হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রসঙ্গ তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্র: উম্মতে মোহাম্মদীর সামরিক কাঠামো কেমন ছিল?

৬৪১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমরা মিশরের আলেকজান্ড্রিয়া জয় করার পর বিজিত কপটিক খ্রিষ্টানরা মুসলিম বাহিনীর সম্মানে একটি ভোজের আয়োজন করেন। ভোজে বিভিন্ন পদমর্যাদার সৈন্যদের জন্য আলাদা আলাদা আসন নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু যখন ভোজ শুরু হয়, তখন আপ্যায়নকারীরা আবিষ্কার করেন যে, মুসলিম সেনাপ্রধান আমর ইবনুল আস (রা.) এবং অন্যান্য অধিনায়করা সাধারণ সৈন্যদের সঙ্গে একত্রে বসে ভোজন করছেন। ইসলামের এই বিরল সাম্যনীতি দেখে তারা মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে যান।

মোসলেম উদ্দিন:
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই জীবনব্যবস্থার অনুসারীদেরকে আল্লাহ একটি ‘উম্মাহ’ বলে অভিহিত করেছেন (সুরা ইমরান ৩:১১০)। একটি জাতির সদস্যদের ব্যক্তিজীবনের আচার-আচরণ নিয়ে যেমন ঐ ব্যবস্থায় নির্দেশনা রয়েছে, তেমনি জাতির সামরিক বিষয় ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েও নীতিমালা রয়েছে। ইসলামে নামাজ যেমন ফরজ (সুরা বাকারা ২:১৫৩), রোজা যেমন ফরজ (সুরা বাকারা ২:১৮৩), যুদ্ধও তেমন ফরজ (সুরা বাকারা ২:২১৬)। প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধের উদ্দেশ্য কী হবে- সেটাও পবিত্র কোর’আনে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে, সেটা হচ্ছে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। দুটো আয়াতের উদাহরণ দিয়ে উদ্দেশ্যটি বর্ণনা করছি। সুরা আনফালের ৩৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও যে পর্যন্ত ফেতনা নির্মূল না হয়।’ এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয় যে ফেতনা, ফাসাদ, অন্যায় অবিচার, যুদ্ধ রক্তপাত ইত্যাদি বন্ধ করার জন্য সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া আল্লাহর নীতি। আবার সুরা নিসার ৪:৭৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছ না নিপীড়িত নির্যাতিত (মুস্তাদ’আফিন) সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে তাই এখানে সশস্ত্র বাহিনীর প্রসঙ্গ এসে পড়ে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যখন রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সকল উপায় ব্যর্থ হয় তখন যুদ্ধ অবধারিত হয়ে যায়, এটি একটি চিরন্তন সত্য যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও যৌক্তিক। তাই সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক জাতি, রাজ্য ও সভ্যতায় সামরিক বাহিনীর ব্যবস্থা ছিল-আছে-থাকবে। বর্তমানে আমরা একে প্রতিরক্ষা বাহিনী বলে থাকি। বর্তমানে আমরা একটি জাতির মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক এই দুটো ভাগ দেখতে পাই। এক্ষেত্রে ইসলামের সাথে প্রচলিত পদ্ধতির একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে জাতিরক্ষার দায়িত্ব জাতির (উম্মাহ) প্রত্যেকের। তাই রসুলাল্লাহর যুগে গজফিতা দিয়ে মেপে ওজন করে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তিকে যুদ্ধে পাঠানো হয়নি। বরং গোটা জাতিকে তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধের সকল কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে হয়েছে, এমনকি নারী ও শিশু-কিশোররাও এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে; ঠিক যেভাবে দেশের প্রয়োজনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আপামর জনতা প্রশিক্ষণ নিয়েছিল ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল।

ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা সামরিক শক্তিবলে আমাদের ভারত উপমহাদেশের ভূখণ্ড দখল করার পর এখানে এক প্রকার নিরস্ত্রীকরণ ও নিবীর্যকরণ (Disarmament and demoralization) প্রক্রিয়া চালু করেছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পরে তারা ব্যাপকভাবে নিরস্ত্রীকরণ কার্যক্রম শুরু করে। অর্থাৎ এদেশের মানুষগুলো যেন একদম গোবেচারা, নিরীহ, নিরুত্তাপ, চেতনালুপ্ত দাসে পরিণত হয়, ব্যক্তিগত জিন্দেগির বাইরে যেন জাতীয় চিন্তাভাবনায় না জড়ায় সেজন্য সকল বন্দোবস্ত পাকা করল। তারা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে, সমাজনেতা ও ভাড়াটে আলেমদের নিয়োগ করে মুসলিমদের জেহাদ অর্থাৎ সামরিক চেতনাকে লুপ্ত করে দিল। ব্রিটিশরা ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করে সীমিত সংখ্যক ভারতীয়কে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের বেতনভুক্ত সৈন্যে পরিণত করেছিল। এই সেনাবাহিনী মূলত ব্রিটিশ শাসনকে সুসংহত করা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর মাধ্যমে ভারতীয়দের সামরিক চেতনাকে কার্যত রুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ইসলামের সিস্টেম হল সমগ্র জাতিকেই জীবনভর সামরিক প্রশিক্ষণ ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখা ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখা। ইসলামের ইতিহাস এমন ছিল না যে জাতির একটি ক্ষুদ্র অংশ জাতিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে আর বাকিরা দেশ রক্ষার ব্যাপারে নির্বিকার থাকবে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে। এজন্য আল্লাহর রসুল সমগ্র জাতির নিরাপত্তা রক্ষায় জাতির সকল সক্ষম সদস্যকে একটি ন্যূনতম সামরিক শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আধুনিক যুগে একে গণবাহিনী (Militia) বলা হয়।

বর্তমানে সামরিক ব্যবস্থাপনা বহুলাংশে প্রযুক্তিনির্ভর এবং অত্যাধুনিক, কাজেই বাছাই করা একটি নিয়মিত বাহিনী থাকতে হবে যারা যুদ্ধবিদ্যা ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের জ্ঞান হাসিল করবে। তারা পুরো জাতির সামরিক নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু সমগ্র জাতির সক্ষম নারী পুরুষকেও মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ অর্থাৎ সামরিক শৃঙ্খলা, শারীরিক প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার, অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক চিকিৎসা ও আত্মরক্ষার কৌশলে প্রশিক্ষিত হতে হবে। তারা বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিজ জাতিকে যেমন রক্ষা করবে, তেমনি বিশ্বের যেখানেই দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার হবে, মানবাধিকার লংঘিত হবে, সেখানেই তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যমত ভূমিকা রাখবে। এ কাজটি বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে সীমিত পরিসরে করা হচ্ছে যার নেতৃত্বে রয়েছে পশ্চিমারাই। এ পর্যন্ত (২০২৪) ৪৩ টি দেশে/অবস্থানে জাতিসংঘের ৬৩ টি শান্তি মিশনে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৬ জন শান্তিরক্ষী অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে চলেছেন। এছাড়াও আমরা দেখি যে বিশ্বের বহু দেশে যখন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লংঘিত হয় সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপ করে; উদ্দেশ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। গত এক শতাব্দিতে তারা এভাবে কোরিয়া (১৯৫০-১৯৫৩), ভিয়েতনাম (১৯৫৫-১৯৭৫), গ্রেনাডা (১৯৮৩), পানামা (১৯৮৯), হাইতি (১৯৯৪), ইরাক (২০০৩), লিবিয়া (২০১১), সিরিয়া (২০১৪-বর্তমান) ইত্যাদি দেশে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে। একইভাবে মানবাধিকার রক্ষায় ইসলামের ন্যায়-সুবিচার, সাম্য ও মৈত্রীর সুমহান বাণী ও ব্যবস্থা অপরাপর জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়া ইসলামিক রাষ্ট্রের সামারিক বাহিনীর দায়িত্বের আওতাধীন। এটি যুগপৎ একটি ঐশী দায়িত্ব, কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি হেদায়াহ ও সত্যদীন সহকারে আমার রসুলকে প্রেরণ করেছি যেন তিনি অন্যান্য সকল দীনের (জীবনবিধান) উপর একে বিজয়ী করেন।’ (সুরা ফাতাহ ৪৮:২৮, সুরা সফ ৬১:৯, সুরা তওবা ৯:৩৩)। অতএব, বিশ্বের অপরাপর মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ভূমিকা রাখার সেই প্রেরণা, সেই আদর্শ জাতিকে শিক্ষা দিতে হবে। এই শান্তি মিশন কেবল জাতিসংঘের অধীনে নয়, বরং আমাদের স্বতন্ত্র উদ্যোগেও প্রেরণ করা যেতে পারে। এই কাজ করতে গিয়ে যে সমস্ত সৈনিক (মুজাহিদ) রণক্ষেত্রে জীবন উৎসর্গ করবেন ইসলামে তাদেরকেই শহীদ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং তাদেরকে মৃত বলতে নিষেধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে তারা জীবিত এবং রিজিকপ্রাপ্ত (সুরা বাকারা ২:১৫৪, সুরা ইমরান ৩:১৬৯)। ইসলামের সর্বোচ্চ মর্যাদা (জধহশ) তাদের জন্য রাখা হয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্রও দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা শহীদ হবেন তাঁদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেবে এবং তাদের পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তবে ইসলামের সামরিক কর্মকাণ্ড কখনও কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। এই সামরিক বাহিনীর যাবতীয় কার্যক্রম সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ঘটনা। হিটলার জার্মানির পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে পোল্যান্ড, বেলারুশ, ইউক্রেন অতিক্রম করে রাশিয়া আক্রমণ করেছে, ডেনমার্ক, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ফ্রান্সসহ অন্তত আরো দশটা দেশে আক্রমণ করেছে, কিন্তু নিজের প্রতিবেশী দেশ সুইজারল্যান্ডকে আক্রমণ করেনি। না করার পেছনে ভৌগোলিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা কারণ থাকলেও সমর বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সুইজারল্যান্ডের মিলিশিয়া সিস্টেম ছিল এর অন্যতম কারণ। তারা সাধারণ নাগরিকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে এমন একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছে যা বিদেশি শক্তির আক্রমণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর। সুইজারল্যান্ড ছাড়াও ইসরাইল, ফিনল্যান্ড, তুরস্ক, নরওয়ে, সুইডেন, পোল্যান্ড, সিঙ্গাপুর- এই দেশগুলো তাদের মিলিশিয়া বা সশস্ত্র নাগরিক ব্যবস্থার জন্য পরিচিত। ঠিক এই কাজটি মহানবী (সা.) দেড় হাজার বছর আগে জাজিরাতুল আরবে করেছিলেন। আজকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক বাস্তবতায় এই ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি।

কোর’আনের শিক্ষা ও রসুলাল্লাহর সাহাবিদের দিকে তাকালে আমরা দেখি, তাদের জীবনযাপন ও চরিত্র সামরিক শিক্ষা ও শৃংখলার দিক থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ। ইসলাম তার উম্মাহর সদস্যদেরকে একটি আদর্শ দ্বারা এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে যে প্রয়োজনে তারা জান দেবে, শহীদ হবে, নিজেদের সমস্ত সম্পদ মাটি ও মানুষের জন্য উৎসর্গ করবে কিন্তু সম্মান দেবে না, জাতিকে পরাজিত হতে দেবে না, জাতির স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হতে দেবে না। বর্তমানে অনেকে সেনা সদস্যদের বেতনভাতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, কারণ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সৈনিকদের বেতনভাতা চলে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যরা যে ঝুঁকি গ্রহণ করে তার গুরুত্ব বিবেচনা করে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অধিকাংশ তাদের জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছেন (সুরা আনফাল ৮:৪১, হাদিস বোখারি- ৩১২৬, মুসলিম)।

জাতিসংঘ গঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বহু মুসলিম সংখাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ক্ষেত্রে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে, অস্ত্র ও প্রযুক্তি আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভয় দেখিয়ে অনৈতিক চাপ সৃষ্টির ঘটনা বারবার ঘটেছে এবং সেনাবাহিনীগুলো তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। স্বাধীন ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষানীতিই পারে জাতিসংঘ বা অন্য যে কোনো পরাশক্তির অনৈতিক দাবির মুখে নিজেদের জাতির মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখতে।

বর্তমানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রায়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভ্যন্তরে সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের প্রকাশ পেতে দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ বৈষম্য। সুযোগ সুবিধাসহ নানাপ্রকার শ্রেণি বৈষম্য। ইসলামে আমির আর মুজাহিদদের মধ্যে কোনো বৈষম্য দেখা যায়নি। সাধারণ সৈন্য, আমির, সর্বাধিনায়ক এমনকি খলিফা পর্যন্ত এক সঙ্গে, কখনও এক পাত্রে বসে খাবার খেতেন। এমন দৃশ্য দেখে অমুসলিম বাহিনীর লোকেরা চমৎকৃত হয়ে যেত যে এমন শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য কী করে সম্ভব? উমর (রা.) একবার একটি সভায় বলেছিলেন, ‘আমি যদি কোনো সৈন্যের থেকে ভালো খাওয়ার সুযোগ পাই, তাহলে আমি খলিফা হওয়ার যোগ্য নই।’ (বায়হাকি, মুসান্নাহ ইবনে আবি শায়বা)। তাই ইসলামের নীতি অনুসরণ করলে সামরিক বাহিনীতে সাধারণ সৈন্য ও অফিসারদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষোভ সৃষ্টির সুযোগ থাকবে না। অফিসার ও সাধারণ সৈন্য একে অপরকে নিজের ভাইয়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসবে, সম্মান করবে এবং যুদ্ধের ময়দানে একে অপরের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবে; আর বিদ্রোহের তো প্রশ্নই আসে না। উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কৌশল হতে পারে নিম্নরূপ:

নাগরিকদের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ: সকল নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম সামরিক শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হবে। আধুনিক যুগে একে গণবাহিনী (Paramilitary force) বলা হয়। বর্তমানে সামরিক ব্যবস্থাপনা বহুলাংশে প্রযুক্তিনির্ভর এবং অত্যাধুনিক, কাজেই বাছাই করা একটি নিয়মিত বাহিনী থাকতে হবে যারা যুদ্ধবিদ্যা ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের জ্ঞান অর্জন করবে। তারা পুরো জাতির সামরিক নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু সমগ্র জাতির সক্ষম নারী পুরুষকেও দেশপ্রেম ও ইমানী চেতনায় অনুপ্রাণিত করে মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ অর্থাৎ সামরিক শৃঙ্খলা, শারীরিক প্রশিক্ষণ, যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার, অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ, প্রাথমিক চিকিৎসা ও আত্মরক্ষার কৌশলে প্রশিক্ষিত করা হবে।

আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় ভূমিকা: আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী ও গণবাহিনী বহিঃশত্রুর হাত থেকে নিজ জাতিকে যেমন রক্ষা করবে, তেমনি বিশ্বের যেখানেই দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার হবে, মানবাধিকার লংঘিত হবে, সেখানেই তারা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সাধ্যমত ভূমিকা রাখবে। এই শান্তি মিশন কেবল জাতিসংঘের অধীনে নয়, বরং আমাদের স্বতন্ত্র উদ্যোগেও প্রেরণ করা যেতে পারে।

সামরিক কর্মকাণ্ড সার্বভৌমের অধীন: ইসলামের সামরিক কর্মকাণ্ড কখনও কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। এই সামরিক বাহিনীর যাবতীয় কার্যক্রম সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপ্রধানের অধীনে থাকবেন।

যুদ্ধলব্ধ সম্পদ: নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি শান্তি মিশনে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ যেমন ক্ষতিপূরণবাবদ প্রাপ্ত অর্থ অধিকাংশ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।

শ্রেণি বৈষম্য হ্রাস: সেনাবাহিনীতে অফিসার ও সাধারণ সেনাদের মধ্যকার বেতনভাতা ও সুযোগ সুবিধার বৈষম্য দূর করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যেন সৈনিকদের মধ্যে কোনো ধরনের অসন্তোষ সৃষ্টি না হয়। অফিসাররা তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে যৌক্তিক হারে অবশ্যই বেশি বেতন পাবেন, তবে সাধারণ সৈন্যদের জন্যও একটি ন্যায্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের পরিবারের অবস্থা নির্ধারণ করতে খানা জরিপ চালানো হবে এবং তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনুযায়ী বেতন, ভাতা এবং রেশন প্রদান করা হবে।

[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; ইমেইল: mdriayulhsn@gmail.com; ফোন: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১২৩০৯৭৫]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...