আসাদ আলী:
পৃথিবীতে এখন গণতন্ত্রের জয়জয়কার। জয় পাশ্চাত্যেরও। প্রায় সকল জাতিগোষ্ঠীই পাশ্চাত্য থেকে গণতন্ত্র আমদানি করে তার স্বাদ উপভোগ করছে। গণতন্ত্র যেন অমৃতভা-ার, যার ভেতরে অবস্থিত অমৃত মানবজাতিকে অমরতার স্বাদ আস্বাদন করাচ্ছে। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার মতো পাশ্চাত্যের মিডিয়া অনর্গল সে অমৃতের প্রতি মানুষের মোহ বিস্তার করে চলেছে আর সাধারণ মানুষ সুরের মুর্ছনায় হিতাহিত বোধ হারিয়ে সে অমৃতের পানে ছুটছে। অতঃপর চূড়ান্তভাবে এমন ঠিকানায় পৌঁছুচ্ছে যেখান থেকে না সামনে এগোনো যায়, না পেছনে ফেরা যায়। কোনোভাবেই পরিণতি এড়ানো সম্ভব হচ্ছে না।
গণতন্ত্রের তত্ত্বকথা আজ পদে পদে মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। গণতন্ত্রের বহুতল ভবনে ফাটল ধরেছে বহু আগেই, এখন তা যেন বিধ্বস্ত হবার দ্বারপ্রান্তে। যারা অনবরত গণতন্ত্রের মহিমা প্রচার করতে গিয়ে মানবতা, আইন ও অধিকারের মায়াজাল বিস্তার করেন তারাও আজ অস্বীকার করতে পারছেন না যে, গণতন্ত্রের কোনো স্বতন্ত্রতা নেই। একেক জনের কাছে গণতন্ত্রের রূপ একেক রকম। এর সংজ্ঞা সবার কাছেই অভিন্ন, তবে প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন। সংজ্ঞা মোতাবেক গণতন্ত্র হচ্ছে- ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণের ক্ষমতায়ন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, বাক স্বাধীনতা, আইনের শাসন, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা। আর বাস্তবে প্রচলিত গণতন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে- কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার, অবাঞ্ছিত জনগণ, ক্ষমতাপূজারী বিরোধী দল, নির্বাচনের নামে প্রহসন, জাতীয় অনৈক্য, হানাহানি, মিথ্যাচারিতা, বিশ্বাসঘাতকতা, বাক স্বাধীনতা হরণ, প্রশাসনের দলীয়করণ, বিতর্কিত বিচারবিভাগ। এই গণতন্ত্র পাশ্চাত্যে প্রয়োগ করলে একরকম ফল পাওয়া যায়, প্রাচ্যে অন্য রকম। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে কেউ নায়ক হয়, আবার কেউবা খলনায়ক; কেউ মানুষ মারে-আর কেউ মারতে পথ তৈরি করে দেয়। বহুদিন ধরেই আমরা গণতন্ত্রের এমন চেহারা দর্শন করছি। একদল রাজনীতিক সদলবলে রাজপথে নামেন গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য। তাদের কথিত ঐ গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে বহু মানুষ দগ্ধ হয়, পুড়ে মরে। অন্যদিকে আরেকদল রাজনীতিক সে আন্দোলনকারীদের মেরে-ধরে, মামলা দিয়ে ও জেলে ঢুকিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ করে ঐ গণতন্ত্র রক্ষার নামেই।
গণ অর্থ জনগণ, আর তন্ত্র অর্থ বিধান বা শাসন। অর্থাৎ, গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। কথাটি যতটা মধুর শোনাচ্ছে কার্যক্ষেত্রেও যদি ফলাফলটা অতটা মধুর হতো কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তেমনটা হয় নি। একটি রাষ্ট্রের সমস্ত জনগণ একই মতের অনুসারী হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। একটি বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মতামত থাকতে পারে। কিন্তু যখনই আইন, দ-বিধি অর্থনীতি বা যে কোন ব্যাপারেই কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তখনই একটা সার্বভৌমত্বের প্রয়োজন হবে। উদাহরণÑ সমাজে অপরাধ দমনের জন্য নরহত্যার শাস্তি মৃত্যুদ- হওয়া উচিত কিনা। কিম্বা সমাজের সম্পদ সঠিক এবং সুষ্ঠু বিতরণের জন্য অর্থনীতি সুদভিত্তিক হওয়া সঠিক কিনা? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণ যদি ঐ সব বিষয়ে আলোচনা, পরামর্শ, যুক্তি-তর্ক করেন তবে তা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকবেÑ কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না, কারণ এইসব বিষয়ে প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন মতামত আছে। একদল বলবেনÑ নরহত্যার অপরাধে মৃত্যুদ- আইন না করলে সমাজে নরহত্যা থামবে না, বাড়বে; আরেক দলের মত এই হবে যে মৃত্যুদ- বর্বরোচিত, নৃশংসতা, এ কখনো আইন হতে পারে না; আরেক দল হয়তো এই মত দেবেন যে একটি নরহত্যার জন্য মৃত্যুদ- না দিয়ে একাধিক নরহত্যার জন্য মৃত্যুদ- আইন করা হোক। একাধিক অর্থে কয়টি নরহত্যা করলে মৃত্যুদ- দেওয়া হবে, দুইটি না একশ’টি তাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। এবং এ বিতর্ক অনন্তকাল চলতে থাকবে। এই যে সার্বভৌমত্বের জটিলতা, এটাকে কাটিয়ে ওঠার জন্যই প্রয়োজন পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার। অর্থাৎ যে কোনো প্রশ্নে, যে কোনো সিদ্ধান্তের প্রয়োজনে অধিকাংশ জনতা যেটাকে সমর্থন করবে সে সিদ্ধান্তই বৈধ বলে মেনে নেওয়া হবে।
এখন প্রশ্ন হলো ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ, সত্য-মিথ্যার মানদ- কি শুধুই সংখ্যাগরিষ্ঠতা? সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না? সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কি অন্যায়, অবৈধ, অসত্য কিছুকে সমর্থন দিতে পারে না? এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের কাছে কী সমাধান? এ প্রশ্ন আমার বহুদিনের, যার উত্তর আজও পাই নি। বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটু বেশিই বহুরূপী। একে বলা হয় ‘শিশু গণতন্ত্র’। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসেও যে শিশু তার শিশুত্ব হারায় নি। এখনও এই শিশুকে হাতে ধরে দাঁড় করাতে হয়। সমাজের সুশীল ব্যক্তিত্ব সেই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। গণতন্ত্রের দুর্বল জায়গাগুলো খুঁজে বের করে এই চিন্তাবিদরা যদি তার হাল না ধরতেন তবে বহু পূর্বেই গণতন্ত্রের কবর রচিত হতো। গণতন্ত্র রক্ষায় তাই সুশীলদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এটা দেশের প্রতিটি সরকারই অনুধাবন করেন বিধায় সুশীলদের মনোবাঞ্ছনা পূরণে তেমন কসুর করেন না। ড. কামাল হোসেন এক আলোচনায় বলেছিলেন- ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে কিছু করাই গণতন্ত্র নয়। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের জন্য জাতীয় ঐক্যমত দরকার।’ উল্লেখ্য, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে কিছু করাই গণতন্ত্র নয়’- তাঁর এই উক্তিটি একটি সনামধন্য পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হিসেবে স্থান পেয়েছিল।
পূর্বেই বলেছি আমার বহুদিনের প্রশ্ন ছিল- সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে রায় দেবে সেটাই গণতন্ত্র কিনা। গণতন্ত্রে সত্য-অসত্য, ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধের ভিত্তি শুধুই সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিনা। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে কিছু করাই গনতন্ত্র নয়, কিন্তু কীসের ভিত্তিতে কাজ করা গণতন্ত্র এটা পরিষ্কার হলো না। সংখ্যাগরিষ্ঠের বিধানই যদি গণতন্ত্র না হয়, তাহলে গণতন্ত্র কাকে বলে? গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আসলে কী? কোন কাজকে আমি গণতান্ত্রিক বলব, আর কোন কাজকে বলব অগণতান্ত্রিক? গণতন্ত্রের যে বিশ্বরূপ আমরা দেখে থাকি তাতে কিন্তু কার্যত সংখ্যাগরিষ্ঠকেই বিধাতার আসনে বসানো হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যা চাচ্ছে সেটাই বৈধতা পাচ্ছে, যা অস্বীকার করছে সেটা হচ্ছে অবৈধ। এ কথার সমর্থনে শত শত দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা যায়। এখানে মাত্র একটি বিষয়ে বলব।
সমকামিতা আমাদের দেশে শুধু অপরাধই নয়, এক ঘৃণিত, অরুচিকর, অপ্রাকৃতিক ও ধিক্কৃত ব্যবস্থার নাম। এ দেশের অধিকাংশ জনগণ এর বিরোধী হওয়ায় গণতান্ত্রিক সিস্টেমে এটা অবৈধ হিসেবে পরিগণিত হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও তা অবৈধ। নেদারল্যান্ডসে সর্বপ্রথম সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ ঘোষণা করা হয়। ২০০১ সালের এপ্রিল থেকে সে দেশে এটি কার্যকর আছে। এরপর ২০০৩ সালের জুন মাসে নেদারল্যান্ডসের প্রতিবেশী দেশ বেলজিয়ামে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহ বৈধ করা হয়। অন্যদিকে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইওয়াহানা সিগুরডোটির এবং তাঁর সঙ্গিনী ইওহিনা লিওসডোটির সমকামীদের বিয়ে বৈধ ঘোষণার পর প্রথমেই সেই সুযোগ নিয়েছেন। সিগুরডোটির হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মেয়ে সমকামী রাষ্ট্রপ্রধান। ২০০১ সাল থেকে সমলিঙ্গ যুগলের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন বৈধ করেছে জার্মানি। এই প্রক্রিয়ায় জার্মানিতে বিয়ের সুযোগ সুবিধার অনেকটাই পান সমকামীরা। এর কারণ হিসেবে এক জরিপে দেখা গেছে, জার্মানির ৬৬ শতাংশ জনসাধারণই সমকামীদের মধ্যে বিয়ের পক্ষে। এদিকে ২০১৩ সালে সমকামিতা বিরোধী প্রচারণা নিষিদ্ধ করে আইন পাশ করে রাশিয়া।
আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সমকামিতা চায় না। এদের দৃষ্টিতে সমকামিতা অবৈধ। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে সমকামীদের বৈধতা দেওয়া তো দূরের কথা কোনো সরকারই তাদের সামান্য পরিমাণ সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করারও দায় নিতে চায় না। কিন্তু উপরোক্ত কয়েকটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টিতে সমকামিতা বৈধ হওয়ায় সে দেশের সরকার অরুচিকর এই সমকামিতা ব্যবস্থাকে আইনত বৈধ করেছে। এ থেকে আমরা কী ইঙ্গিত পাচ্ছি? এই ইঙ্গিত পাচ্ছি যে, গণতান্ত্রিক সিস্টেমে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতই হচ্ছে বৈধ-অবৈধতার মাপকাঠি। ন্যায়-অন্যায়, সভ্যতা-অসভ্যতা, সত্য-মিথ্যা, রুচি-অরুচির কোনো পার্থক্য এ সিস্টেমে নেই, নেই নৈতিকতাবোধ বা মানবতাবোধের বালাই।
কিন্তু সত্য সত্যই, ন্যায় ন্যায়ই, সারা পৃথিবীর মানুষ অস্বীকার করলেও সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না। আবার সারা পৃথিবীর মানুষ সত্য বললেও মিথ্যা সত্যে পরিণত হয় না। কাজেই সত্য-মিথ্যার নির্ণায়ক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়। গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রীতির কারণেই পৃথিবীর আজ এই হাল। উপরন্তু খাতা-কলমে সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে- আজ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। কৃর্তত্বপ্রবণ সরকারগুলো যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে মেনে নিতে বাধ্য করা হয়।