বঙ্গভূমিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণ চিহ্নিত করতে গেলে আমরা দেখতে পাবো এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। পুরো ভারতজুড়ে কিন্তু এই মুসলিম আধিক্য দেখা যায় না। দেশবিভাগের পর এখন ভারতের ১৩৩ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দু প্রায় ৮০%, মুসলমান ১৪%, বাকি ৬% হলো অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। সাড়ে সাতশ বছর মুসলিম শাসনামলে তলোয়ারের জোরে ইসলাম প্রচারের যে তত্ত্ব (Theory of Sword) ইসলামদ্বেষী পণ্ডিতরা প্রচার করে থাকেন তা যদি সত্য হতো তাহলে এই পরিসংখ্যানটি উল্টো হতো। ইসলাম ধর্ম গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা ইসলামের নীতি বিরুদ্ধ, কোর’আনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সুতরাং কেউ যদি তলোয়ার বাগিয়ে কাউকে দিয়ে কলেমা পড়ায় সে দায় তার নিজের। সে আল্লাহর দীনের সবচেয়ে বড় অবমাননাকারী। কেননা তার এই কাজের দ্বারা ইসলামের আদর্শিক দৈন্যই প্রমাণিত হয়। ইসলাম এমন খাদ্য নয় যে কারো টুটি চিপে গলধঃকরণ করাতে হবে।
ভারতবর্ষের হিন্দু রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আরব্য, আফগান, পারসি, তুর্কি, মুঘলরা তাদের সিংহাসনটাই কেবল দখল করেছিল, এর অধিবাসীদেরকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। ইসলামের সাম্যনীতির পরিচয় পেয়ে নিপীড়িত বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও নিম্নবর্গের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়েছিল। যে যুগে ইসলাম বিস্তারলাভ করেছিল সে যুগের ‘ইসলাম’ আজকের মতো ধর্মের মৃত-গলিত শব ছিল না। ইসলাম ছিল এক প্রাণবন্ত সভ্যতা যার রত্নভাণ্ডারে মানবজাতিকে দেওয়ার মতো বহু মণি-মাণিক্যই ছিল। ইসলামের প্রেরণাসঞ্জাত শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিত্রকলা, সঙ্গীত, স্থাপত্যবিদ্যা, সমরবিদ্যার পাশাপাশি মুসলিমদের আর্থিক সমৃদ্ধি, ন্যায়পূর্ণ বিচারব্যবস্থা, চারিত্রিক ঋজুতা, সততা, মৃত্যুভয়হীনতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিশ্বজোড়া দৃষ্টিভঙ্গি, আকাশ ছোঁয়া পরিকল্পনা সবকিছুই ক্ষয়িষ্ণু বৈদিক দর্শনের চাইতে আকর্ষণীয়, আধুনিক, যুক্তিপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য ছিল। রাজার ধর্ম প্রজারা তো আপনিই গ্রহণ করে। তার উপর যদি তলোয়ারের ঝলকানি দেখানো হতো তাহলে ভূ-ভারতে অমুসলিম খুঁজে পাওয়া যেত না। বস্তুত যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল তারা নিজেদের আদর্শ ও বিশ্বাসের চেয়ে উন্নততর চিন্তার সন্ধান পেয়েই হয়েছিল। অবশ্য গোমাংস খাইয়ে জাত মেরে মুসলমান বানানোর যে ঘটনাগুলো ইতিহাসে পাওয়া যায় সেগুলো সে সময়ের হিন্দুদের চিন্তার জড়ত্ব, যুক্তিহীন কুসংস্কারের উদাহরণ হিসাবেই বেশি উল্লেখযোগ্য। ইসলাম কারো ‘জাত মেরে’ মুসলমান বানানোর পক্ষপাতি নয়।
সাড়ে সাতশ বছরের মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষে যারা রাজসিংহাসনে আসীন হয়েছিলেন তারা নিজেদেরকে সুলতান বলে পরিচয় দিতেন। ‘বাদশাহ’ ও ‘সুলতান’ এই দুটো শব্দের মধ্যে পার্থক্য হলো, সুলতান শব্দের সঙ্গে ধর্মের কর্তৃত্ব ও মনোনয়ন জড়িত, বাদশাহ কেবলই একজন শাসক। সুলতানকে আল্লাহর ছায়া বলে সে যুগে খোতবায় আস-সুলতানু জিললুল্লাহ পাঠ করা হতো, এখনও সেই গৎ পাঠ করা হয়, যদিও সেই সুলতানও নেই, সেই জুমাও নেই।
বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা হয় কোন যুগকে? স্কুল কলেজের চৌকাঠ যারা মাড়িয়েছেন তারা সবাই এর উত্তরটা জানেন। সেটা হলো সুলতানী যুগ। এই যুগে মুসলিম শাসকরা রাজ্য পরিচালনা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। সুলতান মুসলমান হলেও ভারতবর্ষের অধিকাংশ এলাকাই ছিল হিন্দু রাজাদের দ্বারা পরিচালিত করদ রাজ্য। সেসব রাজা সুলতানকে বাৎসরিক কিছু নজরানা দিয়ে নিজেদের পরম্পরা ও খেয়ালমতই রাজত্ব চালাতেন। ফলে ইসলামের কোনো সুফল প্রজাদের পর্যন্ত পৌঁছাতো না। কিন্তু মুসলিম সুলতানের করদ রাজ্য হওয়ায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে অনেক সুফিবাদী ব্যক্তিই ওসব রাজ্যে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। তাদের মাধ্যমে বহু লোকই ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে ঘনিষ্ঠভাবে জানতে পারেন এবং ধর্মান্তরিত হন। উল্লেখ্য যে, এই মানবহিতৈষী ব্যক্তিগণ অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত, সামাজিকভাবে নির্যাতিত, মানবিকভাবে অবহেলিত, রোগেশোকে পীড়িত দীনদুঃখী মানুষের সাথে মিশে ও পাশে থেকে তাদের আশ্রয়দান, অন্নদান ও সেবাশুশ্রুষা করেন। যার দরুন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।
গল্পটা সবসময় কিন্তু এভাবেই শেষ হয় নি। ইসলামের এই জনপ্রিয়তা দেখে অনেক সময় হিন্দু ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে যারা স্বধর্মীয় রাজাকে উত্তেজিত করে তুলেছে এবং ইসলাম প্রচারকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। তখন সুলতানগণ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আবার বহু স্থানে প্রজাপীড়ক হিন্দু রাজাদের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে যে মোজাহেদরা যুদ্ধাভিযান করেছেন, তাদের মৃত্যুর পর তাদের কবরকে দরগায় পরিণত করা হয়েছে। ইসলামের এই মহান ব্যক্তিগণ ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়েই বঙ্গদেশে আমগন করেন। তাঁদের অনেকে অসীম দুঃখকষ্ট ভোগ করেন, নানা বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হন, এমন কি সশস্ত্র সংগ্রামে প্রাণ উৎসর্গ করেন। সুলতানগণ সৈন্যপরিবেষ্টিত হয়ে দুর্গে বাস করতেন। কিন্তু ইসলামের এই নিঃস্বার্থ সেবকগণ শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে এমন কি দুর্গম বনে-জঙ্গলে আস্তানা বা শিবির নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে থেকে ইসলামের শিক্ষা তাদের কাছে তুলে ধরেছেন। ষোলো শতকের গোড়ার দিকে আশরাফ সিমনানি (মৃত্যু – ১৪১৪) বলেন যে, “বঙ্গদেশে নগর তো দূরের কথা, এমন কোনো শহর ও গ্রাম নেই, যেখানে ধার্মিক সাধকগণ (Holy saints) বসতি স্থাপন করেননি।” অনেক মুসলিম সুলতান ও শাসক এই সুফি-সাধকদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের রাজনৈতিক উপদেষ্টারূপেও মান্য করতেন। জমি, অর্থ বা স্থাপনা তৈরি করে দিয়ে তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
আজকে আমরা যাদেরকে পীর, অলি-আউলিয়া বলে জানি, যাদের মাজারে ভক্তবৃন্দ মোমবাতি জ্বালেন তাদের অনেকেই দীন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এটা মনে রাখতে হবে, যে সময়ের কথা আমরা আলোচনা করছি সে সময়ে প্রচলিত ইসলামের উপর সুফিবাদী মতবাদের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল ছিল। এই ইসলাম প্রচারক ও মুজাহিদদের অনেকেই বিভিন্ন সুফি তরিকায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তারা আধ্যাত্মিক সাধকও ছিলেন। পাশাপাশি তারা আল্লাহর রাহে প্রাণ ও সম্পদ উৎসর্গকারী দুর্ধর্ষ যোদ্ধাও ছিলেন, শাসকও ছিলেন। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
সিলেটের শাহজালাল (রহ.) হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হন। তাঁর সেই তলোয়ার এখনও বিদ্যমান। মুন্সিগঞ্জের বাবা আদম শহীদ স্থানীয় সেন বংশীয় রাজা বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে শহীদ হন। দিনাজপুরের চিহিল গাজী মাজারটিতে শায়িত আছেন চল্লিশজন মর্দে মোজাহেদ। ৫৬ ফুট লম্বা এই কবরটি প্রকৃতপক্ষে একটি গণকবর। তারা ১৪’শ শতকে বরেন্দ্রভূমির এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে গমন করেন এবং স্থানীয় রাজা গোপালের কোপানলে পড়েন ও যুদ্ধ করে সবাই শহীদ হন। রংপুরের শাহ ইসমাইল গাজি (মৃত্যু ১৪৭৪) ‘দরবেশ যোদ্ধা’রূপে অভিহিত হয়ে থাকেন। সুলতান রুকন উদ্দিন বারবক শাহ (১৪৫৯-১৪৭৮) এর সেনাপতিরূপে তিনি একাধিক যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং বিজয়লাভ করেন। বিশেষ করে কলিঙ্গ ও কামরূপের সমরাভিযান ও বিজয়গৌরব তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। মধ্য এশিয়ার বলখ শহরে জন্মগ্রহণকারী শাহ সৈয়দ সুলতান মাহমুদ বালখি মাহিসওয়ার (রহ.) মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে ইসলাম প্রচার করেন। হিন্দুরাজা বলরাম কালিপূজারী ছিলেন এবং নরবলি দিতেন। এর প্রতিবাদ করায় রাজা তাঁর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। তিনি রাজাকে হত্যা করেন ও মন্ত্রীকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। তার হাতে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে তিনি মহাস্থানগড়ে চলে যান। সেখানেও রাজা পরশুরামের সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও যুদ্ধ হয়। রাজা যুদ্ধে পরাজিত হন।
রাজশাহী অঞ্চলের জনপ্রিয় পীর শাহ মাখদুম রুপোশ (মৃত্যু ১৩৩১ খ্রি.) রাজশাহীর বাঘাতে একটি সেনাছাউনি গড়ে তুলে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন এবং সেখান থেকেই মহাকালগড়ের (রাজশাহীর পূর্বনাম) দেওরাজার বিরুদ্ধে তিনবার যুদ্ধ করেন এবং বিজয়ী হন। রাজা তৃতীয় যুদ্ধে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন এবং পরিবার-প্রজাদের নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। এমন উদাহরণ আরো বহু আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়াকিল আহমেদের ‘বাংলার সুফি পির-দরবেশ: ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ – নামক গবেষণাগ্রন্থে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সময়সীমার মধ্যে বঙ্গভূমিতে আগত পীর-দরবেশদের মধ্যে ১০৭ জনের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
এই দরবেশ যোদ্ধাদের যোদ্ধাজীবনকে আড়াল করে তাদের জীবন ও শিক্ষাকে মরমীবাদী, সুফিবাদী, অতিন্দ্রীয়বাদী বলে প্রচার চালানো হচ্ছে কয়েক শতাব্দী ধরে। এই প্রচারে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছেন মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের সেই অংশটি যারা ইসলাম নিয়ে, বিশেষ করে দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ নিয়ে লজ্জিত। এ বিষয়ে তারা তাদের বিদেশি প্রভুদের কাছে করজোড়ে এটাই বলতে চান যে, ‘ইসলাম আক্রমণাত্মক সংগ্রামের অনুমতি দেয় না। এই যে দেখুন, বাংলাদেশে ইসলাম কারা এনেছেন? সুফি-সাধকগণ। তাদের মুখে প্রেমের বাণী শুনেই দলে দলে মানুষ মুসলমান হয়ে গেছে।’ অথচ তাদের চোখে যারা অনুসরণীয় জাতি, সেই ইউরোপীয় জাতিগুলো বিশেষ করে ব্রিটিশ, জার্মান, ডাচরা যে সমস্ত মুসলিম প্রধান ভূমি ছলের দ্বারা ও বলের দ্বারা জয় করে সেখানে তাদের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, লক্ষ লক্ষ নেটিভদের রক্ত ঝরিয়েই তারা শোষণের রাজপথ উন্মুক্ত করেছে। এমন যাদের কৃতকর্ম তারাই আবার ইসলামের দিকে আঙুল তুলে বলছে যে ইসলাম কেবল তলোয়ারের শক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। না, ইসলামের যদি আদর্শের শক্তি না থাকতো, ইসলাম যদি মানবসমাজে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অক্ষম হতো, তাহলে আরবের মরুবাসীদের সেই বিজয় চেঙ্গিস-হালাকু খানদের মতোই ক্ষণস্থায়ী হতো, বুদ্বুদের মতো কালের সাগরে মিলিয়ে যেত।
যারা এইসব সুফি-সাধকদের জীবনবৃত্তান্ত রচনা করেছেন তারা অনেক গবেষণা করে, শ্রম দিয়ে প্রামাণিক ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা করেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নির্ভর করতে হয়েছে কল্পনানির্ভর জনশ্রুতি, মিথ বা কিংবদন্তীর উপর। আপামর জনসাধারণ বঙ্গের সুলতানদের নাম ভুলে গেছে কিন্তু মানুষ গড়ার কারিগর এই সুফি-সাধকগণ আজও তাঁদের স্মৃতিবাহিত মাজার, দরগাহ, লালশালু, হাজত-মানত, শিরনি, ওরস মোবারকের মাধ্যমে বেঁচে আছেন। সেগুলো অধিকাংশই আজ গাঁজার ধোঁয়া ও অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের দায়ে কালিমালিপ্ত। আল্লাহর রসুলের ইসলামের আকিদার কোনো লেশমাত্রও সেগুলোতে খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথাও কোথাও সেই পূর্বপুরুষদের সুনাম ও সিলসিলা বিক্রি করে লোক ঠকিয়ে খাচ্ছেন পরবর্তী বংশধরেরা ও খলিফারা। ভক্তসংখ্যা বেড়ে গেলে কোনো কোনো পীর ও পীরের খলিফারা নেমে পড়ছেন রাজনীতিতে, মুরিদরা হচ্ছে তাদের ভোটব্যাংক।