ইসলাম নারীকে যে স্বাধীনতা দিয়েছে সে স্বাধীনতা তৎকালীন আরবে চিন্তাও করা যেত না। তৎকালীন আরব যেখানে কন্যা সন্তান জন্ম হলে পিতা-মাতার মুখ কালো হয়ে যেত, বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর মতামতের কোন গুরুত্ব ছিল না, নারীর অধিকার নিয়ে কেউ চিন্তা করতো না, প্রতিটি পরিবারে নারী ছিল নিগৃহীত। সমাজের জন্য নারী ছিল ভোগ বিলাসের উপকরণ বৈ আর কিছুই নয়। সে সমাজে এসে রসুল যে ইসলামের বাণী প্রচার করেছেন তা বর্তমানের চিন্তাশীলদের মগজে আঘাত হানতে যথেষ্ট। ইসলাম নারীকে শালীন পোশাক পরে সমাজের ব্যস্ত কর্মজগতের অংশীদারে পরিণত করেছে, তাকে দিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ। ইসলামের কৃষ্টি ও শিক্ষা নারীকে তার প্রকৃত সত্তাকে চিনতে সহায়তা করে।
বর্তমানে নারীদের যে অবলামূর্তি তার পিছনে অন্যতম কারণ হলো তারা ইসলামের সঠিক রূপ সম্পর্কে অজ্ঞ। এখনও আমাদের ধর্মের ধ্বজাধারীরা নারীকে গৃহবন্দী করে রাখার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা বলে থাকেন ‘নারী স্বাধীনতা মানেই নারীর ধ্বংস’। কিন্তু আল্লাহর রসুলের জীবনী থেকে আমরা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় দেখি।
আল্লাহর রসুল মদিনার একচ্ছত্র অধিপতি। মদিনার নারীরা তখন আল্লাহর রসুলের কাছে আসতেন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান জানার জন্য। রসুল ছাড়া তারা উম্মুল মুমিনিনদের কাছেও আসতেন তাদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে। একবার এক নারী এলেন উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) এর কাছে। দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে তিনি তার বেদনার কথা কাঁদতে কাঁদতে আয়েশাকে (রা.) বলতে লাগলেন, ‘আমার স্বামী আমার সঙ্গে স্বামী সুলভ আচরণ করেন না, আবার আমাকে তালাকও দেন না। আমি যেন তার কাছে একটি খেলনা ছাড়া আর কিছুই নই। তিনি যখন ইচ্ছা আমাকে তালাক দেন আবার ইদ্দত শেষ হওয়ার আগেই এসে বলেন তিনি তার মন পরিবর্তন করেছেন। আবার আমাকে নিয়ে ঘর সংসার শুরু করেন। কিন্তু তখনো তিনি আমার সঙ্গে স্বামী সুলভ আচরণ করেন না। কিছুদিন পর আবার তালাক দেন। এভাবে বার বার তিনি আমার ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন।’ এ ঘটনা শুনার পর উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) রসুলের ঘরে আসার অপেক্ষা করলেন এবং রসুল (সা.) যখন ঘরে এলো তখন তিনি রসুলের (সা.) সামনে বিষয়টি তুলে ধরেন। কিন্ত তখন পর্যন্ত আরবে নিয়ম ছিল যে ইদ্দত শেষ হওয়ার পূর্বে যদি স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেন তবে তালাক হবে না। রসুল (সা.) এ ঘটনা শুনে অপেক্ষা করলেন এবং সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই তাঁর উপর ওহী নাযিল হল। সুরা বাকার ২২৯ নম্বর আয়াত নাযিল হলো এবং বিধান দেয়া হলো যে, তালাকে রজয়ি দুবার। তারপর হয় নিয়ম অনুযায়ী স্ত্রীকে রাখবে নয়তো সহৃদয়তার সঙ্গে তার সম্পর্ক বিচ্ছেদ করবে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আল্লাহ নারীর অধিকারের ব্যাপারে বিধান দিয়েছেন। তিনি ভারসাম্য রেখে বিধান নাযিল করলেন যাতে নারীদের অধিকার বজায় থাকে। ইসলাম আগমনের পূর্বে একজন নারীর ক্ষেত্রে এ বিষয়ে কারো কাছে সমাধান চাওয়া যেমন ছিল অসম্ভব বিষয় তেমনি সমাধান পাবে এ আশাও ছিল দুষ্কর।
অপর আর একটি ঘটনা আমি এখানে উদ্বৃত করছি। একদিন এক তরুণী আম্মা আয়েশার কাছে এলেন। তার মন ভারাক্রান্ত, মুখে হাসি নেই। আম্মা আয়েশা তার কাছে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘তার পিতা তার মতের বিরুদ্ধে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান। এ বিয়েতে আমার মত নেই।’ মনের দুঃখে বললেও তখনো আরবে বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হতো না। পিতা বা অভিভাবকের ইচ্ছায় তাকে বিবাহ করতে হতো। তরুণীর মন খারাপ দেখে আয়েশা (রা.) তাকে রসুল ঘরে ফিরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। কিছুক্ষণ পর রসুল যখন ফিরে আসলেন তখন তিনি রসুলকে বিষয়টি অবহিত করেন। ঘটনাটি শুনে আল্লাহর রসুল আর দেরি করলেন না। তিনি তখনই সেই তরুণীর পিতাকে ডেকে পাঠালেন এবং সেই ঘটনা বর্ণনা করলে তরুণীর পিতা নিজের ভুল স্বীকার করলেন এবং তার মেয়ের অমতে তাকে বিয়ে দিবেন না এ কথাও বললেন। রসুল এরপর ঘোষণা করলেন, “বিয়ের ব্যাপারে কুমারী মেয়েদের কাছ থেকে মৌখিক সম্মতি নিতে হবে, আর বিয়ের কন্যা যদি বিধবা হয়, তবে তাদের মৌখিক স্বীকারোক্তি নেয়া অত্যাবশ্যক।”
বর্তমান সময়ে এ ঘটনা স্বাভাবিক মনে হলেও তৎকালীন আরবে এ এক যুগান্তকারী বিপ্লব। রসুল সেই তরুণীকে বিবাহের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করলেন। তরুণী এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলে এক অচিন্তনীয় কাজ করলো। সে তার পিতার ঠিক করা পাত্রের সাথে বিবাহে রাজি হয়ে গেল। তরুণীটি রসুলের কাছে এসেছিলেন এই বিষয় নিশ্চিত করতে যাতে পরবর্তী সময়ে আর কোন মেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রেই তাদের পিতা বা অভিভাবক জোর করতে না পারে।
এই দুটো ঘটনার মতেই আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবদের জীবনীতে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যেখান থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে ইসলাম নারীকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও মর্যাদা দান করেছে। তাই আমাদের উচিত ইসলামের প্রকৃত স্বরূপ বর্তমান সমাজের সামনে তুলে ধরা এবং এর ফলে আমাদের নারীরা ইসলাম কী তা বুঝতে পারবে ও তাদের হারানো সম্মান অর্জনে সচেষ্ট হবে।