মুস্তাফিজ শিহাব
বর্তমানের যুগকে বলা হয় তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। বর্তমানের এ যুগে তথ্য ও প্রযুক্তির ন্যুনতম জ্ঞান না রাখাটা অনেকটাই জেনে শুনে পাপ করার সামিল। প্রযুক্তি হচ্ছে সেই সকল উপাদান যা মানুষকে বিভিন্ন কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে মানবজীবনকে সহজ করে তোলে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কলম তৈরির প্রযুক্তি আবিস্কারের ফলে মানবজাতি তার চিন্তা শক্তিকে সহজেই লিখিত রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে। ধীরে ধীরে সেই প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের ফলেই আজ আমরা ছাপার মেশিনে লেখা ছাপাতে পারছি। তেমনি মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ আমাদের জীবনকে করে তুলেছে সহজ ও শান্তিময়। কিন্তু প্রযুক্তি একদিকে যেমন আশীর্বাদ অন্যদিকে আবার অভিশাপও। প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান বিকাশ মানব সভ্যতাকে হাজার বছর এগিয়ে দিলেও, শুধু এই সভ্যতাতেই, নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে মানবজাতি হাজার বছর পিছিয়ে গিয়েছে।
মানুষ, সৃষ্টির শুরু থেকেই ¯্রষ্টাপ্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী। মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, “আর আল্লাহ আদমকে শিখালেন সমস্ত বস্তু সামগ্রির নাম (সুরা বাকারা ৩১)।” অর্থাৎ সৃষ্টির শুরতেই ¯্রষ্টা নিজেই মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে দিলেন। এবার সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানুষ সেই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আবিষ্কার করল বিভিন্ন প্রযুক্তির। প্রযুক্তির এই ক্রমবর্ধমান উন্নতি সম্পর্কে নতুন করে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের সামনে আজ প্রযুক্তির আকাশচুম্বি উন্নতি দিনের আলোর মতোই দৃশ্যমান। সভ্যতার ক্রমবিকাশে নতুন প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ খুব কমই ঘটেছে। মূলত আবিষ্কৃত প্রযুক্তির বিকাশই আমাদের বর্তমান উন্নতির সোপান।
বাংলাদেশেও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। গত দশ বছরের হিসাব যদি করা হয় তবে দেখা যাবে বাংলাদেশ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির দিকে বেশ এগিয়ে গিয়েছে। সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশন (সি.আর.আই) এর গবেষণা অনুযায়ী গত দশ বছরে পুরো দেশজুড়ে ৫,২৮৬ টি ডিজিটাল সেন্টার তৈরি করা হয়েছে যেখানে সাধারণ জনগণ খুব সহজেই ইন্টারনেটভিত্তিক কাজগুলো করতে পারছে। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ এবং ৯৫ শতাংশ জায়গা মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক থ্রিজি পেড়িয়ে ফোর-জি ছুঁয়েছে এবং সরকার একে আরো উন্নত করার প্রচেষ্টা করছে। ২০০৬ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১.৬ মিলিয়ন যা ২০১৮ তে এসে ৮৬ মিলিয়নে পৌঁছেছে। আইসিটি ভিত্তিক কর্মসংস্থানের ফলে বেকারত্ব দূর হয়েছে এবং বেশ ভালো পরিমাণে অর্থ আমাদের অর্থনৈতিক খাতে যুক্ত হচ্ছে। প্রযুক্তির আশীর্বাদে আমাদের দেশ এগিয়ে গিয়েছে এ কথায় আর কোনো সন্দেহ থাকে না। কিন্তু এই আশীর্বাদের সাথে সাথে প্রযুক্তি আমাদের জন্য অভিশাপও ডেকে নিয়ে এসেছে। ঠিক যেন অমৃতের সাথে উত্তলিত হওয়া হলাহল বিষ।
প্রযুক্তির সহজলভ্যতার ফলে আমাদের সমাজে আজ সৃষ্টি হয়েছে অস্থিতিশীলতা এবং নিরপত্তাহীনতা। নৈতিক অধঃপতনে পতিত হয়েছে আমাদের যুবসমাজ। এমনকি ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুরা ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ছে এবং এর ফলে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে অনেকেই ভারাসাম্যহীনতার শিকাড় হচ্ছে এবং আত্মহত্যা, মাদক সেবন ইত্যাদি অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। “একটি প্রতিবেদনে দেখা যায় বর্তমানে ইন্টারনেটের তথ্যভা-ারের প্রায় ২৫ শতাংশই পর্নোগ্রাফি। প্রায় ২০ কোটি ওয়েবসাইটের মধ্যে পাঁচ কোটি ওয়েবসাইটই পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইট। শিশুদের নিয়ে তৈরি অশ্লীল ছবির ওয়েবসাইট রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখের বেশি। ১০ লাখের বেশি শিশুর ছবি রয়েছে এসব সাইটে। ১০ লাখের মতো অপরাধী এসব অবৈধ ব্যবসায় যুক্ত (প্রযুক্তির অপব্যবহার ও সামাজিক অবক্ষয়, আমাদের সময়, প্রকাশকাল: ২৯ মার্চ ২০১৭)।” এই শেষ নয়, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা আমাদের যুবসমাজকে খুন, ছিনতাই, অপহরণসহ অন্যান্য অপরাধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
যুবসমাজের এ ধরনের অধঃপতনের পুরোটা দোষ আমি প্রযুক্তির উপর দিব না। একটি সুঁই দিয়ে আপনি যেমন কাপড় সেলাই করতে পারেন তেমনি অন্যের ক্ষতিও করতে পারেন। সুঁইয়ের এখানে কোনো দোষ নেই। তেমনি প্রযুক্তিও অনেকটাই আপনার ব্যবহারের উপর নির্ভর করে। বতর্মানে আমাদের অভিভাবকগণ তাদের কিশোর-কিশোরীদের যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে গিয়ে তাদের এতটাই স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে যে তারা আজ আত্মাহীন সভ্যতার উন্মুক্ত শিকার। তাদের মধ্যে ছোট-বেলা থেকেই নীতি নৈতিকতার অভাব থাকার ফলে তারা ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য করতে পারছে না। তারা নিজেদের বিবেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয় না কারণ তারা সেই শিক্ষা পায়নি। সেই শিক্ষা তারা পেতে পারতো ধর্ম থেকে কিন্তু বর্তমানের ধর্মহীন বস্তবাদী সভ্যতায় ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তাদের কাছে পৌঁছায়নি। পাশ্চাত্যের অনুকরণ করতে করতে আমরা এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছি যে আমরা নিজেরাই যে নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছি সেটা বুঝতে পারছি না। আমাদের মধ্যে সচেতনার অভাব বেশ প্রকট। এর ফলে আমাদের শিশু-কিশোরা কী করছে সেদিকে আমরা খেয়াল না করে তাদের প্রযুক্তির সাথে অবাধ মেলামেশাকে বেশ ভালোভাবেই মেনে নিয়েছি এবং ভাবছি তারা এ যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর ফলে তাদের আত্মা যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখছে কয়জন অভিভাবক? একটু ঘেটে দেখলেই পাওয়া যাবে আত্মহত্যার ঘটনা ১০ বছর আগে যা ঘটতো তার চেয়ে এই বিগত বছরগুলোতে বেশি ঘটেছে। এর কারণ আর কিছুই নয়, আত্মিক শূণ্যতা ও হতাশা।
বর্তমানের সভ্যতার আরেক নাম বস্তুবাদী সভ্যতা। বস্তুবাদী এই সভ্যতায় প্রতিটি বিষয়ই বস্তুগত এবং স্বার্থকেন্দ্রীক। এর ফলে আমাদের সমাজের মানুষগুলোই পাশ্চাত্যের অনুকরণে সেই একই বিষয় চর্চা করে আসছে। কিন্তু এই অন্ধচর্চা আমাদের বন্ধ করতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। অভিভবাকগণের সচেতনতার পাশাপাশি সচেতন হতে হবে আমাদের কিশোর ও যুবসমাজকে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা যদি প্রকৃত শিক্ষা না দিতে পারি, যদি তাদের নৈতিকতা বৃদ্ধি করতে না পারি তবে আমাদের ভবিষ্যত হবে চরম দূর্গতিপূর্ণ। সচেতনার পরপরই আমাদের প্রয়োজন হবে সঠিক নৈতিক শিক্ষা যা খুব সহজেই ধর্ম থেকে পাওয়া যায়। প্রতিটি ধর্মই অন্যায় ও অশ্লীলতার বিরুদ্ধে কথা বলে। আমাদের শিশু-কিশোরদের ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা দিতে হবে। তাদের সামনে তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য তুলে ধরতে হবে। তারা আল্লাহর খলিফা, আল্লাহর প্রতিনিধি। তাদের জীবনের একটি লক্ষ্য রয়েছে, উদ্দেশ্য রয়েছে। এই দেশ, এই জাতি তাদের পথ চেয়ে অপেক্ষা করছে। তারা যদি আজ এই দেশ ও জাতির কল্যাণ করার জন্য নিজেদের তৈরি না করে প্রযুক্তি অপব্যবহার করে মাদক, অশ্লীলতা, অনৈতিক কর্মকা- ইত্যাদির দিকে পা বাড়ায় তবে এই জাতি অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে।
অতএব এখনই আমাদের এই ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত। পাশ্চত্যের দাজ্জালীয় সভ্যতার অনুকরণ ত্যাগ করে একটি সঠিক আদর্শ ধারণ করা উচিত যার মাধ্যমে আমাদের যুবসমাজ তাদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন হবে এবং তারা হয়ে উঠবে এক একজন, মানবতার কল্যাণে-দেশের কল্যাণে, নিবেদিত প্রাণ। প্রকৃত ধর্মের শিক্ষার পাশাপাশি প্রযুক্তির শিক্ষা তাদের সাথে সাথে বর্তমান জাতিকেও এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে দিবে যার কথা অনেকেই কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। তাই আসুন আমরা এই বিষয়ে সচেতন হই এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেদের অবদান রাখি।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, facebook.com/glasnikmira13)