রিয়াদুল হাসান:
আদম (আ:) থেকে শুরু কোরে মোহাম্মদ (দ:) পর্যন্ত আল্লাহ যতো নবী রসুল (আ:) মানব জাতির পথ প্রদর্শনের জন্য পাঠিয়েছেন তাদের প্রত্যেককেই যে মূল-মন্ত্র দিয়ে পাঠিয়েছেন তা হোচ্ছে তওহীদ, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। স্থান, কাল ও পাত্রের বিভিন্নতার কারণে দীনের অর্থাৎ জীবন ব্যবস্থার আইন-কানুন, দণ্ডবিধি, এবাদতের পদ্ধতি ইত্যাদি বিভিন্ন হোয়েছে কিন্তু ভিত্তি, মূলমন্ত্র একচুলও বদলায় নি। সেটা সব সময় একই থেকেছে- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ। প্রেরিত প্রত্যেক নবী-রসুলকে আল্লাহ এই দায়িত্ব দিয়েছেন তারা যেন তাদের নিজ নিজ জাতিকে এই তওহীদের অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে নিয়ে আসেন। পূর্ববর্তী নবীদের যে কারণে আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তাঁর এই শেষ নবীকেও সেই একই উদ্দেশ্যে পাঠালেন- অর্থাৎ পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শান্তি, এসলাম প্রতিষ্ঠা কোরতে। আল্লাহ মানুষের জন্য যত জীবনব্যবস্থা পাঠালেন যুগে যুগে, তাঁর শেষটাকে তিনি তৈরি কোরলেন একটা অপূর্ব ভারসাম্য দিয়ে। এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো ভারসাম্য। এর আগের দীনগুলিতে যে ভারসাম্য ছিলো না তা নয়, মূল দীনে ভারসাম্য অবশ্যই ছিলো। কারণ মানুষ শুধু দেহ নয় আত্মাও, শুধু সামাজিক জীব নয়, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও আছে। তাই তাঁর জীবন-বিধান, দীনও একতরফা হোতে পারে না। সেটাকে অবশ্যই এমন হোতে হবে যে সেটা মানুষের উভয় রকম প্রয়োজনীয়তা পূরণ কোরতে পারে। নইলে সেটা ব্যর্থ হোতে বাধ্য। তাই আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা অবশ্যই সব সময় মূলতঃ ভারসাম্যযুক্ত ছিলো। কিন্তু পূর্ববর্তী সব নবীদের (আ:) উপর অবতীর্ণ দীনগুলি ছিলো স্থান ও কালের প্রয়োজনের মধ্যে সীমিত এবং ওগুলোর ভারসাম্যও ছিলো ঐ পটভূমির প্রেক্ষিতে সীমিত। কিন্তু ঐ দীনগুলির ভারসাম্যও মানুষ নষ্ট কোরে ফেলেছে। হয় বিধানের আদেশ-নিষেধগুলিকে আক্ষরিকভাবে পালন কোরতে যেয়ে দীনের মর্মকে, আত্মাকে হারিয়ে ফেলেছে, না হয় দীনের সামাজিক বিধানগুলিকে যেগুলো মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা কোরবে সেগুলিকে ত্যাগ কোরে শুধু আত্মার উন্নতির জন্য সংসার ত্যাগ কোরে সন্ন্যাস গ্রহণ কোরেছে। উভয় অবস্থাতেই দীনের ভারসাম্য নষ্ট হোয়ে গেছে। ঐ ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা কোরতে আল্লাহকে আবার প্রেরিত, নবী পাঠাতে হোয়েছে।
ভারতের বৈদিক ধর্মকে ব্রাহ্মণ পুরোহিত শ্রেণি কুক্ষিগত কোরে ফেলেছিল। তারা বর্ণাশ্রমসহ আরও বহু নিষ্পেষণমূলক প্রথাকে ধর্মের অঙ্গীভূত কোরে তার দ্বারা নিুবর্ণের মানুষের উপর অমানবিক বর্বরতা চালাতো। এই ভারসাম্যহীনতা দূরীভূত কোরে এর আধ্যাত্মিক দিকের সংস্কারসাধন করার জন্যই আল্লাহ মহামতি বুদ্ধকে রসুল বা অবতাররূপে প্রেরণ কোরেছিলেন। তেমনি মুসা (আ:) এর ধর্মের ভারসাম্য পুনঃস্থাপন করার জন্য এসেছেন ঈসা (আ:)। স্বামী বিবেকানন্দ গৌতম বুদ্ধকে নবী ঈসার (আ:) সঙ্গে তুলনা কোরে বোলেছেন, “বুদ্ধদেব এর শিষ্যগণ তাঁহাকে ঠিক ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। ইহুদিধর্মের সহিত খ্রিস্টানধর্মের যে সম্বন্ধ, হিন্দুধর্ম অর্থাৎ বেদবিহিত ধর্মের সহিত বর্তমানকালের বৌদ্ধধর্মের প্রায় সেইরূপ সম্বন্ধ। যিশুখ্রিস্ট ইহুদি ছিলেন ও শাক্যমুনি (বুদ্ধদেব) হিন্দু ছিলেন। শাক্যমুনি নতুন কিছু প্রচার করিতে আসেন নাই। যিশুর মতো তিনিও (পূর্ব ধর্মমতকে) ‘পূর্ণ করিতে আসিয়াছিলেন, ধ্বংস করিতে আসেন নাই।’” [বিশ্বধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত বক্তৃতা]। গৌতম বুদ্ধ নাস্তিক ছিলেন না। স্বামী বিবেকানন্দ তার ‘ভগবান বুদ্ধ ও তাঁর বাণী’ বইতে লিখেছেন যে শ্রী গৌতম বুদ্ধ তাঁর যুগে আবির্ভূত হোয়ে তাঁর জাতির উপর যেরূপ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হোয়েছিলেন, সে যুগের কোন নাস্তিকের পক্ষে তা ছিল অসম্ভব-কল্পনার অতীত।
এদিকে ঈসা (আ:) যখন তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালনের অর্থাৎ বনী ইসরাইল জাতিকে ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনার প্রচার শুরু কোরলেন তখন সেই চিরাচরিত ব্যাপারের পুনরানুষ্ঠান আরম্ভ হলো, অর্থাৎ পূর্ববর্তী দীনের, মুসার (আ:) দীনের ভারসাম্যহীন বিকৃতরূপের যারা ধারক-বাহক ছিলেন তারা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। সেই পুরানো কারণ-আত্মম্ভরিতা। কী! আমরা সারাজীবন এই বাইবেল চর্চা কোরলাম, এর প্রতি শব্দ নিয়ে কত অনুসন্ধান কোরে কত রকম ফতোয়া বের কোরলাম, আর এতো সব কাজ কোরে আমরা কেউ রাব্বাই, কেউ সাদ্দুসাই ইত্যাদি হোয়েছি। আর নিরক্ষর সুতোর মিস্ত্রীর ছেলে আমাদের ধর্ম শেখাতে এসেছে! ঈসা (আ:) তাঁর নবুয়ত, প্রেরিতত্ব প্রমাণ কোরতে বহু চিহ্ন, মো’জেজা দেখালেন, জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন, কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ কোরলেন, মাত্র পাঁচটি রুটি আর দু’টো মাছ দিয়ে হাজার হাজার লোককে পেট ভরে খাওয়ালেন এবং শেষ পর্যন্ত দু’তিন দিনের মরা মানুষকে জীবিত কোরলেন। কিন্তু কিছুই হলো না। ঐ পুরোহিত শ্রেণি ধর্মের ধারক-বাহক রাব্বাই সাদ্দুসাই শ্রেণি কিছুতেই তাকে স্বীকার কোরলো না এবং মাত্র কয়েকজন লোক ছাড়া আর কাউকেই ঈসাকে (আ:) স্বীকার কোরতেও দিল না। এ ব্যপারে পুরো লেখতে গেলে একটা পৃথক বই-ই হোয়ে যাবে। কাজেই এখানেই শেষ করার আগে শুধু একটা মাত্র উদাহরণ দেব, দেখাতে যে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে ঈসা (আ:) কি ধরনের কাজ কোরেছিলেন। ইহুদি ধর্মের আইনগুলির অন্যতম প্রধান বিধান হলো সপ্তাহে একদিন, শনিবার, জাগতিক কোন কাজকর্ম না কোরে শুধু মাত্র ধর্ম-কর্ম করা এবং সিনাগগে যেয়ে উপাসনা করা। এর নাম স্যাবাথ। এ আদেশ Old Tesmament এ আছে এবং এটা যে রাব্বাই, ফারিসী অর্থাৎ পুরোহিতরা তাদের মনগড়া নিয়ম বাইবেলে ঢুকিয়ে দেয়নি তার প্রমাণ- একথা পবিত্র কোর’আনেও আছে (সূরা আরাফ ১৬৩, সূরা আন নহল ১২৪)। এখন বাইবেলে পাচ্ছি যে, ঈসা (আ:) সিনাগগের দরজায় বোসে বছরের পর বছর ভিক্ষা কোরছে এমন একজন জন্মান্ধের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন এবং দিলেন ঐ সাবাথের দিনে, শনিবারে। ঐ জন্মান্ধটি তো সারা জীবনই ঐ সিনাগগের দরজায় বোসে ভিক্ষা কোরছিলেন। জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়াই বা অলৌকিক শক্তি (মো’জেজা) দেখানই যদি তার একমাত্র উদ্দেশ্য হতো তবে ঈসা (আ:) শনিবার ছাড়া অন্য যে কোনদিন কি তা কোরতে পারতেন না? পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে বেছে ঐ স্যাবাথের দিনটাতেই ঐ কাজ কোরলেন- এ কথা বোঝাতে এবং জোর দিতে যে, মানবীয় কাজ, অন্যের উপকার ইত্যাদি ঐ স্যাবাথের অর্থাৎ আইনের দোহাই দিয়ে বাদ দেয়ার অর্থ হলো দীনের, ধর্মের এক পা কেটে ফেলার সমান, ওটা আর তাহলে তখন চলনশীল থাকবে না, স্থবির হোয়ে যাবে। আসলে হোয়েও ছিলো তাই। যখন ঈসা (আ:) এসেছিলেন তার আগেই ঐ স্থবিরত্বের কারণে বনি ইসরাইল, মুসার উম্মাহ, পৌত্তলিক রোমানদের গোলামে পরিণত হোয়েছিল। ঠিক যেমন পরবর্তীকালে একই কারণে শেষনবীর (দ:) উম্মাহও খ্রিস্টান ইউরোপের গোলামে পরিণত হোয়োছিলো। স্যাবাথের দিনে জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ায় সেদিন রাব্বাই, ফারিসী, সাদ্দুসাইরা ধর ধর মার মার কোরে ছুটে এসেছিলো আল্লাহর সত্য নবী ঈসার (আ:) দিকে। বোলেছিলো- আমরা বোলেছিলাম না এই লোক ধর্মদ্রোহী? এই দ্যাখো! স্যাবাথের দিনের পবিত্রতা এ লোকটা নষ্ট করলো, আর এ বলে কি না সে আল্লাহর নবী, মার ওকে। আজ যদি কেউ মসজিদে দাঁড়িয়ে সত্যিকার ইসলাম কী তা বোলতে চেষ্টা করে তবে ঐ রাব্বাইদের হাতে ঈসার (আ:) যে দশা হোয়েছিলো বর্তমানের বিকৃত ইসলামের ধারক-বাহকদের হাতে তারও ঠিক ঐ দশা হবে। কারণ শেষ জীবনব্যবস্থা এসলামও ভারসাম্য হারিয়ে মৃত্যুবরণ কোরেছে বহু আগেই।
সুতরাং বোঝা গেল যে, একটি ধর্মের ভারসাম্যহীনতার সবচেয়ে বড় লক্ষণ হোচ্ছে, ধার্মিকদের কাছে মানবতা, মানবকল্যাণ, সেবা, দয়া, করুণা, সহমর্মিতা ইত্যাদির চেয়ে উপাসনা, ধ্যান, ধর্মাচারণ, দিবসপালন, উপবাস, নামাজ, রোজা ইত্যাদির গুরুত্ব অধিক হোয়ে দাঁড়াবে। সমাজের শান্তি-অশান্তির চেয়ে তাদের কাছে পরকালীন শান্তি-অশান্তিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোলে প্রতীয়মাণ হবে। তারা ভুলে যাবে যে, ধর্মের মূল হোচ্ছে করুণা, দয়া আর উপাসনা। ব্যক্তিগত সততা, সত্যবাদিতা, ওয়াদাপালন, ধর্মীয় উপাসনাদি হোচ্ছে ধর্মবৃক্ষের শাখা প্রশাখা। যখন মানুষ গাছের মূল কেটে শাখা প্রশাখার প্রতি যতœশীল হোয়ে পড়বে বুঝতে হবে যে, ধর্ম আর জীবিত নেই। বর্তমানে সব ধর্মই মৃতধর্ম। এজন্যই প্রতিটি ধর্মে সৎ ধার্মিক মানুষের সংখ্যা প্রচুর হোলেও মানবতা ভূলুণ্ঠিত হোয়ে আছে।