প্রশ্ন: পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি, তাদের জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনারা অনেক কথাই বলেছেন। তাদের দোষারোপ করে অনেক বিবৃতি দিয়েছেন। তাহলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সম্পর্কে আপনাদের মন্তব্য কী?
উত্তর: বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের শক্তিবলে সারা পৃথিবীতে একটি সভ্যতা বা Civilization প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে, যে সভ্যতাটা স্রষ্টাহীন, আত্মাহীন, ঈশ্বরহীন একটা বস্তুবাদী সভ্যতা। এতে ধর্মের কোনো জায়গা নেই, ভূমিকা নেই, ধর্মকে করা হয়েছে ব্যক্তিজীবনের ঐচ্ছিক বিষয় যা কোনোভাবেই সামাজিক কাঠামোর উপর প্রভাববিস্তারের অধিকার রাখে না। এই সভ্যতার মিডিয়া, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতির মাধ্যমে অবিশ্রান্ত প্রচারণার ফলে মানুষের জীবন হয়েছে চূড়ান্ত ভোগবাদী, অপরের সুখের জন্য নিজে ত্যাগস্বীকার করা, নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকারের জন্য কিছু বলার মতো লোকও সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। আর মানবজাতির কল্যাণে জীবনকে অতিবাহিত করবে এমন কথা কল্পনাতেও আনা যায় না। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে কেউ আর রাজি নয়। যা কিছু করবে সব নিজের স্বার্থে। এর পরিণামে মানুষ কারো উপর অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করে না, ফলে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে অন্যায়কারীরা নির্বিঘœ। একমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়াতে পারলেই আর কারো কোনো পরোয়া কেউ করে না। মানুষের মনে স্রষ্টার প্রতি জবাবদিহিতা বা পরকালের ভয় বিলীন হয়ে যাওয়ায় সমস্ত অপরাধ লাগামহীনভাবে বাড়ছে, মিথ্যা, প্রতারণা, ব্যভিচার যুগের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো দুনিয়াটা হয়ে গেছে অশান্তির নরককুণ্ড। এই সভ্যতাটাকে সৃষ্টি করেছে পশ্চিমারা। বিশ্বটা যখন তাদের অধীনে চলে গেল তখন তাদের থেকে এই জীবনদর্শন সব জায়গায় ঢুকেছে। আমরা এটার জন্যই পশ্চিমা সভ্যতার বিরুদ্ধে কথা বলি, পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে নয়। মানুষের নিরাপত্তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপর চাপিয়ে দেওয়া, যেন এজন্য নাগরিকদের বিধিবদ্ধ কোনো ভূমিকা নেই। এটা অযৌক্তিক। ভারতে কিন্তু কখনো এমন জীবন দর্শন ছিল না। ভারতে হাজার হাজার বছর গেছে শাস্ত্রের বিধানে, এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতিবোধ মানুষের রক্তে, অস্থিমজ্জায় মিশে ছিল। সেখানে পরিবার, গ্রাম, সমাজ ইত্যাদি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানরূপে কাজ করত। এগুলো মানুষের আচরণ ও শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করত। সে ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে দিয়েছে এই পশ্চিমা জীবনব্যবস্থার বিষাক্ত দর্শন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আগে শাস্ত্র থেকে জ্ঞান লাভ করে ব্যক্তিজীবনে এতই সৎ ছিলেন দুধে পানি মেশানোর কথা কল্পনাও করত না, অথচ আজ সব খাদ্যেই বিষ, সবকিছুতেই ভেজাল। মানুষ সবাই সবাইকে বিশ্বাস করত, চিন্তাও করত না মানুষ মিথ্যা কথা বলতে পারে, কিন্তু ব্রিটিশরা মামলা মকদ্দমার সিস্টেম চালু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে মিথ্যাবাদী হতে বাধ্য করেছে। হিন্দু কি মুসলিম, মানুষের ওয়াদা ছিল পাহাড়ের মত অনড়, সেখানে পশ্চিমাদের শেখানো রাজনীতির দ্বারা মানুষের ওয়াদা মূল্যহীন কথায় পরিণত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ব্যাপারে কথা বলি না কেন প্রশ্ন করা হয়, আগে বলুন- ৪৭ সালের আগে কি ভারত আলাদা ছিল? কারা একে আলাদা করল? যারা হাজার হাজার বছর ধরে একই ভূখণ্ডে, একই নদীর পানিতে লালিত হয়েছে, আজ একে অপরের শত্র“, পাকিস্তান বাংলাদেশ শত্র“, ভারত পাকিস্তান শত্র“। একে অপরকে শোষণ-শাসন করার চেষ্টা করছে, সীমান্তে হানাহানি করছে। এরা কবে থেকে শত্র“ হলো সে ইতিহাস দেখবেন না? আজ এই মানুষগুলি সম্পূর্ণ শত্র“ভাবাপন্ন হয়ে গেছে কারণ তারা নিজস্ব সভ্যতাকে পরিত্যাগ করে পশ্চিমাদের স্বার্থপর সভ্যতাকে গ্রহণ করে নিয়েছে; ফলে ব্যক্তিজীবনে তারা অসৎ হয়েছে, জাতীয় জীবনে দাঙ্গাপ্রিয় হয়েছে।
ভারতকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্র বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বিজেপির কাছে ১২৮ বছরের পুরাতন ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেস যেভাবে পরাজিত হলো তাতে আমরা এটুকু বলতে পারি যে, বর্তমানে ধর্মীয় অনুভূতিই সেখানে রাজনীতির মূল চালিকাশক্তি বা ফ্যাক্টর। গোটা উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীই, সনাতন কি মুসলিম, তারা অধিকাংশই ধর্মবিশ্বাসী। তাদের এ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিল করে রাজনীতিকরা ও ধর্মব্যবসায়ীরা। আমরা মনে করি, আমাদের দেশেও ধর্মকে নিয়ে একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই এখন জরুরি হয়ে পড়েছে মানুষকে ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দেওয়ার, যাতে ধর্মবিশ্বাস দেশ ও জাতির অকল্যাণে নয় কল্যাণে ব্যবহৃত হয়।
প্রশ্ন: পশ্চিমাদের পক্ষ হয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঈমান নষ্ট করছেন কেন?
উত্তর: আসলে আপনাদের অনেকের প্রশ্ন একেবারে বিপরীতমুখী। এক সাংবাদিক বললেন আমরা পশ্চিমাদের বিরোধিতা কেন করছি, কেন ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলি না। আরেক সাংবাদিক সরাসরি বললেন আমরা পশ্চিমাদের পক্ষ হয়ে ইসলামের সুনাম ক্ষুণœ করছি। একেবারে পরস্পর বিপরীত প্রশ্ন্। আসলে আমরা কোনটা করছি শুনুন। আমরা না পশ্চিমাদের পক্ষে বলছি, না আমরা আরবীয় ইসলামের কথা বলছি। আসলে আমরা মুসলমান জনগোষ্ঠীর ঈমানকে সঠিক পথে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছি। তাদের ঈমান আমরা কী নষ্ট করব, তাদের ঈমান তো বহু আগেই নষ্ট করে দিয়েছে এই জাতির ধর্মব্যবসায়ী, আলেম-মোল্লা শ্রেণি আর পশ্চিমা ষড়যন্ত্রমূলক দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। ধর্মব্যবসায়ীরা তাদের ঈমানকে ছিনতাই করে নিয়ে নিজেরা টাকা কামাচ্ছে, কেউ রাজনীতির মাঠে ছক্কা মারতে চাইছে, কেউ জঙ্গি বানিয়ে আত্মঘাতি হতে উদ্বুদ্ধ করছে। সেখান থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমানকে উদ্ধার করতে চাইছি আমরা। এবং সেটাকে সঠিক পথে ব্যবহার করতে চাইছি যেন সে দুনিয়াতেও লাভবান হয়, আখেরাতেও লাভবান হয়। এই যে বলা হয়ে ধর্মপ্রাণ মানুষের ঈমান। আমরা এ কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। আগে বলুন ধর্মপ্রাণ কী? ধর্ম যাদের প্রাণের মধ্যে তারাই ধর্মপ্রাণ। আজ মুসলমান জনগোষ্ঠীর কাছে ধর্ম বলতে নামাজ, রোজা, পূজা, ঈদ, মিলাদ, ওয়াজ, ধ্যান, যিকির-আজকার ইত্যাদি। ধর্ম কি এগুলো? না। মানুষের প্রকৃত ধর্ম হচ্ছে মানবতা, মনুষ্যত্ব। এটি যার নেই সে ধার্মিক নয়, নামাজ রোযা যতই করুক না কেন। প্রতিটি ধর্মের এ উদ্দেশ্য, মানুষের দুঃখ দুর্দশা, অন্যায়-অবিচার, শ্রেণি-বৈষম্য দূর করে একটি শান্তিময় সমাজ নির্মাণের পথনির্দেশ দান করা। মানবতা বাদ দিয়ে ধর্ম নেই, এটাই ধর্মের আত্মা, এই আত্মাকে বাদ দিলে ধর্ম মৃত। আজ আমরা পৃথিবীতে যে ধর্মগুলো দেখছি সব মৃত, উপাসনা সর্বস্ব। এ কথা আমরা সকল ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রমাণ করেছি। মানুষ যখন ধর্মের আত্মার সন্ধান অর্থাৎ মানবতাবোধ ফিরে পাবে তখন সে আর অন্যের বিপদ দেখে চোখ বুজ থাকবে না, সে ধর্ম দ্বারা তাড়িত হয়ে ছুটে যাবে- ঠিক যেভাবে এখন সে ধর্মের দ্বারা তাড়িত হয়ে মসজিদে-মন্দিরে ছুটে যায়, মক্কা-মদীনায় ছুটে যায়। সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে। সে বুঝতে পারবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই আসল এবাদত। আমরা ধর্মের এই সঠিক রূপ আবার তুলে ধরছি। অথচ আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় আমরা মানুষের ঈমান নষ্ট করছি।
কেন আসছে এই অভিযোগ? কারণ আমাদের কথাগুলো ধর্ম সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত ভুল ধারণাগুলোকে চুরমার করে দেয়। এটাকেই বলা হচ্ছে- ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া। এটা তো সবযুগেই হয়েছে। সকল নবী-রসুলই তাঁর সমসাময়িক বিকৃত ধর্মের ধারক বাহকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন এবং তাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন, বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। ঈমান নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ স্বয়ং আমাদের নবী মোহাম্মদ (দ.) এর বিরুদ্ধেও উঠেছিল। আল্লাহর অশেষ শোকর, এ অভিযোগটি আমাদের বিরুদ্ধেও করা হয়। এ বিষয়ে আমাদের কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু করা হলে তার সমালোচনা হবে এটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি স্রষ্টার দেওয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু বললে বা আচার-আচরণ করলে, সেটারও সমালোচনা করা স্বাভাবিক এবং করা কর্তব্য। আমরা সেটাই করছি। আমরা শত শত বিষয়ে প্রমাণ দিচ্ছি যে ধর্মব্যবসায়ীরা যা বলছেন ও করছে তা আল্লাহর সংবিধান তথা কোর’আন হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারাই ঈমানদার মানুষকে দিয়ে অবৈধ কাজ করাচ্ছে, তাদেরকে জাহান্নামের দিকে চালিত করছে। তাদের কাজের ফলে মানুষ ধর্মের থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আল্লাহ-রসুলকে গালাগালি করছে। সুতরাং আমরা ধর্মের অবমাননা করছি না, অবমাননা থেকে ধর্মকে রক্ষা করতে চাইছি। ধর্মবিশ্বাস বা ঈমানকে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতিতে কাজে লাগাতে চাইছি।