হুদায়বিয়ার চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল মুসলিমরা কেউ মক্কায় গেলে তাকে বন্দী করা হবে কিন্তু মক্কার কেউ মদীনায় এলে তাদেরকে আটকানো হবে না। ফলে মক্কার লোকেরা আত্মীয়তার টানে হোক বা কৌত‚হলের টানে মদীনায় যাতায়াত শুরু করে। ফলে কী হলো? তারা মদীনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার ফলে আরব্য বর্বরতার যুগ অপসৃত হয়ে যে শান্তিময় প্রগতিশীল নবীন সভ্যতার উদয় হচ্ছে তার সং¯পর্শ লাভ করল। ইসলাম সম্পর্কে তাদের নেতিবাচক ধারণাটি পাল্টে গেল। তারা বিস্ফোরিত নেত্রে দেখতে লাগল মানবাধিকার, শান্তি ও নিরাপত্তার একটি কুঁড়ি ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে মদীনার মরূদ্যানে। খালেদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আসের মতো ইসলামের ঘোর শত্রুরাও ইসলাম গ্রহণ করলেন। খ্রিষ্টান গোত্র বনী তাঈ – এর একজন নারী মদীনায় বন্দী হিসাবে ছিলেন বেশ কিছুদিন যিনি ছিলেন আদী বিন হাতিমের বোন। বন্দী অবস্থায় তিনি রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে যে মানবিক আচরণ লাভ করেছিলেন তাতে এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি মুক্তি পেয়ে তাঁর ভাইকে বলেছিলেন রসুলাল্লাহর (সা.) সঙ্গে দ্রুত সন্ধি করার জন্য।
কাউকে জোর করে ধর্মান্তরকরণের একটি ঘটনাও রসুলাল্লাহর (সা.) জীবনীতে নেই। কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া ইসলামের মূল নীতিবিরুদ্ধ। কেউ এমন ইতিহাস দেখাতে পারবে না যে নামাজ না পড়ার জন্য মদীনায় কোনো ব্যক্তিকে শরিয়াহ পুলিশ পিটিয়ে মসজিদে নববীতে হাজির করেছেন। বস্তুত কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে ইসলাম যুদ্ধ করে না, ইসলাম যুদ্ধ করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচার ও শোষণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ দুরাচারী শাসকের নি®েপষণের যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেয়ে ব্যক্তিজীবনেও ইসলামকে আলিঙ্গন করে।
আর রুচি ভাষা সংস্কৃতি? সেটা জল যেমন বিনা প্ররোচনায় নিচের দিকে গড়িয়ে যায় তেমনি রুচি, ভাষা ও সংস্কৃতিও স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে যতটুকু প্রয়োজন মানুষ গ্রহণ করে নেবে। কোনো শক্তি প্রয়োগ প্রয়োজন নেই – মঙ্গলময় কিছু চাপিয়ে দিলে তা অমঙ্গলের কারণ হয়। ভালো খাবারও জোর করে খাওয়ালে হিতে বিপরীত হয়। আরবরা ইসলাম নিয়ে চতুর্দিকে ধাবিত হয়েছিল এবং সত্যযুগ প্রতিষ্ঠা করেছিল বলেই আরবের ভাষা, পোশাক, দাড়ি, জোব্বা, পাগড়ি, খাদ্যাভ্যাসকেও মানুষ আদর করে বরণ করেছিল। এগুলো চাপানো হয় নি, চাপানো ইসলামে নিষিদ্ধ এবং আরবের কালচার অন্যান্য জনপদের লোকেরা গ্রহণ করবে এটা ইসলামের অভিপ্রায়ও নয়। ইংরেজরা এদেশ দুইশ বছর শাসন করে গেছে, তাই আমাদের জাতীয় পোশাক ধুতি/লুঙ্গি হলেও আমরা শার্ট প্যান্ট পরাকে আধুনিকতা মনে করি। মাদুর ছেড়ে টেবিলে খাই। এজন্য আইন করতে হয় নি।
ইসলামে কিছু আছে বিধান, কিছু আছে মূল্যবোধ বা উপদেশ। ইসলাম দেহ ও আত্মার শান্তি বিধান করে, দেহের উপরও কিছু চাপিয়ে দেয় না, মনের উপরও কিছু চাপিয়ে দেয় না। আল্লাহর রসুলকে আল্লাহ বার বার বলেছেন, তোমাকে দারোগা করে পাঠানো হয় নি, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠানো হয়েছে, তোমার দায়িত্ব কেবল পৌঁছানো, কোর’আন একটি উপদেশগ্রন্থ মাত্র ইত্যাদি। অর্থাৎ ইসলাম পৃথিবীতে মানুষের জীবন থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচার দূর করে সত্যভিত্তিক জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে এবং ব্যক্তিকে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেবে। তার সামনে সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায়ের মানদণ্ড তুলে ধরবে কিন্তু কিছু ওপর থেকে চাপিয়ে দেবে না। মানুষ চাইলে সেটা মানবে, চাইলে মানবে না। না মানলে এজন্য কাউকে শাস্তিও দেওয়া যাবে না। সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়াটা যেটুকু হওয়ার সেটুকু স্বাভাবিকভাবেই হবে।
জঙ্গিবাদীদের বা গোড়াবাদীদের একটি বড় ভুল এখানে। তারা শরিয়ত আর উপদেশ, মূল্যবোধ আর সংস্কৃতির পার্থক্যটা বোঝেন না। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতার কোনো মূল্যায়ন তারা করেন না, তারা এটা বোঝেন না যে, মানুষ সৃষ্টিগতভাবে স্বাধীন, তার আত্মা কারো দাসত্বের শিকলে আবদ্ধ হয় না। সেখানে জোরাজুরি চলে না – এটা মানুষের স্বভাবধর্ম। জঙ্গিরা তাই দাড়ি জোব্বা আর বোরকাকে ইসলামের বাধ্যতামূলক বিষয়ে পরিণত করে তা মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়ে ইসলামের বিরাট ক্ষতি সাধন করেছেন।
এক শতাব্দী আগে পুজিবাদী গণতন্ত্রের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষকে অর্থনৈতিক সাম্যের বাণীতে মন্ত্রমুগ্ধ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ ভোগের অধিকার, বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা ইত্যাদি ছিনতাই করা হয়েছিল, স্বর্গের নাম করে নরক চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাই সেই নরক থেকে বেরিয়ে পড়ার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনের ঝুকি নিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, জার্মান, ভিয়েতনাম, কিউবা থেকে পালিয়ে গেছে, পালাতে গিয়ে হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে সাগরে ডুবে মরেছে, সীমান্তরক্ষীদের গুলি খেয়ে মরেছে। তবু পালানো বন্ধ হয় নি। যেদিন বার্লিন প্রাচীর ভাঙলো সেদিন কী আক্রোশে সাধারণ মানুষ ঐ দেওয়ালটার উপরে ঝাপিয়ে পড়েছিল তা আমার আজও মনে পড়ে।
জবরদস্তি মানেই জাহেলিয়াত – সেটা ইসলামের নামেই হোক কিংবা গণতন্ত্রের নামে হোক কিংবা সমাজতন্ত্রের নামে। বলা যায় ইসলামিক ফ্যাসিজম হচ্ছে জঙ্গিবাদ। এই ফ্যাসিজমের হাত থেকে যারাই মুক্তি পেয়েছে তারাই সর্বপ্রথম যে কাজটি করেছে তা হলো বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছেন মুক্ত বাতাসে। তার সর্বশেষ নিদর্শন আমরা দেখলাম সিরিয়ায়।
সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স এসডিএফ মানবিজ থেকে আইএস ঘাঁটি উচ্ছেদের পর সেখানের নারী ও পুরুষদের মধ্যে আনন্দের ঝড় বয়ে যায়। মোল্লাতান্ত্রিক বিকৃত ইসলাম নারীদের উপর ভয়াবহ বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকে। তাই তারা আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। আর আইএসের চাপে বাধ্য হয়ে দাড়ি রেখেছিলেন যারা, তারাও একে অপরের দাড়ি ছেটে দিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। আইএস এর আরোপিত বিকৃত ইসলামের প্রতি বহুদিনের সঞ্চিত ক্ষোভ আনন্দের শ্রাবণধারা হয়ে জাতিকে আপসৃত করে দেয়।
আপনার বিশ্বাসকে প্রশ্ন করুন, এ কেমন ইসলাম, মানুষ যা থেকে মুক্ত হবার জন্য অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে আর মুক্ত হবার পর উচ্ছাস প্রকাশ করে? এর সাথে ঐ সমাজতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের কী পার্থক্য আছে? ব্যক্তিগত নামাজ রোজার ইসলামের বাইরে জাতীয় জীবনে যারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তা রাজনৈতিকভাবেই হোক বা সহিংস পথেই হোক, তারা আসলে এই বিকৃত শরিয়তের বাড়াবাড়িযুক্ত দাড়ি-টুপি-জোব্বা আর হাত কাটার ইসলামটিই প্রতিষ্ঠা করতে চান। তাদের ভাবে মনে হয় যেন জিজিয়া নিলে আর হাত কাটলেই শান্তি এসে যাবে। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। বিকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠা করলে কখনোই শান্তি আসবে না আর তাদের কাছে থাকা ইসলামটি হাজার বছরের অসংখ্য মুফাসসির, ফকীহদের ইজমা কিয়াস ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দ্বারা উদ্ভাবিত মাসলা-মাসায়েলের জালে আটকা পড়ে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। ইসলাম তার মূল লক্ষ্যই হারিয়ে দাড়ি, টুপি, টাখনু ইত্যাদির মধ্যে ঢুকে গেছে। এই ইসলাম বর্তমানে অচল, এর কোনো আবেদন মানুষের কাছে নেই। হয়তো এটা বুঝতে পেরেই জঙ্গিরা এর প্রচার না করে চাপিয়ে দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে যা অন্য ধর্মের মানুষ তো বটেই মুসলিম বংশোদ্ভূত মানুষকেও ইসলামবিদ্বেষী করে তুলছে।