মোহাম্মদ আসাদ আলী:
খবরে প্রকাশ- ‘তুরস্কের বিচার বিভাগের সংস্কার নিয়ে বিরোধের জের ধরে গত বৃহৎ প্রতিবার জাতীয় সংসদের ভেতরে রীতিমত ঘুষোঘুষির ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি বা সিএইচপি’র উপপ্রধান বুলেন্ত তেজকান আহত হন এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়।’ (সূত্র: দেশেরপত্র, ২৫ শে জানুয়ারি)
সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এটা নতুন কোন ঘটনা নয়। আবার এমন ঘটনা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেই যে শুধু ঘটছে তাও নয়। ইতালি, মেক্সিকো, ইউক্রেন, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়ার মত দেশগুলোতেও সংসদের ভেতরে মারামারির রেকর্ড রয়েছে। এই ধরণের ঘটনা ঘটে থাকে সাধারণত সরকারি দল ও বিরোধী দলের বিরোধকে কেন্দ্র করে। গণতন্ত্রের ভাষ্যমতে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে নাকি সরকারি দল স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে একটি ‘চেক এ্যাণ্ড ব্যালান্স’ এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংসদে বিরোধী দলকে অপরিহার্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের আলোকে এই ব্যবস্থার অসারতা ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ এখন সরকারি দল বিরোধী দলকে ভয় করে না বরং দমন করে, আবার বিরোধী দলও সরকারের মন্দ কাজের সমালোচনা না করে উল্টো সরকারটাই বৈধ কি অবৈধ সেই প্রশ্ন তোলে। কাজেই যে ভারসাম্য আনয়নের উদ্দেশ্যে গণতন্ত্রে বহুদলীয় ব্যবস্থা রাখা হয়েছে শেষ পর্যন্ত সেই ভারসাম্য বজায় থাকছে না। তুরস্কের সংসদ তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।
সরকার হলো একটি দেশের নিয়ন্ত্রক। সুতরাং যারা সরকারে থাকবে তারা দেশের স্বার্থকে বিবেচনায় রেখেই কাজ করবে। জনসাধারণের অর্থ-সম্পদ জনগণের কল্যাণের কাজেই ব্যয় হবে। সরকার এখানে শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় তা সম্ভব হয় না। দেখা যায়- মানুষের সামনে ভোটের অধিকারের কথা বলে অর্থ ও বাহুবলে এক শ্রেণির স্বার্থবাদী লোক জনতার সামনে শতশত প্রতিশ্র“তির মুলা ঝুলিয়ে রেখে নির্বাচিত হন। তারা নিজেদেরকে দাবি করেন জনগণের প্রতিনিধি, অথচ রাষ্ট্র পরিচালনা করেন নিজেদের ইচ্ছেমত। তাদের ধারণা হলো- যেহেতু তারা জনগণের প্রতিনিধি কাজেই তারা যা যা করছেন তার সবই জনগণেরই ইচ্ছার প্রতিফলন। আর ঠিক এই কারণেই গণতন্ত্রে বিরোধী দলের প্রয়োজন পড়ে যাতে করে সরকার জনতার ইচ্ছার কথা বলে পারতপক্ষে জনগণের ক্ষতি হয় এমন কোন পদক্ষেপ নিতে না পারে। কিন্তু এটাও ব্যর্থ হয়। বিরোধী দল পরিণত হয় সম্পূর্ণভাবে সরকারবিরোধী একটি শ্রেণিতে। সরকার যা-ই করে বিরোধী দল সেটাকেই জনগণের জন্য অকল্যাণকর বলে প্রচার করে। প্রয়োজনে ছল-চাতুরী বা ষড়যন্ত্র করতেও কোন দ্বিধা করে না। ফলে অচিরেই সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে দা-কুমড়ার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। পুঞ্জিভূত হয় পারস্পরিক তীব্র ঘৃণা-ক্ষোভ। এমনও দেশ রয়েছে যে দেশের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক এই বিরোধের জের ধরে পরস্পরের মুখ দর্শন বন্ধ করে দেন। তারা সমালোচনা করেন পেছন থেকে। সমালোচনার ভাষা এমন অশালীন পর্যায়ে যায় যে, তাদের তীর্যক বাক্যবান থেকে তাদের পূর্বপুরুষগণও রেহাই পান না। সাধারণ মানুষ, যারা ঐ নেতৃবৃন্দকে দেশ পরিচালনায় বসিয়ে আশা করেছিল যে- ‘নেতৃবৃন্দ নিজেদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলবে, তারাই নেতাদের আচরণে অসন্তুষ্ট এবং এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়। যেহেতু উভয়পক্ষেরই (সরকার ও সরকার বিরোধী) একটি বিরাট সংখ্যার কর্মী-সমর্থক থাকে কাজেই এই বিরোধ পারস্পরিক ঘৃণা বা সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তা রূপ নেয় জাতির অভ্যন্তরীণ সংঘাত-সহিংসতায়। পরিসংখ্যান খুললেই দেখা যাবে- প্রতিটি দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ হত্যা, গুম, সন্ত্রাস হয়ে থাকে তার অধিকাংশই হয় রাজনৈতিক দলাদলীর কারণে। কাজেই বহুদলীয় গণতন্ত্র তার স্বপক্ষে যে যুক্তি দেখায় তা ভণ্ডুল হয়ে যাচ্ছে অনায়াসেই।
তবে এসবের জন্য সরকারি দল বা বিরোধী দলকে দোষ না দেওয়াটাই শ্রেয়। কারণ তারা কেউই হানাহানি-মারামারি চায় না, শুধুমাত্র গণতন্ত্রের ঐক্যবিনাশী ছাঁচে পড়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে তারা বাধ্য হয়ে এসবে লিপ্ত হয়। ইংরেজিতে একটি কথা আছে- ‘United we stand, divide we fall’ অর্থাৎ ঐক্যে বিজয়, অনৈক্যে পতন। গণতন্ত্র এটা মানে না। কিন্তু আমাদেরকে মানতে হবে। গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তা না করে আমাদেরকে নিজেদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে। রাজতন্ত্র গেছে সমাজতন্ত্র এসেছে, আবার সমাজতন্ত্র গেছে গণতন্ত্র এসেছে; এখন গণতন্ত্রেরও মুমূর্ষু অবস্থা। এই তন্ত্র-মন্ত্র বেদবাক্য নয় যে তা নিঃশেষ হবে না। কিন্তু মানবজাতি তো তন্ত্র-মন্ত্র নয়। আমাদেরকে বাঁচতে হবে। বাঁচতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। জাতিবিনাশী তন্ত্র-মন্ত্র আমাদের বিনাশ ঘটানোর পূর্বেই ঐ তন্ত্র-মন্ত্রেরই বিনাশ সাধন করতে হবে।