানদের তৈরি করা ভিত্তির উপর গড়ে তুলেছে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের যুগের ইমারত। অনেক অসাধু ব্যক্তি মুসলিম বিজ্ঞানীদের আরবি বইকে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে মূল লেখকের নাম গোপন করেই প্রকাশ করে দিয়েছে। যেহেতু অধিকাংশ মুসলিমদের লিখিত বই সমূহ ছিল আরবী ভাষায়, খ্রিষ্টানরা আরবী খুব একটা বুঝতো না, কিন্তু ইহুদীরা আরবী ভাষা বুঝতো। তাই খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের বইগুলো ইহুদীদের কাছে দিয়েছিল অনুবাদের জন্য।
বিজ্ঞানের বিকাশ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কোনো একক সভ্যতার পক্ষে এর মালিকানা বা কৃতিত্ব দাবি করা অবান্তর। একজন বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের কোনো একটি শাখাকে বেশ কিছু দূর অগ্রণী করে যান। পরবর্তীতে আরেকজন বিজ্ঞানী এসে সেখান থেকে শুরু করে সেই শাখাকে আরো বিকশিত করেন। এখানে দুই জন বিজ্ঞানীর কৃতিত্বই আমাদেরকে স্বীকার করে নিতে হবে।
যেমন: আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হয় সর্বকালের সেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইবনে সিনাকে। যার লেখা ‘কিতাবুল ফিত্ তিব্’ গ্রন্ধটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ‘বাইবেল’ উপাধি দেওয়া হয়। তারপর রসায়ন বিজ্ঞানের জনক বলা হয় জাবির ইবনে হাইয়ানকে যাকে সালফিউরিক এসিড এবং নাইট্রিক এসিডের আবিষ্কর্তা বলা হয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বলা হয় আল-বাত্তানীকে। গণিতশাস্ত্রে আল-খাওয়ারিজমীকে বলা হয় বীজগণিতের জনক। আলোক বিজ্ঞানের জনক বলা হয় হাসান ইবনে হায়সামকে। এছাড়া মানবদেহের রক্ত সঞ্চালক পদ্ধতি এবং ফুসফুসের সঠিক গঠন পদ্ধতি, হৃৎপিণ্ডের রক্তের প্রবাহসহ ইত্যাদি আরো অনেক চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন ইবনুন নাফিস। তাছাড়া আরো অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা আধুনিক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মুসলমানদের বিরাট অবদানের কারণে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, দর্শনশাত্র, বীজ গণিত, দশমিক সংখ্যা, জ্যামিতি ইত্যাদি বিষয়গুলো আজ প্রতিষ্ঠিত।
গ্যালিলিওকে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড বেস্ট সেলিং “অ্যাস্ট্রোনোমি ম্যাগাজিন” একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে তারা স্পষ্ট স্বীকার করেছে- “আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্মদাতাই হচ্ছে মুসলমানরা”। প্রতিবেদনে বলা হয়- “৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ইউরোপ যখন ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত, তখন মুসলমানরা জ্ঞানচর্চার শীর্ষে অবস্থান করছিল। প্রায় ১৩শ’ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে দেয়।”
মুসলিমরা আজকে সর্বহারা। ইউরোপিয়ানদের পদানত দাস। সুতরাং দাস জাতি হীনম্মন্যতায় পূর্ণ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদেরকে সেই সোনালি ইতিহাসগুলো জানতে হবে যেন আমরা আবার সেখান থেকে জাতিকে জাগ্রত করার চেতনা লাভ করতে পারি।
তথ্যসূত্র: astronomy magazine, মুহম্মদ আব্দল্লাহর লেখা এবং ইন্টারনেট।