রিয়াদুল হাসান:
আমরা বাংলাদেশে মুসলমানরা যখন ঈদের আনন্দ করছি, নামাজ-রোজা করছি, ব্যবসা-বাণিজ্য করছি, অফিস-আদালতে কাজ করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের থেকে মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার দূরে পবিত্র আরব ভূমির ফিলিস্তিনি মুসলমানদের জীবনে যেন মহাপ্রলয় নেমে এসেছে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা ইসরায়েলি বাহিনীর নির্যাতন, হামলা ও দখলদারিত্বের শিকার হয়ে আসছে। ২০২৩ সাল থেকে এই সহিংসতা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জাতিগতভাবে মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য এখন সেখানে প্রতি মুহূর্তে চলছে বোমাবর্ষণ। ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ সকল স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছে। শুধু গত এক বছরে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার শিশু ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নিহতদের কবর দেওয়ারও লোক নেই। উদ্বাস্তু শিবিরে এক বোতল পানির জন্য ছুটে গেলে, সেখানেও বোমা মেরে হত্যা করা হচ্ছে মানুষকে। সোজা কথা, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার ফলে যে অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
৭৫ বছরের হত্যাযজ্ঞের পরে এবার ইসরাইল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই ভূমিতে আর কোনো একজন মুসলমানকেও থাকতে দেওয়া হবে না। হয় তাদেরকে সেখান থেকে উৎখাত করে উদ্বাস্তু হিসাবে অন্যান্য দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, অথবা তাদেরকে হত্যা করতে হবে। এ হৃদয়বিদারক, ন্যাক্কারজনক ও পৈশাচিক ঘটনার সাক্ষী সমগ্র বিশ্ব। এমন একটি পরিস্থিতিতেও গোটা মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ, ওআইসি, আরব লীগ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো নীরব। প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোরও যেন চোখে ঠুলি পরে আছে। কিছুদিন আগে ঠিক একইভাবে মিয়ানমারে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা এখন আমাদের দেশে উদ্বাস্তু হয়ে জীবন কাটাচ্ছে।
প্রশ্ন হলো- ফিলিস্তিনসহ বিশ্বময় মুসলমানদের ওপর এত নির্যাতন-নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত কারণ কী? এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকরা কেউ রাজনৈতিক, কেউ ভৌগোলিক, কেউ ঐতিহাসিক, কেউ ধর্মীয়, কেউ অর্থনৈতিক কারণ উল্লেখ করবেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এগুলো কোনোটাই কারণ নয়, এগুলো ফলাফলমাত্র। মূল কারণ হলো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তওহীদ থেকে বিচ্যুতি অর্থাৎ ঈমান থেকে সরে যাওয়া। এই বিচ্যুতির ফলে তারা ঐক্যহীন ও দুর্বল হয়ে গেছে, আল্লাহর সাহায্য হারিয়ে পরাজিত হয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় রসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করে তওহীদের ভিত্তিতে এক অনন্য ‘উম্মতে মোহাম্মদী’ জাতি গঠন করেছিলেন; যার মূল কথা ছিল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম-বিধান মানবো না। এই জাতি (উম্মাহ) একসময় আল্লাহর হুকুমের উপরে, তওহীদের উপরে একজন নেতার (ইমাম) নেতৃত্বে ইস্পাতের মত ঐক্যবদ্ধ ছিল। তারা আল্লাহর সাহায্য পেয়েছিল। ফলে তারা এতটাই সমৃদ্ধ হয়েছিল যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৃঙ্খলা, শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীর সকল জাতির শিক্ষকের আসনে আসীন ছিল। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে তারা এতটাই বলীয়ান ছিল যে কোনো জাতি তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করত না। আল্লাহ কোর’আনে এই জাতিকে সর্বোত্তম জাতি হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই জাতির আকিদা ছিল- গোটা জাতির নেতা বা ইমাম হবেন একজন; আল্লাহ সেই নেতার আদেশ পালনের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘হে মো’মেনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রসুলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের আদেশদাতা নেতার (আমির) আনুগত্য কর। (সুরা নিসা ৫৯)।’ তারা একমাত্র আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার অনুসরণ করবে; তারা মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে কেবল তওহীদের উপর অটল থাকবে; এবং দুনিয়াতে আল্লাহর খেলাফত বা প্রতিনিধিত্ব করবে। সর্বাবস্থায় আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন। এ সত্যের উপর শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মাহকে মজবুত করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা শত শত বছর থেকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, তাঁর দেওয়া জীবনব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। পরিবর্তে আমরা ইউরোপীয়দের তৈরি করা সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, দণ্ডবিধি, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ইত্যাদি সবকিছুকে আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে আলিঙ্গন করে নিয়েছি। ফলে ঈমানের রশি কেটে গিয়েছে। আল্লাহ কোর’আনে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না (সুরা ইমরান ১০৩)। অথচ আমরা আজ ধর্মীয়ভাবে অসংখ্য ফেরকা, মাজহাব, তরিকায় এবং রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছি। নিজেরা নিজেরা ছোটখাটো ধর্মীয় মতবিরোধ নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত, হানাহানি ও সংঘর্ষে জড়িয়ে আমরা হাজার বছর থেকে জাতির ঐক্য ধ্বংস করছি। রসুল (সা.) যেখানে সতর্ক করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, হেজরত ও জেহাদ এই পাঁচ দফার ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হল, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু (বন্ধন) খুলে ফেলল- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামায পড়লেও এবং রোযা রাখলেও নিশ্চয়ই জাহান্নামের জ্বালানি পাথরে পরিণত হবে [আল হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত]। কিন্তু আমরা আল্লাহর রসুলের সতর্কবার্তা ভুলে গিয়ে, ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, হেজরত ও জেহাদ সব পরিত্যাগ করেছি।
আমরা যখন জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে সরে গিয়েছি, তখন আল্লাহ আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন। এটা স্বীকার করতেই হবে। না হলে শত শত বছর থেকে কেন আমরা মুসলিম জাতি এই ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করছি? আল্লাহ সুরা আল বাকারার ৮৫ নম্বর আয়াতে আরও বলেছেন, যারা তাঁর কিতাবের কিছু অংশ মানে আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করে, তাদের জন্য ইহজগতে রয়েছে লাঞ্ছনা ও অবমাননা এবং কিয়ামতের দিন রয়েছে কঠিন শাস্তি। বর্তমানে আমরা এ আয়াতের বাস্তবতাই দেখতে পাচ্ছি। দুনিয়ার জীবনে আমাদের এই লাঞ্ছনার কারণ আমরা ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর উপাসনা করছি, কিন্তু জাতীয় জীবনে আল্লাহর বিধানকে পুরোপুরি অস্বীকার করে ইহুদি-খ্রিস্টান জাতির তৈরি করা জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করে নিয়েছি। ফলে দুনিয়ার জীবনে আমরা আজ লাঞ্ছিত, অপমানিত হচ্ছি।
পবিত্র কোর’আনের সুরা তওবার ৩৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যদি (জেহাদের) অভিযানে বের না হও তবে তোমাদের কঠিন শাস্তি দেব এবং তোমাদের বদলে অন্য জাতিকে স্থলাভিষিক্ত করব। তোমরা আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, আল্লাহ সর্বশক্তিমান।’ এটি আল্লাহর একটি সুস্পষ্ট ও অটল ওয়াদা। আমরা যখন তওহীদ ত্যাগ করেছি এবং জেহাদ ছেড়ে দিয়েছি, তখনই আল্লাহ আমাদের শক্তি ও মর্যাদা কেড়ে নিয়েছেন এবং শাস্তি হিসাবে অন্যান্য জাতিকে মুসলিম জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তারা আমাদেরকে বিশ্বজুড়ে শাসন, শোষণ, নিধন ও বাস্তুচ্যুত করছে।
এই হলো ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের করুণ বাস্তবতার মূল কারণ। আমাদের স্বার্থপরতা, আদর্শচ্যুতি, জেহাদ ত্যাগ, নিজেদের মধ্যে হানাহানি, দীন থেকে সরে আসা, এ সকল পাপের মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের নিষ্পাপ শিশুদের, গর্ভবতী মায়েদের, নিরপরাধ মেয়েদের। জনপদগুলো শ্মশানে পরিণত হচ্ছে। বসনিয়ায় দুই লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, কোনো বিচার হয়নি। সিরিয়ায় লক্ষ লক্ষ মুসলমান উদ্বাস্তু, পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছে, কোনো বিচার হয়নি। ইরাকে দশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, কোনো বিচার হয়নি। লিবিয়ায় গণকবর হয়েছে; কোন বিচার হয়নি। আফগানিস্তান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; কোন বিচার হয়নি। এভাবে জিনজিয়াং, কাশ্মির, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়াসহ বিশ্বের বহু প্রান্তে আট কোটির বেশি মুসলমান আজ বাস্তুচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছেন। এ এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ থেকে পরিত্রাণের পথ কী?
আমরা বিক্ষিপ্তভাবে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মিছিল, প্রতিবাদ সভা, লংমার্চ করছি, পণ্য বয়কট করছি, ভাঙচুর করছি, এমনকি কেউ কেউ আত্মঘাতী হামলাও করছি। কিন্তু এই সমস্ত কিছু দুর্গতি থেকে মুক্তি লাভের সঠিক ও টেকসই পন্থা নয়। এই বিপর্যয় থেকে মুক্তির উপায় হচ্ছে, প্রথমত, জাতির মধ্যে বিরাজিত সকল ফেরকা, মাজহাব, দলাদলি এই মুহূর্ত থেকে বাদ দিয়ে আমাদেরকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এই ঘোষণা দিতে হবে যে, আমরা আমাদের সামগ্রিক জীবনে আল্লাহ ছাড়া আর কারো দেওয়া জীবনব্যবস্থা, হুকুম মানা হবে না। দ্বিতীয়ত, ঐক্যবদ্ধ হয়ে একজন নেতার নেতৃত্বে সংগ্রাম করে জাতীয় জীবনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তৃতীয়ত, ঐক্যবদ্ধ মোমেনদের সমগ্র জ্ঞান, শিক্ষা, সম্পদ, জীবন দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উৎসর্গ করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করো এবং এ নিয়ে কোনো মতভেদ করো না (সুরা শুরা ১৩)। সেই দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম না করে শুধু নিন্দা-প্রতিবাদ জানালে তা কোনো বাস্তব ফল বয়ে আনবে না। এর মাধ্যমে আমরা হয়ত নিজেদের দায়মুক্ত করার চেষ্টা করছি, কিন্তু এতে সাম্রাজ্যবাদী দাজ্জালীয় শক্তির কিছুই যায়-আসে না। এভাবেই তারা একের পর এক মুসলিম দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আজ বাংলাদেশকে নিয়েও গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এখানেও যদি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। তাই এই পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদেরকেই একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে জাগতে হবে- জাগাতে হবে। আমাদের শ্লোগান হবে- হুকুম চলবে আল্লাহর, আমাদের জাতি হবে একটি, নেতা হবেন একজন, সমগ্র জাতির জ্ঞান, সম্পদ, জীবন সব কিছু দিয়ে আমরা দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করব। তবেই এই জুলুম বন্ধ হবে ইনশাল্লাহ।