বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন জনপদ, মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন প্রভৃতি আমলের স্মৃতি বহনকারী বগুড়ার জেলা পরিষদ মিলনায়তনে গত ২১ আগস্ট ২০১৪ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হল হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর ধর্মব্যবসা ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি নির্মূল প্রসঙ্গে প্রদত্ত প্রস্তাবনা নিয়ে একটি বিশেষ সেমিনার। দৈনিক দেশেরপত্র এবং দৈনিক বজ্রশক্তির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনারে জেলার সর্বধর্মীয় নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ‘সনাতন ধর্ম’ এবং ‘এক জাতি এক দেশ ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ’ নামে দু’টি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে আমন্ত্রিত বগুড়া জেলা প্রশাসক শফিকুর রেজা বিশ্বাসের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: আশরাফুজ্জামান। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “একটা কথা সবাই আমরা একবাক্যে স্বীকার করব, এমন কোন ধর্ম নেই যেখানে বলা আছে অন্যদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হোক। সব ধর্মেই মানবতার কথা, মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করার কথা বলা আছে। আমরা যদি মানুষের অতীতের দিকে তাকাই, আমরা দেখবো যখনই আমরা দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছি তখনই সফলতা এসেছে। ৫২-৬৯-৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ যখনই আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছি, তখনই আমরা বিজয় লাভ করেছি।” তিনি একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার উদ্ধৃত্তি দিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেন যে, “২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে। তবে এ উন্নতির অন্যতম শর্ত হল জাতীয় ঐক্য। আমাদের দেশের ৭০ ভাগ লোক কর্মক্ষম, তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আজকে সকল জাতি ধর্ম নিয়ে অনুষ্ঠিত সর্বধর্মীয় সম্মেলনে যে বিষয়টি উপস্থাপিত হল তা আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি এজন্য সবাইকে সকল বিদ্বেষ ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশেষ অতিথি বগুড়া হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রী নিরঞ্জন সিংহ বলেন, “আজ হিন্দুরা বলতে পারবে না, মুসলিমরাও বলতে পারবে না যে আমরা শান্তিতে আছি। এর কারণ আমরা সবাই ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে সরে গেছি। সকল ধর্মের লোকেরাই আজ ধর্মব্যবসায়ীদের হাতের ক্রীড়ণক হয়ে আছে। আজ যমুনার ওপারের একটি স্বনামধন্য পরিবার থেকে ডাক এসেছে যদিও তিনি আজ বেঁচে নেই তবু আমরা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলছি, আমরা সবাই পন্নী সাহেবের আহ্বান ও আদর্শের সঙ্গে একমত পোষণ করছি। এক শ্রেণির কুচক্রী মহল আমাদের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে যে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে, আজ আমাদেরকে সেই অনৈক্যের দেয়াল ভাঙতে হবে। পন্নী সাহেব বলছেন, সকল ধর্ম এক স্থান থেকে এসেছে। তাঁর কথার সূত্র ধরে বলতে চাই, আমরা এক স্রষ্টার প্রেরিত সনাতন বিশ্বাসের উপরে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারি, তাহলে আমাদের মধ্যে আর কোন অশান্তি থাকবে না।”
বিশেষ অতিথি বক্তব্যে বগুড়া হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ডা: এন.সি. বাড়ই বলেন, “এটি একটি অনন্যসাধারণ অনুষ্ঠান। এর বৈপরীত্য ও মর্যাদা সম্পূর্ণ আলাদা।” বগুড়াতে এমন একটি সেমিনার আয়োজন করার জন্য তিনি মঞ্চে উপবিষ্ট দৈনিক দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের জগতে হেযবুত তওহীদ যে সমন্বয় সাধনের উদ্যোগ নিয়েছে সেই সমন্বয়বাদ অচিরেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। আজ নরহত্যা করা হচ্ছে ধর্মের নামে, সন্ত্রাস করা হচ্ছে ধর্মের নামে। অতীতে এ দেশে ধর্মের নামে বহু নেতা-নেত্রীকে হত্যা করা হয়েছে, আজও সেই ষড়যন্ত্র বন্ধ নেই। সকল ধর্মের মধ্যে শান্তি স্থাপনের যে উদ্যোগ হেযবুত তওহীদ নিয়েছে আমি তাকে অকুণ্ঠচিত্তে সাধুবাদ জানাই। তবে সবারই শুরুটা ভালো হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর সঠিক পথে থাকতে পারেন না। আমি চাই হেযবুত তওহীদ যেন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তার সংগ্রামে দৃঢ়পদ থাকে।’ তিনি শত্র“ সম্পত্তি আইন এর ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে যে নির্যাতনের খড়গ নেমে এসেছে তা বিবেচনা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এই আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন নিপীড়ন চলছে তার মর্মস্পর্ষি বিবরণ দেন। তিনি উপমহাদেশের অতীত ইতিহাস স্মরণ করে বলেন, ‘এসলাম শান্তির ধর্ম, এসলাম শান্তি নিয়েই এই উপমহাদেশে এসেছিল। এসলামের ভ্রাতৃত্ববোধ, মমত্ববোধ দেখে আমরা দলে দলে এসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ মুসলিমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করছে। যারা নিজেরাই নিজেদেরকে উদ্ধার করতে ব্যর্থ তারা কী করে অন্য জাতিকে উদ্ধার করবে?’ তিনি বলেন, ‘সনাতন ধর্ম কোন বিশেষ ব্যক্তি বা কালের জন্য নয়, সর্বকালের জন্য। স্রষ্টা যখন দেখেন মানবজীবনে অশান্তি চলছে তখন তিনি অবতার পাঠান। তাই মানবজীবন থেকে অশান্তি দূর করাই প্রকৃত ধার্মিকের কাজ। হেযবুত তওহীদের এই কার্যক্রমকে আমরা সাধুবাদ জানাই, অবশ্য যদি তারা শেষ পর্যন্ত সঠিক পথে টিকে থাকে।’
বগুড়া হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি শ্রী কল্যাণ প্রসাদ পোদ্দার বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, ‘আজকে আমার কাছে খুব আনন্দ লাগছে যে এ ধরণের একটি মহৎ উদ্যোগ নিয়ে এমামুয্যামানের অনুসারীরা কাজ করছেন। আমি দেখেছি ধর্মের নামে যে অপব্যাখ্যা সমাজে প্রচলিত আছে, কেউ সেগুলির প্রতিবাদ করে না। ফলে ধর্মের নামে অধর্ম প্রসার লাভ করে। আজকে দেশেরপত্রের কাছে প্রতিবাদের ভাষা আমরা খুঁজে পেয়েছি। পৃথিবীতে মানুষের সেবা করা যেখানে সবচেয়ে বড় ধর্ম সেখানে আজকে ধর্মের নামে অপরাজনীতি চোলছে, যারা এটা করছে তাদেরকে রুখে দাঁড়াতে হবে। বলা হয় হিন্দুকে ভোট দিলে দোজখে যাবে, অমুককে ভোট দিলে নরকে যাবে ইত্যাদি। সাধারণ মানুষ এই অপব্যাখ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়। আজ এই সব অপব্যাখ্যার চ্যালেঞ্জ করার ভাষা আমরা খুঁজে পেয়েছি। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের পক্ষ থেকে আমরা বলছি, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি, যদি আপনারা শেষ পর্যন্ত সঠিক পথে থাকেন তবে। আমরা জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে সাধুবাদ জানাই। আমরা চাই তাঁর এই উদ্যোগ স্বার্থক হোক।’
বিশেষ অতিথি হিসাবে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন জেলা পরিষদের প্রশাসক মো: মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও এদেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা হবে, সেটা আমরা কখনো চিন্তা করি নি, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে সে আশাও আমরা কখনো করি নি। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম নিয়ে অপব্যাখ্যা, ধর্ম নিয়ে রাজনীতির সমাধান ৭১ সালেই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ আবার সেই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যারা এই সমস্যা সৃষ্টি করছে তারা আসলেই ধর্মের পথে নেই, ধর্মের দোহাই দিয়ে স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টা করছে মাত্র। ৭১ সালে আমরা হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রিস্টান সবাই মিলে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। অত্যন্ত খুশির বিষয় হচ্ছে সেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনা আজ আবার দেখতে পাচ্ছি।’ দৈনিক দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা মাননীয় এমামুয্যামানের জীবনাদর্শের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার বাবা জীবনে কখনো নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেন নি। তিনি তাঁর সমস্ত অর্জন, সমস্ত জীবন ব্যয় করেছেন মানুষের কল্যাণে এবং আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে। আমরাও তাঁর অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে আমাদের জীবন, সম্পদ সবকিছু আল্লাহর রাস্তায় মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করে কাজ করতে নেমেছি। এই বিরাট কাজে আপনাদের সবার সহযোগিতা আমাদের অবশ্য প্রয়োজন। সেটা চাইতেই আপনাদের কাছে আসা। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তাদের মধ্যে যে ঐক্যসূত্রগুলি আছে সেগুলির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করছি। আমাদের নির্মিত এই ডকুমেন্টারিগুলির কোন কথায় কারও যদি কোন আপত্তি থাকে আমাদের জানাবেন। আমরা কাউকে আঘাত করতে চাই নি, কেবল বলতে চেয়েছি যে যার যার ধর্ম বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস বজায় রেখেও অন্তত মানবতার স্বার্থে এক হোন।’
প্রাণবন্ত এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন দৈনিক দেশেরপত্রের স্থানীয় প্রতিনিধি আতাউর রহমান, সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী অঞ্চলের ব্যুরো প্রধান মনিরুয্যামান। মনিরুয্যামান তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, ‘করতোয়া নদীর অববাহিকায় অবস্থতি এই বগুড়া শহরের সঙ্গে মাননীয় এমামুয্যামানের জীবনের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তিনি ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষ সমাপ্ত করেন বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে। বগুড়ার কৃতি সন্তান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বোগরা ছিলেন এমামুয্যামানের নিকটাত্মীয়। সেই বগুড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আজ এমামুয্যামানের প্রস্তাবনায় যেভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন, আমরা খুবই আশান্বিত ও অনুপ্রাণিত। যেভাবে আজ আমাদের দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল, সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এনশাল্লাহ একদিন হেযবুত তওহীদের মাধ্যমে এই জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে এবং আল্লাহর বিধানকে সমুন্নত করবে।’