হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

প্রকৃত ইসলাম বনাম বিকৃত ইসলামের ফল

জান্নাতুল ফেরদৌস

লক্ষ লক্ষ মসজিদে দৈনিক কোটি কোটি মুসলমান নামাজ পড়ছে, জুমার দিনগুলোয় মসজিদে এত ভীড় থাকে যে, ভিতরে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় চাটাই, জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছে। লক্ষ লক্ষ মুসুল্লি হজে এস্তেমায় গিয়ে মোনাজাত করছে। কিন্তু সমাজে কেন শান্তি আসছে না? ছবিটি ঢাকার উত্তরা থেকে তোলা। ক্লিক: রিয়াদুল হাসান

ইসলাম আল্লাহর প্রেরিত পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে মানুষ কীভাবে তার পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সামষ্টিক জীবন পরিচালনা করবে তার সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ মানবজাতির জন্য ইসলাম প্রেরণ করেছেন। যখন মানুষের সমাজ অন্যায়-অশান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে তখনই নবী-রসুলরা মানবসমাজে আল্লাহর তওহীদভিত্তিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাতে এই জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করে মানুষের সামষ্টিক জীবন ন্যায়, সুবিচার ও শান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। কিন্তু যখন মানুষ আল্লাহর অবাধ্য হয়েছে, নবীর আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করেছে, নিজেদের তৈরি আইন-কানুন দিয়ে চলতে চেয়েছে তখনই তারা নিজেদের সৃষ্ট অন্যায়, অশান্তি, জাহেলিয়াতে ডুবে গিয়েছে।

আজ আমাদেরও সেই দশা চলছে। আমরা সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে মানুষের তৈরি আইন-কানুন, হুকুম-বিধান, দণ্ডবিধি প্রতিষ্ঠা করে ব্যক্তিগতভাবে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতসহ বহু আমল করে যাচ্ছি। এসব ব্যক্তিগত আমল করে ভাবছি যে, আমাদের এসব ইবাদত বন্দেগির কারণে ইসলামের অনেক উপকার হচ্ছে, আল্লাহ অনেক খুশি হচ্ছেন, অনেক নেকি হাসিল হচ্ছে। আমাদের অনেক মসজিদ আছে যেগুলোতে সোনার গম্বুজ বসানো। টাইলস নির্মিত, এসি লাগানো মসজিদ আমাদের পাড়ায় পাড়ায়। দৈনিক শত শত মুসলমান সেখানে নামাজ পড়ছে, জুমার দিনগুলোয় মসজিদে এত ভীড় থাকে যে, ভিতরে জায়গা না পেয়ে রাস্তায় চাটাই বিছিয়ে নামাজ পড়ছে। প্রতি বছর তাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ হজ করছে। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তারা রসুলের ব্যক্তিগত অভ্যাস-অনভ্যাসের চর্চা করছে। এসবের বিনিময়ে তারা পরকালে সুন্দরী হুর পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

কিন্তু এত আমল, এত ইবাদত বন্দেগি, এত মসজিদ মাদ্রাসা সমাজে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না, মানুষের নৈতিক স্খলন ঠেকাতে পারছে না। আমাদের সমাজ দুর্নীতি, অপরাধ, দুরাচারে পরিপূর্ণ। সমাজের এমন কোন ক্ষেত্র বা স্তর নেই যেখানে দুর্নীতি প্রবেশ করেনি। অপরাধে প্লবিত সমাজ। তা নিয়ে আমাদের মুসুল্লিদের কোনো চিন্তা নেই। সমাজ বা দেশ নিয়ে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা এগুলোকে তারা ইসলামের চিন্তার বিষয় বলে মনে করে না। অথচ ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর রসুল (সা.) যে ইসলাম আরবের আইয়ামে জাহেলিয়াতের সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা অর্ধদুনিয়াকে শান্তির ছায়াতলে আনতে সক্ষম হয়েছিল। সমাজের ন্যায়, সুবিচার, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা, নিরাপত্তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আদালতে মাসের পর অপরাধ সংক্রান্ত কোন মামলা আসত না, মানুষের রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা-জানালা লাগানোর প্রয়োজন হত না, উটের পিঠে খাদ্যসামগ্রী ও অর্থসম্পদ বোঝাই করে ধনীরা দরিদ্র মানুষের সন্ধানে শহরে-উপশহরে ঘুরে বেড়াত, কিন্তু নেওয়ার মত কাউকে খুঁজে পেত না। কোনো মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেলে নির্দিষ্ট স্থানে খুঁজে পাওয়া যেত। এমন একটি সমাজ এখন আমাদের কাছে কল্পনা ও স্বপ্নের মত মনে হলেও একদিন তা কায়েম করেছিল ইসলাম।

আজ একই ইসলামের দাবিদার মুসলিম জাতির দিকে তাকালে দেখা যায় বিপরীত চিত্র। আল্লাহ রসুলের প্রকৃত ইসলাম মুসলিম জাতিকে করেছিল জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, নিত্যনতুন আবিষ্কারে, প্রযুক্তিতে সকল জাতির শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত, অর্ধ দুনিয়ার শাসনভার তাদের উপর অর্পন করেছিল; আর বর্তমানে ইসলাম মুসলিম জাতিকে করেছে দুর্বল, ভঙ্গুর, নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, দাস, অন্যজাতির গোলামে। বিশ্বজুড়ে তারা সংখ্যায় অগণিত কিন্তু তাদের এই সংখ্যা যেন ভেসে যাওয়া আবর্জনার মত মূল্যহীন। পৃথিবীর কোন দেশে তাদের আশ্রয় নেই, কোন দেশে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার মত তাদের অবস্থা নেই। যেমন- কয়েক বছর আগে মিয়ানমারে কী নৃশংসভাবে তাদের দেশছাড়া করা হয়েছে তা মোটামুটি সবাই জানেন। যারা তাদের প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে পালাতে পারেনি, তাদের বরণ করে নিতে রড মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে মর্মান্তিক মৃত্যু।

অন্যদিকে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ফিলিস্তিনে বছরের পর বছর ধরে চলছে মুসলিম নিধন, গৃহযুদ্ধ। লক্ষ লক্ষ মুসলমানের লাশের পাহাড় যেন আকাশ ছুঁয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলমান-মুসলমান মারামারি, কাটাকাটি আর যুদ্ধ করে যত মুসলমানের মৃত্যু হয়েছে তা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে হয়ত ঘটেনি। ৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে যারা অধিকাংশই ছিল মুসলমান। ইয়েমেনে সৌদির জোটের নেতৃত্ব চলেছে ইয়েমেনি মুসলিম গণহত্যা। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন করুণ দশা? এটার তো কথা ছিল না। আল্লাহ তো বলছেন, “আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, যারা ঈমান আনবে এবং আমলে সালেহ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীর কর্তৃত্ব (খেলাফত) প্রদান করবেন, যেমনটি তিনি দিয়েছিলেন পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি তোমাদের দীনকে প্রতিষ্ঠা করবেন যেটা তিনি তোমাদের জন্য পছন্দ করেছেন” (সুরা নুর ৫৫)।

তাহলে চৌদ্দশ বছর আগে যে ইসলাম পালন করে মুসলমান জাতি অর্ধ-দুনিয়ার শাসকে পরিণত হয়েছিল, আজ সেই ইসলামের অনুসারীরা কেন এত শক্তিহীন, দুর্বল, অন্য জাতির গোলাম? এর কারণ খুব সহজ, আজকে আমরা ইসলাম বলে যে ধর্ম বা দীনকে অনুসরণ করে চলছি, সেটা আল্লাহ-রসুলের সেই ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলাম বিগত ১৩০০ বছরে ধীরে ধীরে বিকৃত হতে হতে এখন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে গেছে, আর আমরা সেই বিকৃত বিপরীতমুখী ইসলামকেই প্রাণান্তকরভাবে মেনে চলেছি। ফলে আল্লাহর দৃষ্টিতে আমরা আর মো’মেন নেই, তাই আল্লাহর ঐ ওয়াদা আমাদের জন্য নয়। এই সত্যকে এখন মেনে নিতেই হবে। তাহলে সম্ভব হবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ সন্ধান করা।

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...