এনামুল হক বাপ্পা:
বর্তমানে ইসলামের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই বলে মন্তব্য করেছেন হেযবুত তওহীদের ময়মনসিংহ অঞ্চলের আমীর এনামুল হক বাপ্পা। তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মনোভঙ্গির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট বিষয়ে এক ধরনের মতামত প্রদান করলে অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ তা ভিন্ন দলিলের মাধ্যমে রহিত করে দেয়। দেখা যায় আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, সেটা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। কওমি মাদ্রাসা থেকে একটা ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, সরকারি আলিয়া থেকে তা বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। ইসলামিক ফাউণ্ডেশন থেকে একটা ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, শত শত ভিন্ন মতাবলম্বী আলেম বিবৃতি দিয়ে সেটা বাতিল করে দিচ্ছেন। সৌদি আরবের গ্র্যাণ্ড মুফতি কোন ফতোয়া দিচ্ছেন, ইরানের মুফতি-আয়াতুল্লাহরা সেটা বাতিল করে দিচ্ছেন। বাগদাদী অর্থাৎ আই.এস. জঙ্গিনেতারা যে ফতোয়া দিচ্ছেন, আল কায়েদা বা তালেবান সেটা সঠিক নয় বলে বাতিল করে দিচ্ছেন। এই যে ফতোয়া-পাল্টা ফতোয়া, মাসলা মাসায়েলের জটিল জটাজাল, দুনিয়াময় দল-মতের ছড়াছড়ি এসবের ফলশ্র“তিতে মুসলমান জাতির দশা এখন হালবিহীন নৌকা অথবা সেনাপতিহীন সেনাবাহিনীর মতো। তারা সংখ্যায় বিরাট হয়েও ঐক্যহীন, সর্বত্র লাঞ্ছিত, নিগৃহীত। তারা যেন বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হয়ে মরুভূমির মাঝে মরীচিকার পেছনে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি আমাদের সামনে একটি মহাসত্য প্রকাশ করে দিচ্ছে, সেটা হলো: বর্তমানে ১৬০ কোটির এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর সর্বজনমান্য কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নেই, কোনো ধর্মীয় সিদ্ধান্ত প্রদানের মতো অবিসংবাদিত কোনো কর্তৃপক্ষ পৃথিবীতে নেই। কেননা একজন আলেমের সিদ্ধান্ত অন্য যে কোনো আলেম বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ‘ভুল’ বলে ঘোষিত হচ্ছে। কারো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হচ্ছে না।
প্রকৃত ইসলামের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, নবী করিম (দ.) অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে শান্তি দেয়ার জন্য একটা উম্মাহ তৈরি করলেন। সেই উম্মাহ্র নাম হলো উম্মতে মোহাম্মদী যা ছিল এক অখণ্ড জাতিসত্তা। যেখানে না ছিল শিয়া, না ছিল সুন্নী, না ছিল খারেজী, না ছিল হানাফী, না ছিল আহলে হাদিস, না ছিল কওমী, সব ছিল এক উম্মতে মোহাম্মদী। তারা সকলেই ছিল ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পক্ষে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ। এই সত্যকে সারা দুনিয়ার মানবজাতির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবনসম্পদ দিয়ে তারা সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন এক লক্ষ্যে, একাগ্রচিত্তে (হানিফ হয়ে)। তাঁদের মধ্যে কোনো ফেরকা-মাজহাব ছিল না। হুজুর পাক (দ.) এর এন্তেকাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন একচ্ছত্র কর্তৃত্বের অধিকারী, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিভূ বা প্রতিনিধি, আল্লাহর পক্ষে সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ। রসুলাল্লাহর নির্দেশ সকলের জন্য আল্লাহর নির্দেশের অনুরূপ শিরোধার্য ছিল। তাঁর এন্তেকালের পরে আবু বকর (রা.) সমগ্র জাতিসত্তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ত্বের অধিকারী ছিলেন। আবু বকরের পরে হলেন ওমর (রা.), তারপরে ওসমান (রা.), তারপরে আলী (রা.)। ওসমান (রা.) এর হত্যার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাকে ধর্মীয় দাঙ্গার রূপ দিয়ে আলীর (রা.) সময়ে শুরু হয় জাতির মধ্যে বিরাট ঐক্যহীনতা। জাতির ভাগ্যাকাশে নেমে আসলো এক ভয়াবহ দুর্যোগ। আলীকে (রা.) মুসলিমদেরই একটা অংশ মেনে না নেয়ার ফলে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। সেই যে শুরু হলো আজ পর্যন্ত আর উম্মতে মোহাম্মদী আর একক জাতিসত্তা হতে পারল না, ঐক্যবদ্ধ হতে পারল না।
তিনি আরও বলেন, কোর’আনে দীনের মৌলিক নীতিমালা দেয়া আছে এবং রসুল (দ.) তৎকালীন আরবের সমসাময়িক সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যাগুলো সমাধান করেছেন সেই নীতিমালা ঠিক রেখে। যেমন সংবিধানের নীতিমালা ঠিক রেখে সরকার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন, কিন্তু নীতিমালা ঠিক থাকতে হয়। কোর’আন হলো তেমনি একটা মূলনীতি, প্রিন্সিপাল। কোর’আন অবিকৃত আছে ও থাকবে। কিন্তু রসুলাল্লাহর নামে দুনিয়াময় অসংখ্য জাল হাদিস চলছে। আর বিগত তেরশো বছরে সুফিরা, পণ্ডিতরা, বিভিন্ন মাযহাবের ইমাম ও প্রচারকরা এসব জাল ও দুর্বল হাদিস থেকে দলিল দিয়ে হাজার হাজার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, দুর্বোধ্য মাসলা-মাসায়েল আবিষ্কার করে একটা সহজ সরল দীনের চর্চাকে মহা-কঠিন করে ফেলছে। সবচাইতে প্রয়োজনীয় জিনিসটাকে গায়েব করে দেয়া হয়েছে আবার একান্ত গৌণ বিষয়টিকে মহা প্রয়োজনীয় করে ফেলা হয়েছে। এভাবে আলেম শ্রেণি ও পীর-আউলিয়ারা জাতির মূল স্রোতধারাকে উল্টে দিয়েছেন। জাতির গতি ছিল সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে, সেই গতি ঘুরে হয়ে গেল অন্তর্মুখী, ব্যক্তিগত সওয়াব অর্জন করে পরকালে জান্নাত লাভের দিকে। বিশ্ব-সমাজে শান্তি থাকল না অশান্তিতে ভরে গেল সেটা আর জাতির পরহেজগারদের ভাবনার বিষয় রইল না। এরই মধ্যে আল্লাহর অভিশাপ স্বরূপ আমরা দুশো বছর ধরে, কোথাও আরো বেশি ব্রিটিশ খ্রিষ্টানদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকলাম। তারা এসে এ জাতির উপর নতুন দুটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করলো। মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে সহজ সরল ইসলামের অবশিষ্ট আংশিক অবিকৃত কাঠামোকেও তারা শেষ করে দিয়েছে, বিকৃত করে দিয়েছে। এখন ক্রমান্বয়ে গত এক শতাব্দী থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য জঙ্গিবাদের উৎপত্তি ঘটানো হয়েছে। জঙ্গিদের অবস্থান মানে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড; আবার যারা ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করছেন তাদের আন্দোলন প্রায়শই সহিংসরূপ নেয়। এছাড়া আছে আধ্যাত্মিক সুফিদের ঘরমুখী টান ও মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম-ওলামায় কেরামদের চুলচেরা বিশ্লেষণ- এতে শুরু হয়ে যায় বিভিন্নমুখী ফতোয়া। টেলিভিশন চ্যানেল, পত্রিকা ও রেডিওগুলোতে চলতে থাকে ক্রমাগত ফতোয়া। একটা বিষয়ের উপর নানামুখী ফতোয়া, নানামুখী রায়, নানামুখী সিদ্ধান্ত। মানুষ কোনদিকে যাবে তার দিশা পাচ্ছে না। কোন পথে গেলে আল্লাহকে পাওয়া যাবে, কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক, কোনটা এখন করতে হবে, কোনটা পরে করতে হবে, এসব নিয়ে তারা পুরোপুরি বিভ্রান্তিতে বিপর্যস্ত, অনেকে ধর্মের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন, ধর্মবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছেন।
মুসলিম জাতির নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যে কোনো বিষয়ে সমাধানে পৌঁছতে হলে একটি শেষ স্থান অবশ্যই থাকতে হবে যার সিদ্ধান্তকে অলঙ্ঘনীয় মনে করে মান্য করবে। প্রত্যেকটা মুসলিম নর-নারী বিনা বাক্যে তাকে মানবে। সেই কর্তৃপক্ষটা কে? এই প্রশ্ন উত্থাপন এখন জরুরি। আল্লাহর রসুল বলেছেন, আল্লাহ আমার ওপর পাঁচটি কাজের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, আমি সেই পাঁচটি কাজের দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ কোরছি। সেগুলো হোল, (১) ঐক্যবদ্ধ হও। (২) (নেতার আদেশ) শোন। (৩) (নেতার ঐ আদেশ) পালন করো। (৪) হেজরত করো। (৫) (এই দীনুল হক কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করো। যে ব্যক্তি এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হলো, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু (বন্ধন) খুলে ফেলল- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামায পোড়লেও এবং রোযা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানী পাথর হবে [আল হারিস আল আশয়ারী (রাঃ) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত]।
যেহেতু আজকে মুসলিম বিশ্বের কোনো কর্তৃপক্ষই নেই, কাজেই গলদেশ থেকে তাদের দীনের ঐক্যের রজ্জু বহু আগেই খুলে গেছে। সুতরাং দুনিয়াতে তারা যেমন ঘোর অশান্তিতে নিমজ্জিত আছে, মৃত্যুর পরে এই অশান্তিরই চরম রূপ তারা জাহান্নামে গিয়ে প্রত্যক্ষ করবে। কেন ও কীভাবে তার পর্যাপ্ত দালিলিক যুক্তি ও প্রমাণ আমরা গত ২০ বছর ধরে পেশ করছি। এখনই জরুরি হয়ে পড়েছে ইসলামের নির্দেশনা দেয়ার জন্য এমন এক কর্তৃপক্ষের, যার হুকুম প্রত্যেক আনুগত্যের অঙ্গীকারকারীরা মানতে বাধ্য। কেননা পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রসুলের আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো তোমাদের মধ্যে আদেশদানকারী নেতার (সুরা নেসা ৫৯)।
লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ, ময়মনসিংহ