হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
ধর্মীয় দর্শন ও বৈজ্ঞানিক সূত্র উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের সঙ্গে অন্য সব প্রাণীর মৌলিক তফাত রয়েছে। এবং এটা সর্বজনস্বীকৃত, বৈজ্ঞানিকভাবেও স্বীকৃত। মানুষ একটি অসাধারণ সৃষ্টি। কোনো প্রাণীর প্রখর ঘ্রাণশক্তি আছে, কিন্তু তার সেরকম প্রখর দৃষ্টিশক্তি নেই। কোনো কোনো প্রাণীর দৃষ্টিশক্তি সাংঘাতিক কিন্তু সে আবার সে বর্ণান্ধ। কারো গায়ে অনেক শক্তি কিন্তু তার শ্রবণশক্তি ক্ষীণ। কিন্তু মানুষ হচ্ছে এমন এক সৃষ্টি যার মধ্যে সকল প্রাণীর বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি সমন্বয় ঘটেছে। মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক দিয়ে সে চিন্তা করে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারে। আরেকটি অসাধারণ, বিস্ময়কর সত্ত্বা মানুষের মধ্যে বিরাজ করে সেটা হচ্ছে তার আত্মা যাকে কেউ বলেন বিবেক, চিন্তাশক্তি, উপলব্ধি করার ক্ষমতা, দূরদৃষ্টি, মন। আল্লাহর ভাষায় এটাই হচ্ছে রূহাল্লাহ বা আল্লাহর আত্মা যার মধ্যে আল্লাহর যাবতীয় গুণাবলীর সঙ্গে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিও রয়েছে, যদিও তা অতি ক্ষুদ্র মাত্রায়। বস্তু হলে তা চোখে দেখা যায়, তার আয়তন ভর পরিমাপ করা যায়। কিন্তু যা অবস্তু যেমন কোনো সংকট, তাহলে সেটা কত বড় সংকট, তার ভয়াবহতা কী তা মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝতে হয়, আত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যদি কারো সম্মানের ব্যাপার হয় তাহলে সেই সম্মানের মাহাত্ম্য, উচ্চতা উপলব্ধি করতে হয় হৃদয় দিয়ে। যে জাতির চিন্তার জগতে স্থবিরতা আসে তাদের মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায়। কিন্তু সমাজের শিক্ষিত শ্রেণিটি আধুনিকতার অহংকারে এতটাই স্ফীত হয়ে আছে যে, তারা এই সভ্যতাকে এই সমাজকে প্রগতিশীল সমাজ বলে। কারণ এই সময়ে মানুষ এত প্রযুক্তিগত উন্নতি করেছে যা দেখে সে আত্মপ্রসাদ লাভ করছে যে আমরা বুঝি অনেক সভ্য হয়েছি। সে একশ-দেড়শ তলা হাইরাইজ বিল্ডিং বানাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বর্তমানের চেয়ে বেশি স্থবিরতা, এত আবদ্ধতা, এত সংকীর্ণতা মানব ইতিহাসে আগে কখনো হয়েছে কিনা সন্দেহ।
এটা মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে যে মানুষের সবচেয়ে বড় পরাজয় কখন? যখন মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। যখন দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা, মজলুমের উপর জালেমের অত্যাচার মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে না তখন তারা কীভাবে সভ্যতা ও প্রগতির অহংকার করে? আজকে মানুষ সকল অন্যায়ের কাছে দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করেছে। সে অন্যায়ের সামনে দাঁড়িয়ে গেছে, স্থবির হয়ে গেছে। সে তার চোখ, কান, মুখ সব বন্ধ করে ফেলেছে। মানুষ এখন মৃত। সে আর দশটা পশুর মতো কেবল জীবনধারণে ব্যস্ত।
আধুনিক এই সভ্যতার জন্ম হয়েছিল ইউরোপীয় রেনেসাঁর হাত ধরে। রেনেসাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিল। মানুষ সঙ্কট উপলব্ধি করেছিল। এজন্য ধর্মযাজকদের প্রাচীন ধ্যানধারণা, জড়ত্ব, স্থবিরতা, অন্ধত্ব, সবকিছুর মধ্যে পরকালীন শাস্তির ভীতিপ্রচার, নিজেদের ঐশ্বরিকতা ইত্যাদি ধ্যান-ধারণা থেকে বাইরে বের হবার চেষ্টা করেছে শ্বাসরুদ্ধ মানুষ। তাদের চিন্তাকে ঐ জড় ধর্মচিন্তার কারাগার থেকে বের করে এনেছে বহু জীবনের বিনিময়ে, রক্তের বিনিময়ে, বহু প্রজন্মের সম্মিলিত প্রয়াসে। সেখান থেকে বের হয়ে মানুষ দেখেছে যে না আসলেই তো আমার তো অনেক চিন্তার করার বিষয় আছে। সে একটা মুক্ত আকাশ পেয়েছে। এই যে চিন্তার মুক্তি তা মানুষকে নতুন একটি সভ্যতার সম্ভাবনার ঊষালগ্নে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এরই নাম তারা দিয়েছে রেনেঁসা (renaissance), নবজাগরণ। সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের, শিল্প-সাহিত্যের একটা স্ফূরণ ঘটে গেছে। ধর্মযাজকদের কথা ছিল তাদের কথা মানলে পরকালে স্বর্গপ্রাপ্তি হবে, না মানলে নরক। কথায় কথায় তারা ফতোয়া দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারত, নৃশংস উপায়ে হত্যা করত। যারা এই রেঁেনসার অগ্রনায়ক তাদের লক্ষ্য ছিল এই পৃথিবীটাকে তারা স্বর্গে অর্থাৎ শান্তিময় আবাসে রূপান্তরিত করবেন। একদিকে বিকশিত হলো শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি আরেকদিকে জীবন চালানোর জন্য একটার পর একটা সৃষ্টি হলো উদারনৈতিক গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, আন্তর্জাতিকতাবাদ, সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদি। এগুলো তারা রচনা করলেন ঐ চিন্তাশক্তি দিয়ে, মস্তিষ্ককে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার মাধ্যমে। যারা করেছে তারা নিজেদের সমাজের সঙ্কটটাকে উপলব্ধি করেছিলেন বলেই পরিবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই সভ্যতা বস্তুগত উন্নতির পাশাপাশি মানবজাতিকে এমন একটি নির্মম বাস্তবতা উপহার দিয়েছে যা অতীতের সব ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে গেছে। দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে রেনেসাঁর যে নেটফল মানুষ লাভ করেছে তাতে তাদের সকল প্রাপ্তি অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে। বিশ্বমানবতা সেই দানবিক শক্তির সামনে আত্মসমর্পণ করে নিয়েছে। এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সেই মহান রেনেসাঁ কার্যত একটি আত্মাহীন একপেশে আখেরাত-বর্জিত, পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের জ্ঞানশূন্য, ভারসাম্যহীন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে যা আসলে কোনো সভ্যতাই নয়, বরং ভোগবাদী একটি যান্ত্রিক প্রগতিমাত্র (Utilitarian Technological advancement)।
এখন যারা সমাজের সচেতন মানুষ, যারা শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, পত্র-পত্রিকা নিয়ে আছেন সবার আগে তাদেরকে বর্তমানের সঙ্কটের গুরুত্ব আত্মা দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। চিন্তা করতে হবে যে আজকের আন্তর্জাতিক সঙ্কট, জাতীয় সঙ্কট কতখানি গভীর। আজ চোখের সামনে মানুষ হত্যা হচ্ছে, অন্য মানুষ কোনো প্রতিবাদ করে না, চোখের সামনে নগর ধ্বংস হচ্ছে, মানুষ নির্বিকার টিভি দেখছে। প্রতিকারের জন্য কোনো চেষ্টা নেই। চোখের সামনে লুটপাট হচ্ছে, চাঁদাবাজি হচ্ছে কোনো প্রতিবাদ করে না, চোখের সামনে সব অন্যায় হচ্ছে মানুষ দেখছে না। ভাবছে দেখে কী লাভ? এর অর্থ মানুষ অন্যায়কারীর কাছে, শক্তিমানের কাছে আত্মসমর্পন করেছে, সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ভাবছে আমি কোনোমতে জীবনটা কাটাই। এখন এই দুর্বলকে কে জাগাবে? কে তাদের ডেকে তুলবে? কে নতুন একটি রেনেসাঁ, নবজাগরণের সূচনা করবে? কে নতুন সভ্যতার আলো ছড়াবে? শিক্ষিত মানুষ কর্পোরেট বাণিজ্যের গোলাম হয়ে গেছে। অর্থের কাছে আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে। এখন আমাদের প্রগতি নয়, অধঃগতি, এখন উন্নতি নয় পতন, আমাদের এখন কেবল পরাজয়। আসন্ন বিশ্বযুদ্ধ তো একটা পরিণতি, আমাদের সবার অথর্বতা, স্থবিরতা, নিষ্ক্রিয়তার যোগফলমাত্র। সেই ধ্বংস, পরিণতি সামনে। এখনও বুঝতে হবে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সঙ্কটটা কী। চোখে তো প্রতিদিনের বিপর্যয় দেখতেই পাচ্ছেন, আর কত দেখবেন? আর দেখার কি আছে? এর পরেও দৃষ্টি ক্লান্ত হচ্ছে না? এখনই সময় আরেকটি নবজাগরণের যে জাগরণ হবে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
ইউরোপের সেই বিপ্লব, সেই রেনেসাঁ মানবজাতিকে যা দেওয়ার তা দিয়েছে। বহু প্রযুক্তি দিয়েছে, কিন্তু মানুষকে শান্তি দিতে পারে নি। এটা পারবেও না। এখন তা শক্তির শাসনে পর্যবসিত হয়েছে। তাদের সদিচ্ছার কোনো কমতি ছিল না কিন্তু তাদের আবিষ্কৃত ফর্মুলা বা পদ্ধতিগুলো তাদের কাক্সিক্ষত স্বর্গ দিতে পারে নি। পৃথিবীটা আজ স্বর্গের বদলে নরককু-ে পরিণত হয়েছে, তারা একটি আত্মাহীন, মানবতাহীন, ভারসাম্যহীন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। এ সত্যটি যত দ্রুত মানুষ হৃদয়ঙ্গম করবে তত দ্রুতই তারা পরবর্তী রেনেসাঁর অভিমুখে যাত্রার সূচনা করতে পারবে। আসলেই আমাদেরকে একটি নতুন রেঁেনসা করতে হবে, এই রেনেসাঁ হবে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যাবতীয় অসত্যের বিরুদ্ধে, যাবতীয় স্থবিরতার বিরুদ্ধে। অতীতে ধর্মের বিকৃত রূপগুলো মানুষকে স্থবির করেছিল, এখন করেছে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ভোগবাদী মতবাদগুলো। ফল একটাই- কান্না, অন্যায়ের কাছে আত্মসমর্পণ ও অসহায়ত্ব।
এই যে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতি, যুদ্ধ, সংঘাত মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে, তারা এসব থেকে কিছুতেই বের হতে পারছে না। মানুষ তো ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মানুষ প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে আইন, নীতি-নৈতিকতা ধর্ম সবকিছুই ধ্বংস করে ফেলছে। এখনও কি শিক্ষিত সমাজ এই সংকটটি উপলব্ধি করবেন না? যারা ঘরের কাছেই নিপীড়িত জনতার চিৎকার শুনে না, শুনলেও নিজেদের ধারণকৃত ব্যবস্থার জালে অসহায় বন্দীর মত চেয়ে থাকতে বাধ্য, কিছু করতে অক্ষম, যারা পাশের বাড়ির মানুষের চিৎকার শুনে না, এরা বধির, এরা মৃত। মানবসভ্যতাকে এই স্থবিরতা থেকে, মৃত অবস্থা থেকে উদ্ধারের একদিন রেনেঁসা হয়েছিল। সেই মানুষগুলি পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ ছিল, কিন্তু এখনকার মানুষ সক্রিয়ভাবে পরিবর্তনও চায় না। তাদের চেতনা নেই, বোধ শক্তি নাই। খাচ্ছে দাচ্ছে টিভি দেখছে যেন সব কিছু স্বাভাবিক আছে।
প্রগতি অতীতকে অস্বীকার করে না, অতীতে ফিরেও যায় না। সে অতীতকে মূল্যায়ন করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সময়ের পরিবর্তনে মানুষের মননশীলতার সঙ্গে মানানসই, কালের প্রয়োজন পুরন করার মত ব্যবস্থা নিয়েই যুগে যুগে নবী রসুলদের আগমন হয়েছে। না হলে একজন নবী দিয়েই কাজ চলত। এক লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল এসেছেন মানুষকে প্রগতির শিক্ষা দেয়ার জন্য, মানুষকে পিছনে ফেরানোর জন্য নয়। কিন্তু এখন আমরা পেছন দিকে হাঁটছি। আমরা অহঙ্কার করি আদিম সমাজে নাকি জোর যার মুল্লুক তার ছিল। এখনকার কথিত আধুনিক প্রগতিশীল সমাজে মুল্লুক কার? আমরা তো অতীতেই ফিরে গেছি। আপনারা উঁচু টাওয়ারের অহঙ্কার করেছেন। উঁচু উঁচু টাওয়ার অতীতের অনেক সভ্যতাই বানিয়েছিল। পিরামিড বানিয়েছিল, ঝুলন্ত বাগান বানিয়েছিল। সেই সব উঁচু টাওয়ার অভিশাপ হলো কেন, পর্যটকদের দর্শনীয় পরিত্যক্ত স্থান হলো কেন? কারণ উন্নতি প্রগতি যখন অহঙ্কারের বস্তু হয়ে দাঁড়ায় তখন তা অভিশাপে পরিণত হয়। এই আধুনিক সভ্যতার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অহঙ্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাবধান! অতীত থেকে শিখুন।
ইউরোপের রেনেসাঁর আগের রেনেসাঁটি ঘটিয়েছিলেন আল্লাহর শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.)। তিনি আরব জাতিকে জাহেলিয়াতের বন্দীদশা, কূপম-ূকতা থেকে এমন এক হ্যাঁচকা টানে বের করে আনলেন যে সেই অশিক্ষিত মূর্খ আরবরা জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় সকল জাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হল। তাদের চিন্তাশক্তি এতটাই গতিশীল হলো যে, তারা রসায়ন, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রযুক্তি, জীববিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, স্থাপত্যবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে বিশাল ভূমিকা রাখলেন, হাজার হাজার মহামূল্যবান বই রচনা করলেন। বহু নতুন ভূখ- তারা আবিষ্কার করলেন। সামরিক শক্তিতে তারা ছিলেন অপরাজেয়, রোমান পারস্যের মতো হাজার বছরের পুরনো শক্তিও তাদের সামনে শুকনো পাতার মতো উড়ে গিয়েছিল। উরাল পর্বত, কারাকোরাম, কিরঘিজ পর্বতের শিখরে তাদের পতাকা উড়ল। সেই আরবজাতি যারা কিছুদিন আগেও ছিল চিন্তাহীন, অথর্ব, চুরি-ডাকাতি আর কামড়া-কামড়িতে ব্যস্ত, ছিল অন্যায়কারী, অন্যায়ের সাথে আপসকারী ভীরু কাপুরুষ, তাদেরকে আল্লাহর রসুল দুঃসাহসী যোদ্ধা ও অর্ধ দুনিয়ার শাসক জাতিতে পরিণত করলেন, তারাই বিশ্বের বুকে সবচেয়ে আলোকিত, মহিমান্বিত, সমৃদ্ধ জাতিরূপে আবির্ভূত হলো। ইতোপূর্বে তারা ধর্ম বলতে বুঝত কাঠ পাথরের মূর্তি পূজা আর মন্ত্রপাঠ অর্থাৎ সংকীর্ণ গ-িতে, স্থবির জড়বস্তুর মধ্যে মানুষের অপার চিন্তাশক্তিকে আড়ষ্ট, আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। মানবজীবন প্রচ- গতিময়, ধর্মও যদি তদ্রƒপ গতিময় না হয় তাহলে তা পরিত্যাক্ত হবেই, মানুষ তা বেশিদিন বহন করতে পারবে না, এটা প্রাকৃতিক। রসুলাল্লাহ (সা.) তাদেরকে কী ধর্ম শেখালেন? না, স্থবির উপাসনা নয় বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষকে অত্যাচারী শাসকের জুলুম থেকে রক্ষা করা, ন্যায়ের স্থাপনা করা, এটাই তোমাদের ধর্ম, এটাই তোমাদের এবাদত। শেখালেন দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে। তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেই আরবরা নিজেদের সুপ্তসত্তাকে জাগ্রত করলেন, অনুভব করলেন তাদের মধ্যে অপার সম্ভাবনা লুকায়িত আছে। তারা নিজেদেরকে নতুনরূপে আবিষ্কার করলেন, বিশ্বের ইতিহাসকে পাল্টে দিলেন। আরব জাতির এ নবজাগরণ সম্বন্ধে, স্থবিরতার পরিবর্তে আলোড়ন সৃষ্টির নেপথ্য কারণ বলতে গিয়ে ইতিহাসবেত্তা Lothrop লিখেছেন- Forgetting the chronic rivalries and blood feuds which had consumed their energies is internecine strife, and welded into a glowing unity by the fire of their new found faith, the Arabs poured forth from their deserts to conquer the earth for Allah the One true God (The New World of Islam- Lothrop). অর্থাৎ “যে পুরাতন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পুরুষানুক্রমিক রক্তাক্ত বিবাদের দরুন ও আত্মকলহে তাদের শক্তি নিঃশেষ হচ্ছিল তা ভুলে যেয়ে এবং নতুন বিশ্বাসের আগুনে উজ্জ্বল ঐক্যে দৃঢ় সংবদ্ধ হয়ে আরবরা তাদের মরুভূমি থেকে বানের ঢলের মত নির্গত হলো- এক এবং সত্য অল্লাহর জন্য পৃথিবী জয় করতে।” কথা হলো, রসুলাল্লাহর সৃষ্ট এই রেনেসাঁ কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁর মতো আত্মাহীন, ভারসাম্যহীন, কেবল বস্তুতান্ত্রিক ছিল না। সেটা ছিল শরিয়াহ ও মারেফাত তথা দেহ-আত্মা, দুনিয়া আখেরাতের ধারণার সমন্বয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ (Balanced) সভ্যতা। যে সভ্যতা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে সম্প্রীতি সৃষ্টি করেছিল, সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করেছিল, কিন্তু পুঁজিবাদের শোষণ সেখানে ছিল না, অধিকাংশ মানুষ নৈতিক মূল্যবোধে, আত্মিক মানবিক গুণাবলীতে আলোকিত মানুষে পরিণত হয়েছিল। কালেভদ্রে কেউ অপরাধ করলে নিজে গিয়ে আদালতে নিজের প্রায়শ্চিত্যের জন্য শাস্তি কামনা করত, তাকে ধরে আনার জন্য পুলিশ গোয়েন্দাবাহিনী কিছুই প্রয়োজন পড়ত না। অর্থাৎ মানুষের ভেতরে বাহিরে আমূল পরিবর্তন করল। এটাই হলো প্রকৃত বিপ্লব, প্রকৃত রেনেসাঁ। সেই যে রেনেসাঁ সৃষ্টি করে দিলেন রসুলাল্লাহ সেটার ধাক্কা কয়েক শতাব্দী চলল। আবার যখন এই উম্মাহতে ভারসাম্য নষ্ট হলো, রাজা বাদশাহরা ভোগবিলাসে মত্ত হয়ে গেল, একদিকে ভারসাম্যহ
ীন সুফিবাদ জাতির সংগ্রামী বহির্মুখী চরিত্রকে অন্তর্মুখী করে দিল, গতিশীল জাতিকে স্থবির করে দিল; অপরদিকে আলেম মুজতাহিদ, মোফাসসেররা দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে লক্ষ লক্ষ মাসলা মাসায়েল উদ্ভাবন করে জাতিকে বহু ফেরকা, মাজহাবে বিভক্ত করে ফেলল এবং সহজ সরল দীনকে এমনভাবে মাকড়সার জালের ন্যায় জটিল ও দুর্বোধ্য করে ফেলল যে তা সাধারণের বোধগম্যতার বাইরে চলে গেল। দীনের ভারসাম্য নষ্ট হল। এভাবে জাতিকে পঙ্গুত্ব পেয়ে বসল, তারা অন্তর্মুখী জড় হয়ে গেল। তারপর থেকে তাদের উপর আবার গজব শুরু হলো যা এখনও চলছে।
এখন আমরা হেযবুত তওহীদ চেষ্টা করছি আবারও একটি রেনেসাঁ, নবজাগরণের সূচনা করতে, মানুষের চিন্তার জগতে বিপ্লব ঘটাতে। বুদ্ধি, চিন্তা, আত্মা, দৃষ্টি, বিবেক খুলে দিতে। মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে সঙ্কটের গভীরতা। তাকে জাগতে হবে, এই গোলকধাঁধা থেকে বের হওয়ার পথ সন্ধান করতে হবে।