মসজিদ একটি আরবি শব্দ। এটি এসেছে সেজদা অর্থাৎ আনুগত্য থেকে। স্রষ্টার উদ্দেশে ভূমিতে মাথা ঠেকানোই সেজদা নয়, কারণ সমস্ত সৃষ্টিই আল্লাহ তা’আলাকে সেজদা করে (১৩:১৫)। তারা তো কেউ জমিনে মাথা ঠেকায় না। প্রকৃতপক্ষে সেজদা হলো আনুগত্য। আল্লাহ যে হুকুম দিয়েছেন সৃষ্টিকূল যদি তা মেনে নেয় তাহলেই তাঁর আনুগত্য করা হলো। গাছ, নদী, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি সকল সৃষ্টিজগতই আল্লাহ তা’আলার বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে তাদের নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে। এরা যদি আল্লাহর আনুগত্য না করত তবে জগতের অবস্থা কী হতো?
কর্তৃত্বশীল সর্বময় ক্ষমতার মালিক স্রষ্টার প্রতি সকল সৃষ্টি ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় আনুগত্য করতে বাধ্য। অতএব তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে নেয়াই যুক্তি, জ্ঞান ও বিবেকের দাবি। এ দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিকী প্রকাশ হলো সেজদা করা। এই প্রতিক প্রহসনে পরিণত হয় যখন মানুষ আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতা- সার্বভৌমত্বকে না মেনে নিয়ে শুধু আনুষ্ঠানিক সেজদা (মাথা ঠেকানো) করা হয়। আল্লাহ বলেন, তাঁকেই ডাক আনুগত্যকে একমাত্র তাঁরই জন্য বিশুদ্ধ ও নিষ্ঠাপূর্ণ করে (৭ঃ২৯)। মসজিদ আল্লাহর বড়ত্বের, শ্রেষ্ঠত্বের তথা সার্বভৌমত্বের প্রতিক। আল্লাহ বলেন- মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। সুতরাং আল্লাহর সহিত অন্য কাউকে আহ্বান কোরো না (৭২ঃ১৮)। খণ্ডিত আনুগত্য আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এটা শেরক। আল্লাহর কাম্য বিশুদ্ধ তওহীদ, সার্বভৌমত্ব। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের চর্চাকেন্দ্র মসজিদ। এখান থেকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের, সার্বভৌমত্বের যাবতীয় কর্মকাণ্ড মানুষ তাঁর খলিফা-প্রতিনিধি হিসাবে পরিচালিত করে থাকে। এটি দুনিয়াতে মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি প্রশাসনিক দপ্তর।
পৃথিবীতে আল্লাহর প্রশাসনিক দপ্তর মসজিদকে মো’মেনগণ সর্বসময়ে সঠিক অবস্থানে ধরে রাখতে পারে নি। ইবলিসের অনুচর কাফের-মোশরেকগণ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পতন ঘটিয়ে অনেক সময় মসজিদের পরিচালনার দায়িত্ব পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয় এবং আল্লাহর নাম দিয়ে তাদের ধর্মব্যবসা চালাতে থাকে। যেমনটা হয়েছিল প্রাক-ইসলামী যুগে কাবাঘরের বেলায়। আজকের দুনিয়ার মসজিদ সমূহও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকারকারীদের নিয়ন্ত্রণে।
আল্লাহর সার্বভৌমত্বের পার্থিব কার্যালয় ও আনুগত্যের প্রশিক্ষণ গৃহরূপে মসজিদের অপরিহার্যতা রসুলাল্লাহ (দ.) জানতেন বলেই মদীনায় গিয়েই তিনি মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন। তিনি মসজিদে আল্লাহর প্রতিটি হুকুম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চরিত্র সৃষ্টির অন্যতম পদ্ধতি পাঁচ ওয়াক্ত সালাহ আদায় করার মাধ্যমে সাহাবীদের প্রশিক্ষিত করতে শুরু করলেন। ধীরে ধীরে মসজিদে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সামরিক, বিচারিক ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল। প্রকৃত ইসলামের যুগের মসজিদের কর্মকাণ্ডের সাথে বর্তমান মসজিদের কর্মকাণ্ডের আকাশ-পাতাল ফারাক। এখানে এমনই কয়েকটি পার্থক্য তুলে ধরছি।
১) জাতীয় কার্যালয়: প্রকৃত ইসলামের সময়ে মসজিদ ছিল প্রধান রাষ্ট্রীয় কার্যালয় এবং সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল দুনিয়াবি ও আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু আজ মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলাই হারাম। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মসজিদ নির্মাণ করতে পারতো না, রাষ্ট্রীয় কার্যালয় যেভাবে ব্যক্তিগত বা দলগত উদ্যোগে নির্মাণ করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু আজ প্রায় সকল মসজিদই নির্মিত হয় লোকের টাকায়, চেয়েচিন্তে। অনেক সময় অপরের জমি দখলে রাখতেও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। প্রকৃত ইসলামের সময়ে মসজিদ ছিল সদা কর্মচঞ্চল, আর আজকের বিশাল বিশাল মসজিদগুলো নামাজের নির্দিষ্ট সময়টুকু ছাড়া রাতদিন তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকে।
২) কোষাগার: জাতির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন যাকাত, সাদকা, উশর, ফেতরা ইত্যাদি বণ্টন করা হতো মসজিদ থেকেই। আর আজ এমাম মোয়াজ্জেনের বেতন-ভাতাসহ মসজিদের উন্নয়নের কথা বলে জনগণ থেকে অর্থ গ্রহণ করা হয়। এমাম সাহেব ও তার সহকারীরা রাস্তার পাশে মাইকে করুণ সুরে বয়ান করে, হাত পেতে টাকা তোলেন। সেই অর্থের অধিকাংশই সংশ্লিষ্টদের ভোগে যায়, মসজিদের কাজে লাগে না।
৩) বিচারালয়: প্রকৃত ইসলামের যুগে মসজিদে সামাজিক অপরাধের বিচার ফয়সালা করা হতো, দণ্ড কার্যকর করা হতো। অথচ আজ চুরির ভয়ে মসজিদের দরজা, মাইক, ওজুর বদনা পর্যন্ত তালাবদ্ধ করে রাখতে হয়। আর নামাজের সময় নোংরা জুতাজোড়া রাখতে হয় সেজদার স্থানে।
৪) প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: তখন মসজিদের সম্মুখস্থ বারান্দার ফাঁকা জায়গায় শরীর গঠনমূলক দৌঁড়, কুস্তিসহ বিভিন্ন খেলাধূলার আয়োজন করা হতো। এছাড়াও তীর বল্লম নেজা ইত্যাদি চালনার প্রতিযোগিতা হতো। আজ সেখানে গোল হয়ে বসে হালকায়ে জিকির বা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। আর তাতে বক্তার বক্তব্যের মূল বিষয় থাকে ঢিলা কুলূক, দস্তরখান বিছিয়ে খানা খাওয়ার ফজিলত, কোন আমলে কত কত সোয়াব, বেপর্দা নারী কত ভয়াবহ ইত্যাদি।
৫) মেহরাব: সেকালে মসজিদের মেহরাবে যুদ্ধ সরঞ্জাম- তীর ধনুক নেজা বল্লম তলোয়ার ইত্যাদি রাখা হত। মেহরাব শব্দটির উৎপত্তি দক্ষিণ আরবীয় শব্দ র্হাব থেকে, হারব অর্থ যুদ্ধ (A Comprehensive Persian-English Dictionary, Page 1354)। আজও কেবলা নির্দেশক হিসাবে এবং পুরাতন ঐতিহ্য রক্ষার জন্য মেহরাব নির্মাণ করা হয়। কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদীর সেই যোদ্ধা জীবনও নেই, যুদ্ধাস্ত্ররও কোন প্রয়োজন হয় না। তাই আজ মেহরাবে রাখা হয় মসজিদের চাটাই, দেয়াশলাই, মোমবাতি আর এমাম সাহেবের থুতু ফেলার পিকদানী।
৬) সাহাবীদের থাকার জায়গা: আল্লাহর রসুলের সময় মসজিদ সংলগ্ন স্থানে হুকুমপালনে সদাপ্রস্তুত মুজাহিদ তথা আসহাবে সুফফার থাকার ব্যবস্থা ছিল। আর আজ মসজিদ সংলগ্ন স্থানে দোকান বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হয়।
৭) দূতাবাস: তখন মসজিদেই বিভিন্ন গোত্র বা রাজ্যের প্রতিনিধিদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হতো। আজ মসজিদের ধর্মজীবী এমাম মোয়াজ্জেন ও খাদেমদের বসবাসের জন্য হুজরা তৈরি করা হয়।
৮) মসজিদের এমাম: প্রকৃত ইসলামে প্রধান মসজিদের সালাতের এমাম হতেন আল্লাহর তা’আলার সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্বকারী জাতির এমাম। বর্তমানে সালাতের এমামতি করেন মসজিদ কমিটির আজ্ঞাবহ এক চাকুরীজীবি। একজন কর্মচারীকেই নেতা বা এমাম বলে ডাকা তো অসম্মান আর প্রহসন বৈ কিছু নয়। এবাদত কবুলের পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল রুজি। অথচ তাদের নিজেদের রুজি কেবল হারামই নয়, আল্লাহর ভাষায় তারা জাহান্নামের আগুন খায় (২ঃ১৭৪)।
৯) অনাড়ম্বর মসজিদ: খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ পর্যন্ত মসজিদগুলি ছিল অনাড়ম্বর। খেজুর গাছের কড়ি বর্গা, পাতার ছাউনি যা সামান্য ঝড়বৃষ্টিও ধরে রাখতে পারত না। কিন্তু এতে সালাহ কায়েমকারী মো’মেনদের ভয়ে কাফের মোশরেক ও তাদের সৈন্যবাহিনী থাকতো সদা কম্পমান। পক্ষান্তরে আজকের মসজিদগুলো অট্টালিকাসম, সেগুলোর মোজাইক করা ঝক্ঝকে মেঝেতে চেহারা দেখা যায়। কিন্তু প্রায়শই এসব মসজিদ শত্রুর গোলার আঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে যায়, কখনো বা মসজিদে আটকিয়ে মুসল্লীদেরকে হত্যা করা হয়। এই অর্থহীন আড়ম্বরের কথাই আল্লাহর রসুল বলেছেন, ‘আখেরী যুগের মসজিদসমূহ হবে জাঁকজমকপূর্ণ ও লোকে লোকারণ্য কিন্তু সেখানে হেদায়াহ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব থাকবে না [আলী (রা:) থেকে বায়হাকী, মেশকাত]’।
১০) মসজিদে নারী: আল্লাহর ঘর মসজিদে নারী পুরুষ উভয়েই সমানভাবে যাতায়াত করতেন। সালাতে, আলোচনা সভায় নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি অংশ নিতেন। কিন্তু আজ মহিলাদের মসজিদের যাওয়ারই কোনো সুযোগ বলতে গেলে নেই।
১১) যেকের: মসজিদে আল্লাহকে অধিক স্মরণ (যেকের) করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর আইন-কানুন, বিধি বিধান, আদেশ নিষেধ ইত্যাদির সবচেয়ে বেশি চর্চা হবে মসজিদে। বর্তমানে এসবের অস্তিত্ব নেই। এখন যেকের মানে হলো অনেকে জড়ো হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে, মাথা দুলিয়ে, পাড়া মহল্লা কাঁপিয়ে ‘আল্লা-হু আল্লা-হু’ জপ করা।
১২) খোতবা: প্রকৃত ইসলাম যখন ছিল তখন প্রতি শুক্রবার সামাজিক, জাতীয় সমস্যাদি জনগণকে অবহিত করা হতো, সে বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হতো। এখন জাতিকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ারই খতিবের নেই, তবু খোতবার ধারা যেহেতু ইসলামে ছিল তাই জুমা সালাতের পূর্বে বই দেখে অন্তত ৫০০ বছর পূর্বের তৈরি গতবাঁধা কিছু দোয়া কালাম পাঠ করা হয়, আরবীয়রা এসব বুঝলেও অনাবর মুসুল্লিদের অনেকেই কথাগুলো না বুঝতে পেরে ঝিমাতে থাকেন।
১৩) তত্ত্বাবধায়ক: মসজিদের তত্ত্বাবধানের অধিকার ছিল পরহেজগার মুত্তাকী মো’মেনদের (৮ঃ৩৪, ৯ঃ১৭-১৮) যা সরাসরি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতো। আজ যারা মসজিদের তত্ত্বাবধান করেন তারা অধিকাংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলীয় মতবাদের বিশ্বাসী, এবং অনেক ক্ষেত্রেই অবৈধ টাকার মালিকেরা।
১৪) মিনার ও আজান: মসজিদের মিনার, আল্লাহর ওয়াহদানিয়াত (একত্ব) আর সেই সাথে উলুহিয়াতের (সার্বভৌমত্ব) তথা ‘লা শারিক আল্লাহ’ এবং ‘লা এলাহা এল্লা আল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর কোন শরিক নেই এবং সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর-এ ঘোষণার এক স্থাপত্য প্রতীক (Symbolic Monument)। এ মিনার থেকে দৈনিক পাঁচবার আজানের মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণাও করা হয়। প্রকৃত ইসলামের সময়ে ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে পাড়া মহল্লা, পাড়া মহল্লা থেকে জাতীয় অঙ্গন সর্বত্র এক আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বাস্তবায়ন কার্যকর ছিল। সে সময় আজানের শব্দগুলোর অর্থগত দিক থেকে আল্লাহ তা’আলা যথার্থই সমাজে আকবর বা সর্বোচ্চ স্থানে ছিলেন। আর আজও আজান দেয়া হয়, ‘আল্লাহু আকবার’ বলাও হয়। ‘আশহাদু আল্লাহ এলাহা এল্লা আল্লাহ’ বলে সাক্ষ্য দেওয়া হয় কিন্তু বাস্তবে আল্লাহর হাতে সার্বভৌমত্ব নেই, সার্বভৌমত্ব আছে আল্লাহবিরোধী শক্তির হাতে। যারা আজানের এ ঘোষণা শুনে ছুটে আসছেন, তারাও আল্লাহকে একমাত্র বিধান দাতা-সার্বভৌমত্বের মালিক (এলাহ) বলে মানছেন না। তারা কেউ মানছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে, কেউ রাজাকে কেউ বা একনায়ককে। সুতরাং তাদের এই ঘোষণা মিথ্যা, আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা ও প্রহসন। আল্লাহ মোশরেকদের কোন দোয়া তিনি কবুল করবেন না এবং তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। আর সাথে সাথে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন বলে অঙ্গীকার করে রেখেছেন (৪ঃ৪৮/১১৬)। অথচ বহুবিধ তন্ত্রমন্ত্রে বিশ্বাসী বর্তমান মসজিদের মুসুল্লিগণ ধারণা করে বসে আছেন যে- মুসলিম বংশপরিচয় আছে বলে তাদের দেহ থেকে রূহ নির্গত হওয়ামাত্রই তাদেরকে লালগালিচা সম্বর্ধনা দিয়ে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হবে।