রিয়াদুল হাসান:
ইসলামের প্রতিটি আমলের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু বর্তমানে সব আমলই একটি উদ্দেশ্যে করা হয়, তা হলো- আল্লাহ হুকুম দিয়েছেন তাই এটা পালন করলে সওয়াব হবে। আমরা আমাদের জীবনে যত কাজ করি প্রত্যেকটি কাজেরই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য থাকে। না বুঝে কোনো কাজ আমরা কেউ করি না। কিন্তু ধর্মীয় যে কোনো কাজের বেলায় আমরা এই সাধারণ জ্ঞানটি হারিয়ে ফেলি এবং উদ্দেশ্য না বুঝেই আমল করতে থাকি।
এখন হজ্বের সময় চলছে। হজ কেন করব এই প্রশ্ন করলেও হাজ্বীরা ঐ একই গতবাঁধা উত্তরই দিবেন- আল্লাহ হজ ফরদ করেছেন। এটা দিনের অন্যতম বুনিয়াদ। করলে আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি পাবো, নিষ্পাপ হয়ে যাবো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আদতে তা নয়। হজ্বের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাজীদের যেমন জানা দরকার তেমনি অন্য সকল মানুষেরও জানা দরকার। হজ্বের দু’টি প্রধান উদ্দেশ্য। একটি আধ্যাত্মিক আরেকটা হচ্ছে জাগতিক। মুসলিমের জীবন দেহ ও আত্মা, শরিয়ত ও মারেফত, ইহকাল ও পরকালের ধারণার ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। কারণ এই দীনের একটি নাম দীনে ওয়াসাতা বা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এই ভারসাম্য হারালে মানুষ আর মানুষ থাকে না, পশুতে পর্যবসিত হয়। যারা ইহকালে এই ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে তারাই হাশরের দিন পুলসিরাত পার হতে পারবে। এমন সূক্ষ্ম সেতু পার হওয়ার জন্য সবচেয়ে অপরিহার্য হচ্ছে ভারসাম্য। সেটা আমাদের ভারসাম্যের পরীক্ষা নেবে। তাই ইহজীবনে আমাদেরকে সার্বিকভাবে ভারসাম্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। দ্বীনের প্রতিটা বিষয় ভারসাম্যযুক্ত, যেখানে বাড়াবাড়ি সেখানেই ব্যর্থতা। তাই কোর’আনে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না।
যেটা বলছিলাম, ইসলামের যে কোনো আমলের সঠিক উদ্দেশ্য জানতে হলে উম্মতে মোহাম্মদীর সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে হবে। যেমন একটি গাড়ির চাকার উদ্দেশ্য বুঝতে হলে গাড়ির উদ্দেশ্যও আমাকে বুঝতে হবে। উম্মতে মোহাম্মদীর সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে পৃথিবী থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর করে দিয়ে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য জাতিটিকে হতে হবে সুশৃঙ্খল, নেতার প্রতি অনুগত, একতাবদ্ধ, শিক্ষিত, সভ্য, পরিচ্ছন্ন। সেজন্য শরিয়তের মধ্যে বিবিধ ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যেমন সওমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সংযমশিক্ষার জন্য। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, সময়ানুবর্তিতা, সাম্য, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি শেখানোর জন্য। মো’মেনরা নামাজের মাধ্যমে একজন নেতার আনুগত্য করার মহড়া দেবে, বাস্তব জীবনেও এক নেতাকে কেন্দ্র করে জীবনযাপনের শিক্ষা নেবে। আল্লাহ জুমার সালাতের আদেশ দিয়েছেন যেন বিভিন্ন এলাকা থেকে মুসলিমগণ এক জায়গায় সমবেত হবে, সেখানে তাদের নেতাও থাকবেন। এক সপ্তাহে যে বিশৃঙ্খলাগুলো হয়েছে সেগুলোর বিচার-আচার করা হবে, যেসব কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল সেগুলো কতদূর অগ্রসর হলো তার খোঁজ নেওয়া হবে। নেতা জাতির সদস্যদের সমস্যা শুনবেন, সমাধান করবেন। সেখানে জাতির কেন্দ্রীয় এমামের পক্ষ থেকে আগত নির্দেশনা পাঠ করে শোনানো হবে যাকে আমরা খোতবা বলি। এই জুমা হচ্ছে সাপ্তাহিক একটি সামাজিক সম্মেলন।
তেমনি হজ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর জাতীয় ও বাৎসরিক সম্মেলন। এর দুটো প্রধান উদ্দেশ্য- একটা হলো আল্লাহর হুকুম মান্য করার মহড়া, সেজন্যই হজের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে বলতে হয় লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। অর্থ আমি হাজির হে আল্লাহ। এই দোয়াটার তাৎপর্য হচ্ছে বান্দা যেন হাশরের দিন আল্লাহর সামনে হাজির হচ্ছে। ঐ হাজির হওয়ার সময় তার কোনো পিছুটান থাকবে না, কোনো আশা আকাক্সক্ষা থাকবে না। কোনো জৈবিক চাহিদা ও ভোগবিলাসের মোহ তার থাকবে না। হিংসা, ঈর্ষা, লোভ কিছুই থাকবে না। সেজন্য একটা পাখি হত্যা করাও নিষিদ্ধ এখানে। এটা যেন হাশরের দিন আল্লাহর সামনে নিঃস্ব, রিক্ত, আত্মসমর্পিত অবস্থায় কেবল কৃতকর্ম হাতে নিয়ে দাঁড়ানোর মহড়া। গায়ে রংহীন সেলাইহীন একপ্রস্থ সাদা কাপড়, মাথায়ও কোনো কাপড় দেওয়া যাবে না, গায়ে খুশবুও লাগানো যাবে না, এগুলো সবই হচ্ছে সেই চূড়ান্ত বৈরাগ্যের প্রশিক্ষণ। সুতরাং হজের উদ্দেশ্যের প্রথমটা হলো আখেরাতের মহড়া, এটা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে সবাই আল্লাহর কাছে ফেরত যাবে।
দ্বিতীয়টা হলো দুনিয়া। সেটা হচ্ছে আরাফাতের ময়দান। হজের ফরজের মধ্যে প্রথম হলো আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত হওয়া। লক্ষ্য করুন এখানে কী হয়। দুই ওয়াক্ত নামাজ একসাথে কায়েম করা হয়। এখানে অনেক কাজ থাকে জাতির এমামের। না, কোনো ভাড়াটে বা পেশাজীবী এমাম নন তিনি, তিনি অখ- উম্মতে মোহাম্মদীর এমাম। তিনি জাতির সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন। কোথায় কোন ভূখ-ে মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছে, কোথায় কে না খেয়ে আছে, কোন জায়গার কোন নেতা দুর্নীতি করছে সেগুলোর সুরাহা করতেন। খলিফা ওমর (রা.) এটাই করতেন, অনেক আমিরকে বরখাস্ত পর্যন্ত করতেন। সেখানে তিনি যে খোতবা দিতেন সেটা কী? সেটা হচ্ছে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এজন্য ঐ সময়ই নীতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে শত্রুরা যেন আরাফাতের সম্মেলনের ধারে কাছেও ভিড়তে না পারে। জাতীয় গোপনীয়তা রক্ষার্থে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। শত্রুরা হজের মাঠে গেলে অসুবিধা কি? তারা হজের অনুষ্ঠান দেখবে, মুগ্ধ হবে, দলে দলে যোগ দেবে, তাতে অসুবিধা কি? কিন্তু না, ঐসময় উপস্থিতি নিষিদ্ধ। আজও এ কথাটা লেখাটা আছে। কেন? কারণ গোপন কথা হবে, আলোচনা হবে জাতির ব্যাপারে, জাতির সমস্যার ব্যাপারে।
এমন একটি কার্যকর হজ গোটা জাতির চেহারা পাল্টে দেবে। সেখানে উপস্থিত মানুষগুলো অন্য মানুষ হয়ে যাবে। এজন্যই বলা হয়েছে, হজ করার পর মানুষ শিশুর মতো মাসুম, নিষ্পাপ হয়ে যায়। অতীতের গ্লানি, অনৈক্য, শত্রুতা, হানাহানি, স্বার্থপরতা সব দূর করে সে নতুন উদ্যমে, নতুন শপথ নিয়ে ফিরছে। এমামের নতুন সব আদেশ নিয়ে সে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। খেয়াল করে দেখুন, রসুলাল্লাহ কিন্তু সমগ্র জীবনে একটি মাত্র হজ্ব করেছেন- বিদায় হজ্জ। এখন তো বহু লোক বছর বছর হজ করেন। আজকের সেই হাজি সাহেবদের প্রতি সম্মান জানিয়েই বলছি, তারা হজের উদ্দেশ্য আর সঠিক জায়গায় নেই। রসুলাল্লাহ বিদায় হজের ভাষণে যে বিষয়গুলোর প্রতি সাংঘাতিক জোর দিয়েছিলেন সেগুলো একটা একটা করে মিলিয়ে দেখুন আমাদের সমাজে সেগুলো আমরা কায়েম করতে পেরেছি কিনা।
কোনো লোক যদি একটি মহান, বিরাট উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সারাজীবন আপ্রাণ চেষ্টা, অবিশ্বাস্য ত্যাগ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি সৃষ্টি করেন, তবে তিনি এ পৃথিবী ছেড়ে যাবার সময় তার সৃষ্ট জাতিটাকে কী উপদেশ দিয়ে যাবেন? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তিনি তার শেষ উপদেশে সেই সব বিষয় উল্লেখ করবেন যে সব বিষয়ের উপর তার জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এবং তার অবর্তমানে যে সব বিষয়ে জাতির ভুল ও পথভ্রান্তি- হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। তাই নয় কি? এখন দেখা যাক কী কী ছিলো তার বক্তব্যে। আমরা পাই:- (১) এই উম্মাহর লোকদের পরস্পরের সম্পত্তি ও রক্ত নিষিদ্ধ, হারাম করা। (২) আমানত রক্ষা ও প্রত্যার্পন করা। (৩) সুদ নিষিদ্ধ ও হারাম করা। (৪) রক্তের দাবি নিষিদ্ধ করা। (৫) পঞ্জিকা অর্থাৎ দিন, মাস, বছরের হিসাব স্থায়ী করা। (৬) স্বামী-স্ত্রী, নর-নারীর অধিকার নির্দিষ্ট করে দেওয়া। (৭) “কোর’আন ও সুন্নাহ”-কে জাতির পথ-প্রদর্শক হিসাবে রেখে যাওয়া। (৮) একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি-দেয়া নিষিদ্ধ করা। (৯) কোর’আন ও রসুলের সুন্নাহ অনুযায়ী শাসনকারী নেতার আনুগত্য বাধ্যতামুলক করে দেয়া। (১০) জীবন-ব্যবস্থা, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ করা। (১১) এই জাতির মধ্যকার শ্রেণীগত, ভৌগোলিক, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি সর্বপ্রকার ভেদাভেদ নিষিদ্ধ করা। (১২) সম্পত্তির ওসিয়ত নিষিদ্ধ করা, অর্থাৎ আল্লাহ যে উত্তরাধিকার আইন দিয়েছেন তা লংঘন না করা। (১৩) স্বামীর বিনানুমতিতে স্ত্রীর দান নিষিদ্ধ করা। বিদায় হজের এই ভাষণটি পর্যালোচনা করলে যা দেখা যায় তা হচ্ছে এগুলো আগে থেকেই কোর’আন হাদীসে ছিল। তারপরেও তিনি জোর দিয়ে গুরুত্ব সহকারে তাঁর জীবনের সর্বশেষ সমাবেশে এই নির্দেশনাগুলি আবারো জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। “খবরদার! খবরদার! আমার (ওফাতের) পর তোমরা একে অন্যকে হত্যা করে কুফরি কোরো না” এই সাবধানবাণীটি তিনি একবার নয়, বার বার উচ্চারণ করেছিলেন। কারণ তিনি তাঁর অবর্তমানে জাতির ঐক্যকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুধাবন করেছিলেন।
কিন্তু আজ আমাদের হাজী সাহেবগণ হজ থেকে এসে একটা চেক রুমাল মাথায় রাখেন, ডানেও তাকান না, বামেও তাকান না। সমাজ যেভাবে চলছে চলুক ভ্রুক্ষেপও করেন না। সকল সমস্যাকে এমনভাবে এড়িয়ে চলেন যেন দুনিয়াবি কোনো কিছুতে জড়িয়ে যেতে না হয়। অথচ হজের শিক্ষা তো এটা ছিল না। বাড়ির পাশে মুসলমানদেরকে নির্যাতন করা হয়, হত্যা করা হয়, ধর্ষণ করা হয়, গগনবিদারী আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে যায় সেদিকে হাজীরা দৃকপাত করেন না। বিভিন্ন দেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী আসে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এগিয়ে আসে আর্তমানবতার সেবায় কিন্তু হাজী সাহেবদের কোন খবর থাকে না। এমন কেন হলো?
কাজেই চিন্তা করতে হবে, চিন্তা করার সময় এসেছে। যথেষ্ট সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। আমরা সারা পৃথিবীতে বহু শতাব্দী ধরে মার খাচ্ছি, লাঞ্ছিত অপমানিত হচ্ছি। এখন আমাদের উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করে জাতির সেই সোনালি দিনগুলো ফিরিয়ে আনা। এজন্য মুসলিম জাতিকে তাদের প্রকৃত ধর্মের আদর্শের ভিত্তিতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই। এ সত্যটি মারখাওয়া জাতি যত দ্রুত উপলব্ধি করবে ততই মঙ্গল।
[লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট; facebook.com/riad.hassan.ht, ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩]