আতাহার হোসাইন:
অনেক ধার্মিক আছেন, যারা ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন, কিন্তু সমাজ নিয়ে সামান্য ভাবনা নেই। চরম আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরের মত বেঁচে থাকেন। তারা দামি হোটেলের দামি খাবার খান, মহামূল্যবান পোষাক পরেন, বিলাসবহুল গাড়িতে যাতায়াত করেন, কিন্তু একটি বারও সমাজের বুভুক্ষু, হাড্ডিসার, আর্তপীড়িত মানুষের অসহায়ত্বের চিত্র তাদের চোখে ভাসে না, অন্তরে রেখাপাত করে না।
আরেকটি শ্রেণি রয়েছে যাদের মন-মগজ মসজিদ-মন্দির-গীর্জা-প্যাগোডার চার-দেয়ালের ভেতরে আবদ্ধ। এরা সারাদিন রোজা রাখেন, গভীর রাতে তাহাজ্জুদ পড়েন, পূজার বেদিতে প্রসাদ অর্পণ করেন, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন, রোজ রোজ জীবে প্রেম করার শপথ বাক্য পাঠ করেন, জপমালা জপেন, শ্রদ্ধার সাথে ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন, কিন্তু ঐ মসজিদ, ঐ মন্দির, ঐ প্যাগোডা বা ঐ গীর্জার পাশেই যে বুভুক্ষু হাড্ডিসার দুর্বল মানুষটি দু’দিন হলো না খেয়ে পড়ে আছে তার দিকে ভুলেও চেয়ে দেখেন না। এই কথিত ধার্মিকরা সমাজের অত্যাচারিত, মজলুম, আর্তপীড়িত মানুষের ক্রন্দনের দিকে ভ্রæক্ষেপ করেন না কারণ ওটা তাদের কাছে দুনিয়াদারী। তারা এই দুনিয়াদারী না করে সদা ধর্মপালনে রত থাকেন! এদের এই দুনিয়াবিমুখ ধর্মকর্ম দিয়ে কার কী লাভ হচ্ছে তারাই ভালো জানেন। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনো ধর্মেরই নবী-রসুল-অবতার-মহামানবরা এমন দুনিয়াবিমুখ ধর্মকর্ম করে যান নি। তারা মানুষ নিয়ে ভেবেছেন, মানুষের জন্যই সংগ্রাম করে গেছেন।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাক্তন অধ্যাপক শৈলেন্দ্র বিশ্বাস এম. এ প্রণীত সংসদ্ বাঙ্গালা অভিধানে ‘ধর্ম’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে- ‘স্বভাব, শক্তি, গুণ’ অর্থাৎ বস্তুর অভ্যন্তরস্থ সেই নীতি যা সে মেনে চলতে বাধ্য থাকে। প্রতিটি পদার্থ, প্রতিটি প্রাণীরই সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতিগত কিছু গুনাগুণ থাকে যাকে উক্ত পদার্থ বা প্রাণীর ধর্ম বলে। যেমন আগুনের ধর্ম পোড়ানো, উত্তাপ দেওয়া, আলো দেওয়া। আগুনের এই গুণ সনাতন, শাশ্বত। লক্ষ বছর আগেও আগুন পোড়াতো, লক্ষ বছর পরও পোড়াবে। এটাই তার ধর্ম। এখন যদি আগুন কোন কারণে পোড়াতে ব্যর্থ হয়, উত্তাপ না দেয়, আলো নির্গত না করে তবে ঐ আগুনকে কি আগুন বলা যাবে? সে তো শুধু আগুনের প্রতিচ্ছবি, অর্থাৎ শুধুমাত্র আগুনের অবয়ব ধারণ করে আছে।
একইভাবে হীরক যদি তার কাঠিন্য, ঔজ্জ্বল্য ও সৌন্দর্য হারায় তবে তাকে আপনি কী বলবেন? বাঘ যদি তার হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা, গতিশীলতা, শক্তি, সাহস হারায় তবে সে বড় দেহধারী বিড়াল ছাড়া আর কী? একইভাবে মানুষেরও কিছু প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ, ধর্ম রয়েছে; এই ধর্মগুলির কারণেই সে মানুষ, তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। মানুষের সেই ধর্মগুলি হলো মানুষের অভ্যন্তরস্থ মানবীয় গুণাবলী। সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, দয়া, মায়া, ভালোবাসা, মনুষ্যত্ব, মানবতা, সৌহার্দ্যতা, বিবেক, সহমর্মিতা, ঐক্য, শৃঙ্খলা ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলী হলো মানুষের ধর্ম। যতক্ষণ একজন মানুষ অন্যের ব্যথায় ব্যথিত হয়, অন্যের দুঃখে দুঃখী হয়, অন্যের আনন্দে আনন্দিত হয়, অপরকে সহযোগিতা করে, আর্তপীড়িতের পাশে দাঁড়ায় ততক্ষণ সে ব্যক্তি ধার্মিক হিসেবেই পরিগণিত হবার যোগ্য। এই ধার্মিকের জন্য প্রয়োজন নামাজ, রোজা, প্রার্থনা ইত্যাদি, যেন তার আত্মার শক্তি বৃদ্ধি পায়, সে আরও বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, আরও বেশি করে নিজেকে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গ করার প্রেরণা লাভ করে। যদি কারো মধ্যে সহজাত মানবীয় গুণাবলীই না থাকে তাহলে সে তো মানুষই না। ধার্মিক হবার প্রশ্নই আসে না, তার আবার নামাজ কী, রোজা কী, পূজা কী, প্রার্থনা কী? এদের ব্যাপারে আল্লাহ কোর’আনে বলেছেন, ‘তারা চতুষ্পদ জন্তু-জানোয়ারের মত, বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট (সুরা আ’রাফ- ১৭৯)।’
কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আজকে আমরা ধার্মিক বলতে মানবতা বা মনুষ্যত্ব ধারণকারীদের বুঝি না, বুঝি ঐ দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি, টিকি, তিলক, ক্রুশ, তসবীহ, জপমালা তথা ধর্মীয় বেশ-ভূষা ধারণকারীদেরকে; যদিও আল্লাহ বলেছেন, আমি মানুষের পোশাক দেখি না, দেখি অন্তর ও তার কাজ (হাদিসে কুদ্সী)। খুবই স্বাভাবিক, কারণ মানুষের পোশাক আশাক, আচার-অনুষ্ঠান, প্রার্থনা-উপাসনা দিয়ে স্রষ্টা কী করবেন? তিনি অমুখাপেক্ষী, তিনি আমাদের উপাসনার কাঙাল নন। ওসব আনুষ্ঠানিকতা মানুষের কল্যাণের উদ্দেশ্যেই। আমি এত বড় ধার্মিক হলাম, এত বড় আবেদ হলাম, এত বড় সাধক হলাম, কিন্তু আমার দ্বারা মানুষ উপকৃত হলো না, তাহলে ঐ ধার্মিকতার কোনো মূল্য রইল না। স্রষ্টা তেমন ধার্মিকতা চান না।
মানুষের শান্তিতে স্রষ্টার সন্তুষ্টি, মানুষের অশান্তিতে স্রষ্টার অসন্তুষ্টি। তাই মহাপ্রভু আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুল-মহামানব পাঠিয়ে মানুষকে শান্তির পথনির্দেশ করেছেন। মহামানবরা এসে তাদের যার যার জাতিকে বুঝিয়েছেন সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হলো মানুষের প্রকৃত এবাদত। এই এবাদত করার জন্য শুধু বহিঃশত্রুই নয়, আপন লোকের সাথেও লড়াই করেছেন তারা। তারা বসে বসে শুধু স্রষ্টার স্তুতিকীর্তন করেন নি, তারা যা করেছেন সম্পূর্ণটাই ছিল মানুষের কল্যাণের জন্য, মানবতার জন্য। তাদের জীবন ছিল সংগ্রামী, বহির্মুখী। গৌতম বুদ্ধ কি পারতেন না তার সম্পদশালী পিতাকে বলে রাজভবনের কোনো এক জায়গায় একটি মন্দির বা উপাসনালয় নির্মাণ করে আরাধনা, পূজা-অর্চনা করতে? বেশ পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তিনি রাজ্য, স্ত্রী-সন্তান, আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে মানুষের দুঃখের কারণ কী, দুঃখ নিবারণের উপায় কী- তা সন্ধান করার জন্য অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছেন। তিনি হাসিমুখে গৃহত্যাগ করেছেন কেবলমাত্র মানুষের শান্তির উপায় অন্বেষণ করার জন্য, মানবতার তাগিদে। অথচ তার অনুসারীরা আজ কী করছে?
ইবরাহীম (আ.) সংগ্রাম করলেন তাঁর বাবার বিরুদ্ধে, মুসা (আ.) সংগ্রাম করলেন তাঁর আশ্রয়দাতা ফেরাউনের বিরুদ্ধে, আখেরী নবী সংগ্রাম করলেন আপন চাচার বিরুদ্ধে। এদিকে ভারতবর্ষের ধর্মগ্রন্থগুলো খুলে দেখুন- শ্রীকৃষ্ণ সংগ্রাম করলেন আপন মামার বিরুদ্ধে, যুধিষ্ঠির সংগ্রাম করলেন আপন চাচার বিরুদ্ধে, এটাই হলো মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের সংগ্রাম, অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের সংগ্রাম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম, অশান্তিকে শান্তি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। তাঁরা এত বড় ত্যাগ সাধন করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁরা মহামানব। কিন্তু তাঁরা যে সংগ্রাম করে মানবজাতির মধ্যে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে গেলেন আমাদের ধার্মিক সমাজের কাছে সেই সংগ্রামের কোনো অর্থই নেই। ঐ মহামানবদের অনুসারী দাবিদার আজকের ধার্মিকরা ধর্মের সংজ্ঞাই পরিবর্তন করে ফেলেছেন, মানবতার কল্যাণ নয় বরং উপাসনা, পূজা-অর্চনা, নামাজ-রোজাই তাদের কাছে আসল ধর্ম-কর্ম! সত্যের কি নিদারুন বিকৃতি!